কিছু বিষাদগ্রস্থ দিন

4000
0

ঢং ঢং শব্দে ঘন্টা পড়ল। হৈচৈ করে উঠল ক্লাস থ্রির বাচ্চাগুলো। আমি বেরিয়ে এলাম ক্লাস থেকে। ঘড়িতে দুপুর একটা। স্কুলে এখন টিফিন পিরিয়ড। স্টাফরুমে টিচারদের ভীড়। এই একটা সময়, স্কুলের টিচাররাও বাচ্চাদের মত হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠে। স্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের যম, অংকের হাসনা ম্যাডামও খেয়েদেয়ে গুনগুনিয়ে গান ধরে। আমি এই স্কুলে চাকরি নিয়েছি মাস ছয়েক আগে। মাস্টার্সের রেজাল্ট হওয়ার মাসখানেকের মধ্যে চাকরিটি পেয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম প্রথম স্কুলে একটু অস্বস্তি হলেও এই কয়েকমাসে সকলের সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছি। আমি স্টাফ রুমে ঢুকতেই নিশা আপা হাত নেড়ে ডাকলেন,
– এই আফসানা, এখানে এসো।
ঘরের এক কোনে নিশা আপা সহ আরো পাঁচ-সাত জন কিছু একটা নিয়ে গোল টেবিল বৈঠক করছে। আমি এগিয়ে গিয়ে তাদের পাশে বসতেই নীলিমা আপা বলে উঠলো,
– আমরা সবাই আউটিং এ যাচ্ছি? যাবে নাকি? বেশি নয়, মাত্র দিন তিনেকের ব্যাপার। আগামী সপ্তাহে শনি-রবিবার ছুটি আছে।
আমি কিছু বলার আগেই দেবস্মিতাদি বলে উঠল,
– আরে, যাবে আবার কি! নিশ্চয় যাবে। আমাদের তো বয়স হতে চলল। আফসানা একদম বাচ্চা মেয়ে। হৈ হুল্লোড় করার এটাই তো বয়স। তবে, আমাদের সাথে যেতে যদি আপত্তি না থাকে।
আমি হাসলাম একটু। তারপর বললাম,
– আপনাদের সাথে যেতে আবার কিসের আপত্তি দিদি? কিন্তু…………
কথা শেষ করার আগেই ককর্শ শব্দে ফোনটা বেজে উঠল। বাবার ফোন। সাধারণত বাবা এ সময়ে কখনো ফোন করে না। আমি ফোন নিয়ে সরে এলাম জানালার পাশে। শ্রাবনের আকাশময় ছেয়ে আছে ভাঙা ভাঙা ধূষর মেঘ। যেকোন সময় হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামবে।
– হ্যালো বাবা,
– খুকি, এখন বাসায় আসতে পারবি?
বাবার কণ্ঠস্বর অসম্ভব ঠাণ্ডা। আমি ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলাম। এমন কণ্ঠ এর আগে শুনিনি আমি। তীব্র একটা অশুভ আশংকা জাপটে ধরল আমাকে।কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম,
– কিছু হয়েছে বাবা?
ফোনের ওপাশে বাবার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনলাম।
– খুকি, তোর মা কথা বলেছে। তোকে দেখতে চায়।
চমকে উঠলাম আমি। দুলে উঠল আমার পৃথিবী। মুহুর্তের জন্য মনে হলো আমার সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো। মাথা টা ঘুরে উঠল। নিশা আপা দৌড়ে এসে আমার হাতটা ধরলেন,
– কি ব্যাপার আফসানা? কি হয়েছে? খারাপ লাগছে?
আমি সামলে নিলাম নিজেকে। ধীরে ধীরে বললাম,
– আমাকে ফিরতে হবে আপা। এখুনি। এই মুহুর্তে।
নিশা আপা কিছুক্ষন দেখলেন আমাকে। তারপর বললেন,
– তুমি যাও। আমি হেডমিস্ট্রেসের সাথে কথা বলব।
আমি বেরিয়ে এলাম স্কুল থেকে। আকাশে মেঘের পরিমান বেড়েছে। অজস্র ধূষর মেঘ ছুটোছুটি করছে এদিক থেকে ওদিকে। মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস বইছে চারিদিকে। আমি জ্বর গ্রস্থের মত রিকসায় উঠে বসলাম। স্কুল থেকে বাসা মিনিট তিরিশের পথ। আজ প্রতিটি মিনিটকে দীর্ঘ যুগের মত মনে হচ্ছে। বাড়ি পৌছালেই মায়ের সাথে দেখা হবে। মা ডাকবে আমাকে। কি বলে ডাকবে মা?
আমি চোখ বন্ধ করলাম। ফিরে গেলাম আমার সেই শৈশবে। মা ছোট্ট বাটিতে দুধ-রুটি মেখে ডাকছে আমাকে। কি বলে ডাকছে?
– পাখি? নাহ… তিতির পাখি।
মা আমার নাম রেখেছিল তিতির। মা নিজে ডাকত তিতির পাখি বলে। তখন আমার বয়স মাত্র চার কিংবা পাঁচ। এক বারের কথা বেশ মনে পড়ে, আমি তখন সবে ক্লাস ওয়ান। স্কুলে দোলনা থেকে পড়ে গিয়ে আমার চিবুক কেটে গেল। মা ধারে কাছেই ছিল। চিবুক বেয়ে রক্তের ধারা দেখে মা নিজেই সেদিন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। তারপর থেকে মা আমাকে চোখের আড়াল হতে দিতে চাইতো না।
আরেকবার, দুপুর বেলা। এমনই শ্রাবনের কোন দুপুর।মাথার দুপাশে ঝুটি বাঁধা আমি মায়ের সাথে ছাদে এসেছি কাপড় তুলতে। আর তখনই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। মা কাপড় গুলো চিলেকোঠার ঘরে রেখে আমার হাত ধরে ছাদে এসে দাঁড়ালো। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। অজস্র বৃষ্টি কনা ঝর্ণার মত নেমে আসছে আমাদের উপরে। মা অচেনা সুরে কি একটা গান গেয়ে উঠল। আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকলাম। চৌদ্দ বছরের দীর্ঘ সময়ে আমি সেই সুর ভুলে গেছি।
.
আমি যখন ক্লাস ফোরে, তখন সকালের জন্ম। একদিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠতেই ছোট চাচ্চু আমাকে কোথাও একটা নিয়ে গেল। চাচ্চু বলল, এটা হাসপাতাল। দেখলাম, একটা ঘরে মা শুয়ে আছে। পাশে নীল তোয়ালের ভেতরে জ্যন্ত পুতুল হাত পা নাড়ছে। সেদিন যে আমার কি আনন্দ হয়েছিল তা বলে বুঝাতে পারব না। মা ফিসিফিসিয়ে বলেছিল,
– তিতির পাখি, এটা তোমার ভাইয়া। ভাইয়া কে হ্যালো বলো।
আমি জ্যন্ত পুতুলের কপালে চুমু খেয়ে বললাম,
– হ্যালো।
তার দু সপ্তাহ পরের একদিন। মা বাসায় ফিরেছে। কোলের মধ্যে সকাল কে নিয়ে বসে আছে। আমি বায়না করলাম, সকাল কে কোলে নিব। মা আমাকে খাটের মধ্যে হাটু মোড়া দিয়ে বসিয়ে, কোলে তুলে দিলেন সকাল কে। ছোট্ট সকাল তখন দিন রাত কেবল ঘুমিয়েই থাকে। মাঝে মাঝে মিনিট কয়েকের জন্য চোখ মেলে তাকায়। তারপর আবার ডুব দেয় ঘুমের দেশে।
মা বিছানা থেকে নেমে বাথরুমের দিকে গেলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,
– তিতির পাখি, ভাইয়াকে দেখে রেখো।
মুহুর্ত পরই তীব্র একটা চিত্‍কারে কেঁপে উঠল ভেতরটা। কোলের মধ্যে ছোট্ট সকালও ঘুম ভেঙে পিটপিট করে তাকালো বার করেক। ওদিকে রক্তে ভেসে যাচ্ছে স্নানঘর।
.
রিক্সা এসে দাঁড়াল গলির মুখে। আমি নামলাম। আর কয়েক হাত দূরে আমাদের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। গেট বেয়ে নেমে এসেছে মাধবীলতার একটা ঝাড়। লাল-সাদা-গোলাপী ফুলে আচ্ছন্ন হয়ে আছে বাড়িটা। কি অদ্ভুত মায়াময় লাগছে দেখতে। আমি বাড়ির সামনে থমকে দাড়ালাম। মা সেদিন পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল বাথরুমে। মাথায় আঘাত পেয়েছিল। প্রায় মাস তিনেক হাসপাতালে থাকার পর যখন বাড়ি ফিরল, তখন মা আর এ পৃথিবীর কেউ নয়। তার চোখের ঘোলাটে দৃষ্টি কিছুই দেখেনা, শুধু নির্বিকার তাকিয়ে থাকে। এ মা কাউকে চেনেনা। না আমাকে, না সকাল কে। তারপর একটু একটু করে কী গেল সময়।দীর্ঘ চৌদ্দটা বছর মা কেবল ঘোরগ্রস্থ, জড় বস্তুর মত পড়ে থেকেছে বাড়ির এক কোনে। সেই মা আজ কথা বলেছে। আচ্ছা, আজ মা আমায় চিনবে তো? মায়ের স্মৃতিতে জমে থাকা আট বছরের তিতির পাখির তেইশ বছর বয়সী তরুণী মুখ কে মেনে নিতে পারবে তো? আর সকাল? সেদিনের সেই চৌদ্দদিনের সকাল আজ চৌদ্দ বছরও অতিক্রম করে গেছে। মাকে কি বলব আমি আজ? অনেক কথা বলার আছে। সকালের হাত টা টেনে নিয়ে, তার সামনে দাঁড়িয়ে বলব, ” এই দেখো, তোমার তিতির পাখি, ঠিকই ভাই কে দেখে রেখেছে”।
.
আমার আজ খুব কান্না পাচ্ছে। আর কয়েক কদম এগুলেই, সামনে বারান্দা পেরিয়ে মায়ের ঘর। আমি এগুতে চাইলাম। কিন্তু কেন যেন পা আটকে গেছে মাটির সাথে। হঠাত বৃষ্টি নামল। তুমুল বৃষ্টি তে ভিজে যাচ্ছি আমি। আমার চোখের জল মিশে যাচ্ছে বৃষ্টির পানি তে। সামনে দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে কেবল বৃষ্টি আর বৃষ্টি।
ঘড়িতে প্রায় চারটে। আমি উঠে বসলাম। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি নেমেছে। জানালা দিয়ে আসা বৃষ্টির ছাঁটে ভেসে যচ্ছে বিছানা। আমি নিজেও ভিজে গেছি প্রায়। জানালা টা বন্ধ করে কিছুক্ষন বসে থাকলাম আচ্ছন্ন হয়ে। ইদানীং ঘুমিয়ে পড়লে প্রায়ই এই একই স্বপ্ন দেখি। মা ভাল হয়ে গেছে। ঠিক আগের মত। আজ স্কুলে হাফ পিরিয়ড ছিল। একটা নাগাদ বাসায় চলে এসেছিলাম। ক্লান্ত লাগছিল খুব। বাইরের পোশাক না পাল্টেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর আবার সেই স্বপ্ন।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। পুরো বাড়ি ফাঁকা। বাবা নেই। বেরিয়েছে হয়ত। আর সকাল গেছে প্রাইভেটে। মায়ের ঘরের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। ঘরটা একই রকম আছে। বিছানা তে নতুন চাদর পাতা। সাদা উপর নীল রঙ গড়িয়ে পড়ছে। অদ্ভুত কষ্ট কষ্ট ভাব জমা হয়ে আছে সেখানে। সবই ঠিক আছে এঘরে। শুধু মা নেই। আজ সতের দিন হলো, মা চলে গেছে। ঘুমের মধ্যেই, নিস্তব্ধ হয়ে গেছে নির্ভেজাল ভাবে। কোনরকম যন্ত্রনা ছাড়ায় হারিয়ে গেছে। চৌদ্দবছর যেমন নির্লিপ্ত ছিল মা, তার বিদায়টাও তেমন নীরবেই হয়েছে। অথচ আজও আমার স্বপ্নে ঘুরে ফিরে আসে মায়ের সুস্থ হয়ে ওঠার খবর।
.
মায়ের ঘরের জানালা টা খুলে দিই আমি। সাথে সাথেই মাতাল হাওয়ারা হুটোপুটই শুরু করে ঘরময়। দূরে রাস্তা দেখা যাচ্ছে। তার ওপারে কয়েকটা বাড়ি। একটা বাড়ীর ছাদে, দুই ঝুটি করা বাচ্চা মেয়ে তার মায়ের সাথে হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজছে, ঠিক বহু বছর আগের তিতির পাখি আ মায়ের মত। সে মা ও কি কোন অচেনা সুরে গান গাইছে? আমি কান পাতলাম। শুধু নিরবিচ্ছিন্ন বৃষ্টি সংগীত ছাড়া আর কিছুই কানে এল না। আমার বুকের ভেতর টা হুহু করে ওঠে। আমি নিশ্চল হয়ে নিঃশব্দে, কাঁদতে থাকি। জানালা দিয়ে উড়ে আসা বৃষ্টি জল মিশতে থাকে আমার চোখের জলের সাথে।

লিখেছেনঃ সাবিহা বিনতে রইস