বিবাহ- একটি স্বর্গীয় অনুভূতি

4490
0

যন্ত্রকৌশল থেকে বি,এস,সি শেষ করার পর ঠুসঠাস একের পর এক জব ইন্টারভিউ দিতে থাকলাম। শেষমেশ…চাপার জোরে, নাকি মামার জোরে, নাকি স্মার্টনেসের জোরেই হোক- ঠাই হল CHEVRON & PETROBANGLA যৌথ-কোম্পানির অধীনস্থ MUCHAI GAS PIPELINE COMPRESSION STATION এর OPERATIONS ENGINEER হিসেবে, তবে মেধার জোরে যে জবটা পাই নি; এতে কোন সন্দেহ নেই। সেলারি গগনচুম্বী না হলেও অনেকটা এভারেস্টচুম্বী ছিল বৈকি।

তো ফার্স্ট সেলারি বাবার হাতে দিলাম আর সম্ভবত ঐ দিন থেকেই তিনি ভাবতে লাগলেন… আমার এত টাকা, আমার ছেলের এত টাকা, খাবে কে? সুতরাং আমার ছেলেকে একটি উপযুক্ত পাত্রীতে পাত্রীস্থ করতে হবে।
যাই হোক, পরদিন থেকেই তিনি পাত্রী খোঁজার সুকঠিন কাজটিতে আনন্দের সাথে নেমে পড়লেন। তিনি আর মা সারাদিন এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলেন। বেশ কয়েকটা উচ্চ ধাতুর চকচকা পাত্রী পেয়েও গেলেন। আর ওগুলো নিয়েই সারারাত ধরে তাদের ফিসফিসানি চলতে থাকে।

বাবাকে বলতেও পারছিলাম না যে, দেখতে খুব সুন্দরী আর ইয়া লম্বা লম্বা চুল থাকলেই একটা মেয়েকে ঘরের বউ বানানো যায় না। ভাবলাম, বাবাকে কিছুদিন সময় দেই… একসময় তিনিই ক্লান্ত হয়ে পড়বেন, তখন আমার উপরই তিনি বউ খোঁজার দায়িত্ব চাপিয়ে দিবেন।
কাহিনী ঠিক তাই ঘটল। একদিন রাতে বাবা একটা মেয়ের ছবি আমাকে দেখিয়ে বলেন, “দেখতো বাবা, মেয়েটার চোখদুটো”
আমি ছবিটা হাতে নিয়ে বললাম, “ হুম, চোখদুটো খুব সুন্দর কিন্তু তুমি মনে হয় নাকটার দিকে তাকাতে ভুলে গেছ বাবা”।

বলতেই বাবা চেহারাটা কালো করে এক টানে আমার হাত থেকে ছবিটা কেড়ে নিয়ে বলল, “তুমি এর চেয়ে ভাল একটা খুঁজে দাও দেখি?”
আমি বললাম, “ঠিক আছে। আমি খুঁজে বের করে দিব আর বাকি সবকিছুর দায়িত্ব কিন্তু তোমার…”
বাবা ছোট্ট করে একটা হাসি দিয়ে তার রুমে চলে গেল। আমি কাল-বিলম্ব না করেই রাজুকে ফোন দিলাম… “দোস্ত! আব্বা রাজী, এইবার বল কি করতে হবে?”
রাজু বলল, “কাল সকালেই বাসায় চলে আয়”
“ওকে মামা…”

মেয়েটির নাম শুভ্রা… ঠিক যেন ধরণীর আপামর শুভ্রতা তাকে ছেয়ে আছে- বাহ্যিক সৌন্দর্য বলি আর অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বলি… দুটোকেই। কলেজে থাকতে কলেজের প্রতিটি ছেলেই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল… এবং আমিও ঐ কলেজেরই একজন ছাত্র ছিলাম। যাই হোক… সবাইকে সে এক কথাই বলত, “শোন্ দোস্ত। ভালোবাসা একটা ছেলে-খেলা না যে মন চাইল খেললি, আর মন চাইল না- তাই আর খেললি না। আগে নিজে প্রতিষ্ঠিত হ… তুই তো তোর নিজের জীবনেরই কোন গতি করতে পারলি না, আর আমার জীবনের ভার নিয়ে পথ চলবি কি করে?”
ঐ একটা মেয়ে, আমাদের ঐ একটা প্রশ্ন দিয়েই বোকা বানিয়ে রেখেছিল কলেজ জীবনের দুটো বছর।

তো সকাল ১১ টায় রাজুর বাসায় যাই। শুনলাম… সেই শুভ্রা এখনও তার সেই দৃঢ় সঙ্কল্পে অনড়। এখান-সেখান থেকে অনেক বিয়ের প্রস্তাবও নাকি যায়, কিন্তু সবগুলোতেই কি যেন একটা ত্রুটি থেকে যায়। ঐদিন রাজু একটা কথা বলেছিল, “ দোস্ত, আমি যতদূর শুভ্রাকে জানি… She’s perfect for you”
যাই হোক,রাতে বাসায় ফিরে বাবাকে শুভ্রার বাসার ঠিকানা দিলাম। বাবাকে আর পায় কে? পরদিনই তিনি আর মা শুভ্রার বাসায় গিয়ে হাজির।
বিকেলে রাজু ফোন দিল… “মামা… Shuvra is for you… মিষ্টি নিয়া বাসায় আইসো”।
– কি হইছে বলবি তো?
– কি আর হবে? একটু আগে শুভ্রা আমারে ফোন দিছিল, এই তুই সেই তুই কিনা জিগাইল। যতদূর বুঝলাম মামা… তাহার কোন আপত্তি নাই”
– থ্যাংকস দোস্ত।
– কারে থ্যাংকস দিলা মামা? আমারে না তোমার হবু বউরে?
– তোরে শালা। রাখ, bye.
…বাসায় ফিরতেই দেখি বাবা সোফাতে বসে টিভি দেখছেন। আমাকে দেখেই বলল, “কাল অফিসে যেতে হবে না। কাল তোমার মাকে নিয়ে বিয়ের বাজার করতে যাবা”।
একটা শুকনো হাসি দিয়ে “হুম”… বলেই আমি মার কাছে গেলাম। মাকে দেখি বেজায় খুশি। যাই হোক…অনেক ধুম-ধামের সাথে আমার বিবাহ পর্ব শেষ হল।

অনেকেই অনেক স্বপ্ন দেখে তার ফুলশয্যা নিয়ে। আমিও অনেক দেখেছি এবং অনেক কিছু করেছিও বটে। যাই হোক, ঐ রাতে ওখানে কি হয়েছিল তা কেবল আমি জানি আর জানে সেই শ্বেতশুভ্র শুভ্রা। তবে এখানে একটি কথা না বললেই নয়, আর তা হল… আমি যে কতবার রবি ঠাকুরের ‘হৈমন্তী’ গল্পটা পড়েছি আমি নিজেও জানি না। কেমন যেন এক অমৃতমাখা একটা গল্প। আমি যতবারই গল্পটা পড়েছি, একটা লাইন পড়ার সময় ততবারই আমার হৃদয়টা কেঁপে উঠত, আর সেই লাইনটি হল… “দানের মন্ত্রে স্ত্রীকে যেটুকু পাওয়া যায় তাতে সংসার চলে, কিন্তু পনেরো-আনা বাকি থাকিয়া যায়। আমার সন্দেহ হয়, অধিকাংশ লোক স্ত্রীকে বিবাহমাত্র করে, পায় না এবং জানেও না যে পায় নাই; তাহাদের স্ত্রীর কাছেও আমৃত্যুকাল এ খবর ধরা পড়ে না। কিন্তু, সে যে আমার সাধনার ধন ছিল; সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ”… এবং ঐ রাত থেকেই তাকে কেবল আমার সম্পদে রূপায়িত করতে আমি নিজেকে তার মাঝে পরিপূর্ণভাবে সঁপে দিয়েছিলাম।

বিয়ের দিন থেকে লাগাতার তিনদিন পর্যন্ত আমার চেহারায় একটা নীলাভ ছায়া লেগেছিল, আর শুভ্রা… ও যেন ঠিক একটা লজ্জাবতী ফুলের মতই শুভ্রতার মাঝে কিঞ্চিত রক্তিম আভায় নিজেকে প্রস্ফুটিত করেছিল।
লাগাতার তিনদিন আয়েশের পর অফিসে যেতে হবে। আমি সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি- এর মাঝেই ও ফ্রেশ হয়ে চা নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষমাণ। আমি শার্ট-প্যান্ট পড়ে চা খেয়ে নিলাম। টাই-টা হাতে নিতেই মনে পড়ল… কোথায় যেন একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম,“… wanna be romantic? Let your wife tie your tie.” আমি টাই-টা ওর হাতে দিলাম। ও তখন ছোট্ট করে একটা হাসি দিল, যা আমার বোধগম্য ছিল না… তবে ওটা যে কিছুটা গর্ব, কিছুটা রোমান্টিকতা, কিছুটা লজ্জার সংমিশ্রণের একটা বহিঃপ্রকাশ ছিল তাতে আমি সন্দেহাতীত।

শুরু হয়ে গেল জীবনের নতুন এক অধ্যায়… এটা করো প্লিজ, ওটা করো না প্লিজ, রাগ করো না প্লিজ… এটা তো তোমার-আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই বলছি, তাই না?, এটা করা যাবে কি?, ওটা করলে তুমি কিছু মনে করবে নাতো আবার?… এরূপ হাজার প্রশ্ন… আকুতি… উপদেশ… অনুরোধগুলো যেন আমার রাতজাগা সব স্বপ্নগুলোকে কিছুটা জোর করেই সশরীরে আমার সামনে এনে হাজির করছিল।

একদিন ওর শরীর খারাপ করল। রাতে ভালো ঘুম হয় নি ওর- সারারাত এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়েছে। তো আমি সকালে উঠে দেখি ও ঘুমুচ্ছে… চোখদুটো বন্ধ… ঠিক যেন একটা স্বর্গীয় নিষ্পাপ পরী আমার খাটে ঘুমিয়ে আছে। কি বলব আমি?… এই পৃথিবীর আর ১০-২০ টা জামাইবাবু এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যতা উপভোগ করে কিনা জানি না… তবে যারা করে নি বা করতে পারে নি, আমি বলব… তারা সবাই তাদের বউকে শুধুই ভোগ করেছে, অনুভব করতে পারে নি।
খুব ইচ্ছা করছিল একটু ছুঁয়ে দেই তার শুভ্র কপালখানা, কিন্তু ওর ঘুম ভেঙ্গে যাবে ভেবে খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে অফিসে চলে গেলাম।

অফিসে গিয়ে দেখি হুলস্থুল কাণ্ড। ঐ দিনের ভিতরেই নাকি একটা প্রজেক্ট শেষ করতে হবে। আমি আমার কর্তব্যেরত। হঠাৎ দেখি মোবাইলে একটা ম্যাসেজ আসলো। Megan Nicole এর B-e-a-utiful গানটার মাঝের দিকটার তিনটি লাইন…
“My heart is waiting for your love,
My hand is waiting for your touch,
My lips just wanna be kissed by you.”
তা আর কারো নয়… আমার শুভ্রার পাঠানো। আমি খানিক ভেবেই আমার ব্যাকুল শুভ্র পরীটার দিকে ছুট দিলাম। বাসায় পৌঁছে দেখি সে জানালার শিক ধরে দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে। আমি কোন কথা না বলে ওর কোমরে হাত রেখে কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললাম,
-Let me make those words fulfilled…
-লাগবে না।… বলেই ও মাথাটা একটু বাকিয়ে আমার মুখে ওর চুলের পরশ বুলিয়ে দিল।
আমি ওর চুলে আমার নাক গুঁজিয়ে দিতেই ও সোজা উল্টা ঘুরে আমার দিকে তাকাল। ওর এলোমেলো চুলগুলো ওর চোখদুটোকে আভরণে আবৃত করে রাখল। আমি ডান হাতে তার চোখদুটো উন্মুক্ত করে দেখলাম… চোখদুটো ঘিরে জড়ো হয়েছে পৃথিবীর সব না বলা কথা, অদৃশ্য সব ভালোবাসা… আর সেই অদৃশ্য ভালোবাসাকে দৃশ্যমান করার দায়িত্ব আমার হাতেই অর্পিত ছিল।

যাই হোক খানিক দুষ্টুমি শেষে অফিসে ফিরে গেলাম। গিয়ে দেখি, আমার বস্ আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমাকে দেখেই কিছু নরকীয় নীতিবাক্য ঝাড়লেন… তারপর বলে দিলেন খুব সাবধানে থাকবেন হাসান সাহেব।…কথাগুলো মনে অপমানের কড়া দাগ কাটলেও, সেই শুভ্র মুহূর্তের স্মৃতিগুলো রোমন্থনে ক্ষত দাগগুলোতে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায়।

শুভ্রা যখন কিছু বুঝাতে চাইত তখন খুব সুন্দর করে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে অনর্গল বলে যেত। ওর মুখে লেগে থাকা হাসির অন্তরালে থেকে ও কথাগুলো বলে যেত। প্রায়ই আমি ওর কথা শোনা বাদ দিয়ে ওর চোখ-মুখের বিচিত্র ভঙ্গিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সে যখন এটা বুঝতে পারত, তখনই কথা থামিয়ে দিয়ে বলত, “বলতো, আমি এইমাত্র কি বললাম?’’
আমি কিছুই বলতে পারতাম না। শুধু হা করে তাকিয়ে থেকে বলতাম, “কই? শুনি নি তো”। ও তখন রেগেমেগে আগুন হয়ে আমার পেটে-বুকে দুই-তিনটা এলোপাথাড়ি ঘুষি বসিয়ে দিত।

আর এভাবেই কিছুটা আবেগের মৃদু বেগুনী রং; কিছুটা দুঃখের মৃদু নীল রং; কিছুটা উদারতার মৃদু আসমানি রং; কিছুটা বিরক্তির মৃদু সবুজ রং; কিছুটা পাগলামির মৃদু হলদে রং; কিছুটা সমঝোতার মৃদু কমলা রং এবং আর অসীম রোমান্টিকতার গাঢ় লাল রং… বিচ্ছিন্ন কিন্তু রংধনুর ন্যায় অবিচ্ছিন্ন সুতোয় মিলিয়ে আমাদের সংসার জীবনকে করেছিল মোহনীয়… করেছিল ঐ রংধনুর মতই উপভোগ্য।

আমরা চাচ্ছিলাম অন্তত দুই বছর পর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কিছু একটা ভাববো। কিন্তু বিয়ের তিন মাস যেতে না যেতেই মা আমাকে বললেন, “আমার খুব শখ, সাথে তোর বাবারও… একটা ফুটফুটে বাচ্চা যেন আমাদের ঘরটাকে সারাদিন মাতিয়ে রাখে”।
আমি বললাম, “কিন্তু মা…”
“আর কোন কিন্তু না। তুই শুভ্রার সাথে কথা বলে দেখ”
আমি রুমে এসে শুভ্রাকে বাবা-মার ইচ্ছার কথা জানালাম। দেখি, তারও কোন আপত্তি নাই।
যা হওয়ার তাই ই হল। আমার শুভ্রা একটু একটু করে অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল। একদিন সকালে টাইটা হাতে নিতেই ওর দিকে চোখ চলে যায়। দেখি, সে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। কেন যেন ঐদিন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না… হয়তো তার মাঝে আমার নতুন আরেক অস্তিত্বের আবির্ভাবের কারণে। তো আমি টাইটা পড়ে, ওর শুষ্ক কপালে আলতো করে একটা চুমু খেলাম। আমি যেইমাত্র ওর কাছ থেকে দূরে যেতে চাইলাম… দেখি ও এক হাতে আমার টাইটা ধরে আছে। ও চোখদুটো বন্ধ রেখেই ঠোঁটদুটো একটু বাকিয়ে বলল, “আরেকটু আদর করে যাও, প্লিজ…”
ভাবা যায়? …আমার শুভ্রা আজ আমার আদরের কাঙ্গাল… আমার আদরের জন্য সে আজ ছটফটাচ্ছে।
আমি টাইটা একটু হালকা করে দিয়ে উপরের বোতাম দুইটি খুলে দিলাম। শার্টের হাতাদুটো কনুই পর্যন্ত উঠিয়ে দিয়ে ওর পাশে আধশোয়া হয়ে শুয়ে পড়লাম। তারপর, তার মাথা আমার বুকে টেনে নিলাম আর ডানহাতে তার চুলে হাত বুলাতে লাগলাম। এই যা… তাতেই দেখি, পৃথিবীর প্রতিটি কোনে জমে থাকা সব লুকানো পরিতৃপ্তির সুখ আমার শুভ্রার চোখে-মুখে ভেসে উঠেছে। সত্যি বলতে, আমার এতটুকুন কষ্টের জন্য তার এই অসীম তৃপ্তি দেখে কেন জানি আমার আঁখির কোঠরে দুইটি শিশিরবিন্দু জড়ো হয়েছিল সেদিন।

সেদিন অফিসে না যাওয়াতে বস্ সেই রকম ঝাড়ি দিয়েছিলেন। আমি চুপ করে সব শুনলাম। তাঁর কথা বলা শেষ হওয়ার পর আমি শুধু বলেছিলাম, “Sir, It is for my wife and she’s now pregnant.” দেখি, আমার বস্ চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “Sorry my son! I’m extremely sorry. Take care of her.” …বলেই তিনি তাঁর চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে থাকে। ১ মাস, ২ মাস, ৩ মাস, ৪ মাস, ৫ মাস কেটে যায়। ডাক্তার আমার সন্তান নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। আর তাতেই ও আমাদের মেয়ের নাম ঠিক করে ফেলে। শুভ্রা থেকে ‘শু’ আর হাসান থেকে ‘হা’… শুহা।

যতই দিন যাচ্ছিল, শুভ্রা কেমন যেন ভেঙে পড়ছিল। আমি তাকে সেভাবে খেয়াল করতে না পারলেও আমার মা তাকে ছায়ার মতন খেয়াল করতেন। কখন ঘুমানোর সময়, কখন একটু হাঁটাহাঁটি করতে হবে, কখন কোন ওষুধ খেতে হবে… এই সব কিছু।

প্রায় রাতেই দেখতাম, সে ঘুম থেকে উঠে বসে আছে আর তার দুচোখের দুপাশ দিয়ে লোনা জলের প্রবাহ। আমি নির্বাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তাকে শক্ত করে ধরে রাখা ছাড়া আমার কিছুই করার ছিল না। আসলে এই কষ্টটা একান্তই একটা মায়ের। এই কষ্ট বুঝে উঠার ক্ষমতা আমি কেন, যেই মেয়ে মা হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে, বোধ করি… তিনিও বুঝতে অক্ষম।

ধীরে ধীরে সেই ভয়ানক মুহূর্ত ঘনিয়ে আসতে লাগল। একজন মহিলা ডাক্তার নিয়মিত রাতে এসে ওকে দেখে যেতেন। তো এক রাতে তিনি ওকে দেখে আমাকে বাইরে ডাকলেন… বললেন, “ওকে বাসায় রাখা ঠিক হচ্ছে না। হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেওয়াটাই ভাল হবে”।
আমি বললাম, “এখানেই না হয় সব কিছুর ব্যবস্থা করি? আপনি কি বলেন?”
“না, আপনি কখনই বাসায় ওভাবে তার যত্ন নিতে পারবেন না…”
তো বাধ্য হয়ে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিলাম। মা, একজন নার্স সবসময়ই তার পাশে থাকতো। তার যত্নের কোন ত্রুটি হত না, কিন্তু বোধ করি সে আমার কাছ থেকে সব সময় কিছু একটার দাবি নিয়ে তাকিয়ে থাকত। আমি সব কিছু বুঝেও কিছু না বুঝার ভান ধরে থাকতাম।

দেখতে দেখতে ঠিক নয় মাস পূর্ণ হল। ডাক্তারকে কেমন যেন বিষণ্ণ মনে হচ্ছিল। এখনও তেমন কিছুর ইঙ্গিত দিতে পারছেন না তিনি। কিছু জানতে চাইলেই বলেন,“আমি দেখছি”… বলেই একটু বিষণ্ণ হয়ে তার চেম্বারে চলে যান।
নয় মাস পাঁচ দিন। প্রতিদিনের মতই আমি বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসে আছি। নার্স দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। দৌড়ে রুমে ঢুকলাম। দেখি ও বিছানার চাদরটাকে খামছে ধরে আছে। দাঁত কিড়মিড় করছে। আর তার চোখদুটো দিয়ে অঝোরধারায় অশ্রু ঝরছে। আমি সোজা ডাক্তারের চেম্বারের দিকে দৌড় দিলাম। দেখলাম, নার্স তার সাথে আরও তিনজন ডাক্তার এসে হাজির। …“আপনারা প্লিজ দ্রুত রুমটা খালি করুন”। আমি আর মা রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
ঘড়ির সময় ধরে ঠিক ১৮ মিনিট পর ডাক্তার বের হলেন। আমাকে কাছে এসেই বললেন… “একটু সমস্যা হয়ে গেছে। আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি সিজারিয়ান সেকশন না করতে। কিন্তু সমস্যা হল… বাচ্চার ওজন প্রায় ১০ পাউন্ডের কাছাকাছি হয়ে গেছে, এছাড়াও Breech Position! …এগুলো সমাধান করা গেলেও সবচেয়ে ভয়ের কথা হল বাচ্চার Umbilical Cord ওর ঘাড়ে পেঁচিয়ে আছে। তো সবদিক বিবেচনা করে আমরা সিজার করতে বাধ্য হচ্ছি। এখন আপনার যদি কিছু বলার থাকে, বলতে পারেন।
-“স্যার, বাচ্চা আর বাচ্চার মার জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটাই আপনারা নিবেন বলে আমার বিশ্বাস”।
-থ্যাংকস… বলেই তিনি ভিতরে চলে গেলেন। আমি মূর্তির মত বারান্দার গ্রিলটা ধরে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। মা পিছন থেকে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। মার দিকে তাকিয়ে দেখি তাঁর চোখদুটো অশ্রুসজল। সেই ভিজা চোখেই আমাকে বললেন… “সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা। তোর শুহা ঠিকঠাক মতই তোর কোলে আসবে”।
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম… “ মা… আমি তো শুহাকে নিয়ে কিচ্ছু ভাবি নাই। যদি শুহার জন্য আমার শুভ্রার কিছু হয়ে যায়, আমি কি নিয়ে বাঁচবো?… একবার ভেবে দেখেছো? এই শুহা চলে গেলে আল্লাহ চাইলে তিনি আমাকে নতুন শুহা দিতে পারবেন, কিন্তু শুভ্রা…? মা, এই পৃথিবীতে শুভ্রা শুধু একটাই…”
জানি না, কেন জানি; মাকে জড়িয়ে কান্না করার মত এতো শান্তি পৃথিবীর কোথাও নেই।
মাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে আমি পায়চারি করতে লাগলাম। ইতোমধ্যে বাবা এবং আমার অন্য আত্মীয়রাও হাসপাতালে এসে গেছেন। সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। আমি চুপচাপ সবার কথা শুনতে লাগলাম।
এভাবে ঠিক দেড় ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর ডাক্তার বের হলেন। তার চেহারায় একটা আনন্দের হাসি। দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “Operation’s successful, my boy. They both are well”.
আমি তাকে থ্যাংকস জানিয়ে দৌড়ে রুমে ঢুকেই দেখি এক লাজুক তৃপ্তিময় হাসি শুভ্রার শুভ্রতাকে ছেয়ে আছে। আমি দৌড়ে গিয়ে শুহাকে আমার কোলে তুলে নিলাম। আমার সমস্ত কোল যেন আজ ভরে গেছে। আমার কোল জুড়ে আজ সে… যাতে আমার শুভ্রার সব কষ্টের তৃপ্তি লুকিয়ে আছে।

আমার সেই শুহা আজ ৬ বছরের ছোট্ট একটা ডানাকাটা পরী। সে এবার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে স্ট্যান্ডার্ড-I এ পড়ে। এখন বাসায় ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। আমি বাসায় ফিরে দেখি, আমার খুকুমণিটা ঘুমিয়ে পড়েছে। সবসময়ই ও কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমায় আর আমি গিয়ে দেখি কাঁথাটা তার পায়ে পড়ে থাকে। আমি কাঁথা দিয়ে তার ছোট্ট শরীরটা ঢেকে দেই। একদিন আমি প্রতিদিনকার মতই তাকে কাঁথা দিয়ে মুড়িয়ে দিচ্ছিলাম। ও তখন আমার উপস্থিতি টের পেয়ে আমাকে বলল,
-“বাবা, তোমার সাথে একটা কথা ছিল”।
-“কি কথা মা?”
ও তখন লুতুলুতু গলায় বলল, “Just kiss me here where my dimples shine”
আমি তার কথা শুনে নির্বাক হয়ে যাই। তার দু’গালে যেখানে দুটো কিউট টোল পড়ে সেখানে দুটো চুমু খাই, সাথে কপালটাও ছুঁয়ে দেই। ওকে ঘুম পাড়িয়ে ওর রুম থেকে বের হয়ে বাসার ছাদে যাই। আকাশের দিকে চেয়ে বলি… “Yes and I’m the happiest person in this world and really I’m grateful to You, my Lord.”
তখন আকাশভরা তারার মেলা… কিন্তু চাঁদ আসলে একটাই। আর স্বভাবতই ঐ চাঁদটা হল আমার শুভ্রার প্রতীকী।

মানুষের জীবনটা আসলে একটা রাতের আকাশের মতই… যেখানে সুখগুলো হল ঐ চাঁদ আর মিটিমিটি তারকাগুলোর মিশ্রণ। এই সুখগুলো সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু ঐ তারার ফাঁকে যেই জায়গাগুলো অন্ধকার মনে হয়, সেগুলোতেও সুখ লুকিয়ে থাকে… শুধু দরকার একটু গভীর দৃষ্টি… দরকার একটি টেলিস্কোপ।

লিখেছেনঃ HaSan Kamrul