ছায়াজোছনা

4042
0

ডাক্তার সাহেব বারবার করে বলে দিয়েছেন রোগীর মন ভাল রাখতে হবে। কিছুতেই যেন মনে আঘাত না পায়। হানিফ সাহেব সাধারণ সাদাসিধে মানুষ। জগতে একমাত্র কবিতার ভাষাই তার জানা আছে। মন ভাল করার বিদ্যে তার কখনো শেখা হয়নি। ফুলশয্যার রাতে ভাবিরা নতুন বউয়ের মন ভাল করার অনেক বিদ্যে শিখিয়ে দিয়েছিল। এতদিন পর তার কিছুই আর মনে নেই, থাকলে সুবিধে হত। অবশ্য তিনি সেদিন রাতেও সেই বিদ্যের কিছুই আর নতুন বউয়ের সামনে মনে করতে পারেননি। শুধু অবাক চোখে দেখেছেন তার বিছানার একধারে বসে মেয়েটা অবাক চোখে জানালার বাইরে চাঁদ দেখছে। তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ে গালের ওপরই শুকিয়ে গেছে। জোছনার আলো সেই শুকনো জলে চিকচিক করছে। এটুকুতেই তার মাথার ভেতর সব গুলিয়ে গেল। তিনি কবিতার খাতা নিয়ে বসে পড়লেন টেবিলে। নুতন বউ অবাক চোখে দেখছে মানুষটা এমন একটা রাতেও বউয়ের সাথে একটা কথাও না বলে মাঝরাত পর্যন্ত একমনে টেবিলে ঝুঁকে বসে লিখেই যাচ্ছে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। মাঝেমধ্যে মাথা তুলে তার দিকে একবার আর কখনও জানালার বাইরে আকাশের চাঁদটার দিকে তাকাচ্ছে আবার ঝুঁকে পড়ে লেখা শুরু করছে। অবশেষে শেষরাতে মানুষটা এসে তার পাশে বসল। এসে তার সাথে জীবনের প্রথম কথাই বলল, ‘শোন, তোমাকে একটা কবিতা শোনাই।’ তিনি অবাক হয়ে শুধু মানুষটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কবিতার একটা লাইনও তার কানে ঢুকেনি। তিনি শুধু তাকিয়ে ভাবছিলেন, মানুষটা এত অদ্ভূত কেন!
.
সেই থেকে শুরু, যতটা না সংসার করেছেন মানুষটার সাথে, তারচেয়েও বেশি তার কবিতার সাথে। কতবার রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যেতে চেয়েছেন তবু মানুষটার দিকে তাকিয়ে আর পা বাড়াতে পারেননি। মানুষটা তিনি ছাড়া এক গ্লাস জলও নিয়ে খেতে পারেননা। সংসারের কোন কাজ হয়না তাকে দিয়ে। নিজের কাজগুলোও নিজে মনে করে গুছিয়ে করতে পারেননা। খেতে দিলে খান, নয়তো খাওয়ার কথা মনেই থাকেনা তার। এমনই মানুষটার সাথে আঠার বছর সংসার করে অবশেষে ছুটি নিলেন শামীমা। যাওয়ার সময় মেয়েটার জন্য কোন দুশ্চিন্তা ছিল না তার। জানতেন মানুষটা নিজের খেয়াল না রাখলেও মেয়েটার খেয়াল রাখবে ঠিকই। তবে ওই মানুষটার খেয়াল রাখার আর কেউ রইল না এই আফসোসটুকু নিয়েই যেতে হল তাকে এটাই দুঃখ। শেষ সময়ে জীবনে প্রথমবারের মত মানুষটার কাছে একটা কবিতা শুনতে চেয়েছিল শামীমা। হানিফ সাহেব চোখে জল নিয়ে ভাঙ্গা গলায় কবিতা পরে শুনিয়েছেন, প্রথমবারের মত মন দিয়ে কবিতা শুনেছিল শামীমা, তাকে নিয়ে লেখা কবিতা! মুচকি হাসি ঠোঁটে নিয়ে তাকিয়েছিল শামীমা, মানুষটা ধরা গলায় কবিতা পড়েই যাচ্ছে! কবিতা শেষ করার আগে তার খেয়ালই হল না শামীমা কবিতা শুনতে শুনতে কখন তার কাছ থেকে শেষ ছুটি নিয়ে চলে গেছে শেষ হাসিটুকু ঠোঁটে ধরে।
.
সেই থেকে আজ অবদি মেয়েটাকে আগলে আগলে রেখেছেন হানিফ সাহেব। এই মেয়ে আর তার কবিতা এই দুটো জিনিস ছাড়া আর কিছু নেই তার এই জগতে। মেয়েটার প্রয়োজন মেটাতেই তিনি হিমশিম খেয়েছেন সবসময়। তাই কাউকে হাসানোর বিদ্যা আজ অবধিও শেখা হয়নি তার। তিনি ভেবে পেলেন না এই শেষ সময়ে তার একমাত্র কন্যার মন কি করে ভাল রাখা যায়। মা মরা মেয়েটার ব্রেইনে টিউমার ধরা পড়েছে, লাস্ট স্টেজ। কথাটা মনে পড়তেই চোখ ভিজে যাচ্ছে। কিছুতেই সেটা থামানো যাচ্ছে না। এই চেহারায় তিনি মেয়ের সামনেও যেতে পারছেন না। চোখে পানি নিয়ে গেলে মেয়ের নিশ্চয়ই মন ভালো হবে না। তিনি তেত্রিশতম বার চোখ মুছে মেয়ের কেবিনে ঢুকলেন।
: বাবা…
: হ্যাঁ রে মা।
: অষুধ খেয়েছ?
: ওটা তো আমার জিজ্ঞেস করার কথা।
: প্রশ্ন যেটা করেছি সেটার উত্তর দাও। : খেয়েছি মা।
: অষুধ তো ওই টেবিলের ড্রয়ারে। কি করে খেলে?
: না মানে…
: কবে শুধরাবে তুমি বাবা?
: তুই খেয়েছিস?
: না বাবা। শরীরে শক্তি পাচ্ছি না উঠে অষুধ নেয়ার। এদিকে নার্সটাও আসেনি অনেকক্ষণ। তুমি একটু বকে দেবে নার্সটাকে বাবা? আমার একটুও ভাল লাগেনা ওকে। সবসময় কিভাবে যেন তাকিয়ে থাকে।
: কিভাবে তাকিয়ে থাকে মা?
: এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন আমি একজন মৃত মানুষ!
: এভাবে বলে না মা। আচ্ছা আমি বকে দেব।
: আমি জানি তুমি তা করবে না। তুমি বকা দিতে জানই না বাবা। একবার আমি তোমাকে লুকিয়ে ক্লাস পালিয়ে বেড়াতে গেলাম বান্ধবীদের সাথে। তুমি কিভাবে যেন জানতে পারলে। তুমি সেদিনও আমাকে বকতে পারনি বাবা। শুধু একটা কবিতা লিখেছিলে। কবিতায় তোমার সব অভিমানগুলো ছিল বাবা।
: কি জানি কি লিখেছি ছাইপাশ!
: জানো বাবা, সেদিনের পর আর কোনদিন তোমাকে কোন মিথ্যা বলিনি আমি। খুব কষ্ট পেয়েছিলে তুমি সেদিন, না?
.
কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না হানিফ সাহেব। তার আশেপাশের মানুষগুলো এভাবেই কেন যেন তাকে ঘিরে রাখে অকারণ মায়ায়, তারপর আবার সুযোগ বুঝেই সেই মায়ার টান ছিঁড়েখুঁড়ে পালিয়ে যায় তাকে একা ফেলে রেখে। চোখটা আবার ভিজে উঠছে। চোখের জল সামলাতেই একবার মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন চারপাশে। অদ্ভুত পরিবেশ। জানালা দিয়ে এক চিলতে চাঁদের আলো অন্ধকার ঘরটাকে আলোকিত করে রেখেছে। তার মেয়ের জীবনের মত। যেন অন্ধকার জীবনে আশার এক চিলতে আলো ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে ব্যর্থ পৃথিবীকে। কি অদ্ভুত! এমন পরিস্হিতিতেও তার মাথায় কাব্য ঘুরছে! চাঁদের আলোয় মেয়ের আবছা চেহারাটা খুবই মায়াবতী লাগছে, ঠিক শামীমার মত। মেয়েকে শামীমার মত চলে যেতে দিতে পারেন না তিনি। ঠোঁটের কোণায় অনেক কষ্টে সামান্য একটু হাসি ফুটিয়ে তিনি মেয়ের পাশে গিয়ে বসলেন।
.
: বিনু…
: হুমম : চাঁদটা দেখেছিস?
: হুমম
: ওটা দেখলেই তোর মায়ের কথা মনে পড়ে।
: মা দেখতে কি চাঁদের মত ছিল?
: আরে না, একটু কালোই। তবে গুণমন্তী ছিল।
: তাই… ??
: হুমম। যখন প্রথম সংসার করতে আসে তখন ও রুটি বানাতে জানত না। শেখার পর দেখা গেল তার রুটিগুলো কিছুতেই আর গোল হয় না। কেমন যেন এবড়ো থেবড়ো হয়ে যায়্। একদিন হল কি, কিভাবে যেন একটা রুটি পুরোপুরি গোল হয়ে গেল। তাতে তার কি খুশি! ওই রুটিটা দেখতে ঠিক এই চাঁদটার মতই ছিল।
.
বিনু হাসছে। তার হাসিতে বাবাও হাসছে। দরজার বাইরে মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছে। সে ভেতরে আসতে পারছে না। বাপ-মেয়ের এই হাসির মাঝে মৃত্যুর কোন প্রবেশাধিকার নেই ।।

লিখেছেনঃ অংকনের সাতকাহন