অপূর্ণতার প্রাপ্তি

2479
0
Opurnotar Prapti

সিলভার পাড়ের কালো রঙের সুতি শাড়ি টা পড়ে বেশ কিছুক্ষণ যাবত ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সামনে হাতে কাজল নিয়ে বসে আছি। দোনমন্যতায় ভুগছি আজ কাজল পরবো কি পরবো না এ নিয়ে। আমার কাজল কালো টানা টানা চোখ দুটোই তার মুগ্ধতার একমাত্র কারণ। আর তার মুগ্ধতা আমার দূর্বলতার কারণ। কিন্তু আজ আমি তাকে আর মুগ্ধ করতে চাই না। অভিমান জমে জমে নিকষ কালো মেঘে ঢেকে গেছে সূর্যস্নাত সকালগুলো। তার মুগ্ধতার কাছে যদি সেই অভিমানগুলো হার মেনে যায়! আজ যে আমিও আর দূর্বল হতে চাই না! অবশেষে দু’হাত ভর্তি কালো রঙের কাঁচের চুড়ি, কানে ঝুমকো আর ঠোঁটে শুধু ভেসলিন দিয়ে সাজগোজের ইতি টানলাম। চুলগুলো ছাড়াই রাখলাম।

বাসা থেকে বের হয়ে ঘড়িতে সময় দেখলাম, সকাল ৯.৩০। রিক্সায় উঠে টিএসসি যেতে যেতে অনেকবার কল করলাম প্রহর কে। কিন্তু রিসিভ করলো না। টিএসসি নেমে আবার মোবাইলে সময় দেখলাম, ১০.১৭। এমন তো হওয়ার কথা না। কাল রাতে প্রহর বলেছিলো, বরাবরের মতো আজও সে আগে চলে আসবে। সময় গড়াচ্ছে আর আমার টেনশন বাড়ছে।
আর ধৈর্য্য ধরে থাকতে না পেরে সোজা ধানমন্ডি চলে গেলাম।

প্রহরের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে কলিংবেল প্রেস করলাম। শিহাব ভাই দরজা খুলে দিলেন। শিহাব ভাই কে দেখে আমার মনে পড়লো, প্রহর আর শিহাব ভাই দুজন মিলে এই ফ্ল্যাট টা শেয়ার করে থাকে। এভাবে হুট করে একটা ব্যাচেলর বাসায় চলে আসা ঠিক হয় নি ভেবে মনে মনে ইতস্তত বোধ করলাম।
শিহাব ভাই আমাকে দেখে বেশ অবাক হলেন,

– অদিতি, তুমি এই সময়ে!

– আসলে প্রহর কে ফোনে পাচ্ছিলাম না। ও কি বাসায় আছে?

– হ্যাঁ, এসো ভেতরে এসো।

শিহাব ভাই আমাকে প্রহরের রুমে নিয়ে গেলেন। বিছানার উপর একটা কম্বল গায়ে জড়িয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে প্রহর। প্রহর কে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে আমি শিহাব ভাইয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তে তাকাতেই তিনি বললেন,

– ঘুম থেকে উঠে দেখি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। ভালোই হয়েছে তুমি এসেছো। আমাকে আজ অফিসে যেতেই হবে,জরুরি মিটিং আছে। তুমি কি কিছুক্ষণ থাকতে পারবে?

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম।

শিহাব ভাই অফিসে চলে যাওয়ার পর আমি প্রহরের মাথার কাছে বসে কপালে হাত ছুঁইয়ে দিতেই সে চোখ মেলে আমার দিকে চেয়ে রইলো। মাতাল করা সেই চাহনি। লাল টকটকে চোখ জোড়ায় যেন নেশা লেগে আছে । আমি তাড়াতাড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম।

রান্নাঘরে গিয়ে শাড়ির আঁচল টা কোমরে গুঁজে চুলে হাতখোপা করে স্যুপ রান্না করার সময় খুব করে চাচ্ছিলাম, প্রহর এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরুক।
কিন্তু বেচারা তখন প্রচন্ড জ্বরে কাতরাচ্ছে।

স্যুপ খাওয়ানোর পর একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দিলাম প্রহর কে। এতক্ষণ পর সে কথা বললো,

– কখন এসেছেন?

আমি উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। বাটির পানিতে রুমাল ভিজিয়ে কপালে জলপটি দিতে শুরু করলাম। এর মধ্যে সে আবার প্রশ্ন করলো,

– কথা বলবেন না আমার সাথে?

এবারো আমি এড়িয়ে গেলাম। এক সময় প্রহর ঘুমে তলিয়ে গেল। আমি ওর একটা হাত আমার দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে আমার কোলে রাখলাম। চোখ থেকে দু’এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো আমার চিবুক বেয়ে।

– কেন আমার সাথে এমন করলেন আপনি? ভালবাসার মানে শিখিয়ে হঠাৎ করে দূরে সরে গিয়ে এভাবে খুন করাটা কি খুব দরকার ছিল? গত ১ টা মাস আমার ভেতরে কি তুফান চলেছে, সে খবর কি আপনি রেখেছেন? পারবেন এই একটা মাসের নির্ঘুৃম রাতগুলো, ছটফট করতে করতে পার করা দিনগুলো, অস্থিরতার সময়গুলো, প্রতি সেকেন্ডের দীর্ঘশ্বাসগুলো আমায় ফিরিয়ে দিতে?

নিজের অজান্তেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। অথচ আমার এই কান্না বা অভিযোগ কোনোটাই আজ প্রহর কে স্পর্শ করতে পারছে না। ঘুমন্ত প্রহর কে খুব পবিত্র লাগছে। এই পবিত্রতার কাছে কোনো অভিযোগ টিকে না। তারপরও আমার ক্লান্ত মন আজ কিছুতেই শান্তু হতে চাচ্ছে না।

প্রহরের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় ৬ মাস আগে ফেসবুকের একটা গ্রুপের গেট টুগেদারে। সেই গ্রুপে আমি লিখালিখি করতাম। আমার লেখা গল্পগুলোর প্রতি তার আসক্তি ছিল। গেট টুগেদারে পরিচিত হওয়ার পর থেকে নিয়মিত আমাদের চ্যাটিং আর ভয়েস কলে কথা হত। আমি খুব তাড়াতাড়ি কারো সাথে সহজ হতে পারি না। কিন্তু প্রহরের সরল আন্তরিকতা কে আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারি নি। আমার গাম্ভীর্যতা প্রহর কে আরো কৌতুহলী করে তুলতো। প্রহর কখনোই আমাকে পুরোপুরিভাবে জানতে পারে নি। বলা বাহুল্য, আমিই জানতে দিই নি। একটা মানুষ কে সম্পূর্ণ জেনে গেলে তার প্রতি বিপরীত মানুষটার আর কোনো কৌতুহল কাজ করে না। আমি বাস্তববাদী ছিলাম খুব। কিন্তু প্রহর আমাকে শিখিয়েছিলো, কিভাবে রুঢ় বাস্তবতার মাঝেও এক টুকরো আবেগ কে জিইয়ে রাখতে হয়।

প্রহর খুব সুন্দর আবৃত্তি করতে জানতো। তার আবৃত্তির কণ্ঠস্বর যথেষ্ট সাবলীল। প্রহরের আবৃত্তি শুনে আমার কবিতা লিখতে ইচ্ছে করতো খুব। মুঠোফোনের ওপাশে প্রহরের মনোমুগ্ধকর আবৃত্তি শুনে রাতের পর রাত আমি ঘুমের রাজ্যে ডুব দিয়েছি। তার কথাকলি শুনে কাটতো আমার বিষন্নতার সময়গুলো। আর তার যত্নশীল আচরণে খুঁজে পেতাম আমার ভালোলাগাগুলো। দেখা হলে নির্লজ্জের মত অপলক চেয়ে থাকতো আমার দিকে। মুখে তুলে খাইয়ে দিতো। রিক্সায় উঠে বসলে আমার ওড়না রিক্সার চাকায় প্যাঁচিয়ে যাচ্ছে কিনা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতো। ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাত ধরে পাশাপাশি হাঁটার সময় আমাকে তার বামপাশে নিয়ে আসতো। রাস্তা পার হওয়ার সময় যখন আমার হাত টা শক্ত করে ধরতো, সেই স্পর্শে তখন আমি পরম নির্ভরতা খুঁজে পেতাম।

আমার নিষ্প্রাণ আবেগগুলো ধীরে ধীরে সতেজ হতে লাগলো প্রহরের কল্যাণে। এভাবে একটু একটু করে প্রহর আমাকে নিজের করে নিচ্ছিলো। আমিও তার কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করলাম। কিন্তু এত ভালোলাগা, এত মুগ্ধতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরও আমাদের সম্পর্ক টা “আপনি” থেকে “তুমি” তে আসে নি। “ভালবাসি” কথাটা শুধু মুখ ফুটে প্রকাশ করা হয় নি কারো। তবে হৃদয়ের লেনদেন হয়ে গেছে নিজেদের অজান্তেই। প্রহর নামক ভাইরাসে আক্রান্তকালীন সময়ে আচমকা সে নিজেকে আমার কাছ থেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলো। আমি অনুভব করতে পারছিলাম তার দূরে সরে যাওয়া টা। দূরত্ব ঘুচানোর অনেক চেষ্টাও করেছিলাম। সব স্বাভাবিকতার মধ্যে কিছু কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল জলের মত স্বচ্ছ। আমার একটা মাস কেটে গেছে প্রহরের সুনিপুণ অবহেলায় আর পালটে গেছে জীবনের বাঁক। কাল প্রহরের কাছে দেখা করার আবদার করেছিলাম। আর বলেছিলাম এটাই শেষ অন্যায় আবদার।

ঘুমের ঘোরে প্রহরের বিড়বিড় করা প্রলাপে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম আবার জ্বর আসছে। মুখের কাছে কান পেতে শুনতে পেলাম “আপনি যাবেন না, যাবেন না কোথাও” বলে একনাগাড়ে বিড়বিড় করে চলেছে প্রহর। একটা দীর্ঘশ্বাস আর চাপা অভিমান নিয়ে মনে মনে বললাম, সুস্থ হয়ে গেলে আপনি নিজেই আমাকে দূরে সরিয়ে দিবেন।

জলপটি দিয়ে জ্বর টা কে অনেকটা সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসলাম। প্রহর চোখ মেলে তাকালো। আরেক বাটি স্যুপ রান্না করার জন্য বিছানা ছেড়ে রান্নাঘরে যেতে নিলে আমার ডান হাত টা চেপে ধরলো প্রহর। একটা হ্যাঁচকা টানে আমাকে তার বুকের উপর নিয়ে এলো।

– কাজল ছাড়া তোমাকে অসম্পূর্ণ লাগে। এসো, আমি তোমার চোখে কাজল এঁকে দিচ্ছি।

এটা বলেই আমার দু’চোখের পাতার উপর ঠোঁট ছোঁয়ালো প্রহর।

সামান্য “তুমি” ডাকের মধ্যেও এত বিষাক্ত আফিম মিশানো থাকতে পারে, জ্বরের ঘোরে প্রহর “তুমি” করে না ডাকলে আমি জানতেই পারতাম না। প্রহরের ঠোঁটের স্পর্শে আমি শিউরে উঠলাম। আমাকে তার পাশে শুইয়ে দিয়ে শরীরের অর্ধেক ভার আমার উপর ছেড়ে দিলো। দুই হাত চেপে ধরে আমার ঘাড়ে, গলায় নাক ঘষতে শুরু করলো। এত শক্ত করে হাত চেপে ধরায় কাচের চুড়ির কয়েকটা ভেঙে গেল তখনি। তার কাঁপা কাঁপা ঠোঁট দিয়ে মুহূর্তেই আমার ঠোঁট দুটো দখল করে নিলো। তারপর ক্লান্ত হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার ঘুমে তলিয়ে গেল। আমি প্রহরের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতে চললো। আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। বাসা থেকে আজ কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাড়াতাড়ি ফেরার। শিহাব ভাই কে কল করে বলে দিলাম ছুটি নিয়ে চলে আসার জন্য। কিছুক্ষণ পর শিহাব ভাই চলে এলেন। ভ্যানিটিব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে শিহাব ভাইয়ের হাতে দিয়ে বললাম,

– ওর জ্বর সেরে গেলে এটা ওকে দিয়ে দিবেন।

খামের ভেতর একটা চিঠি ছিল। চিঠি তে শুধু এতটুকু লিখেছিলাম,
“যে সম্পর্ক টা আপনি শেষ করে দিবেন ভেবেও শেষ করতে পারছিলেন না, তা আমি নিজে থেকেই শেষ করে দিলাম আজ। মুক্ত করে দিলাম আপনাকে। আপনি বন্দী হয়েছিলেন নিজের ইচ্ছায় আর মুক্তি পেলেন আমার ইচ্ছায়”।

সেদিন বাসায় এসেই আমাকে পাত্রপক্ষের সামনে বসতে হয়েছিলো। কতটা কষ্ট বুকে চেপে হাসিমুখে আমাকে পুতুলের মত বসে থাকতে হয়েছিলো তা শুধু আমার অন্তর্যামী জানে। তার সাতদিন পরেই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হল। কবুল বলার সময় আমার কণ্ঠনালী স্থির হয়ে আসছিলো। চোখের সামনে ভেসে যাওয়া দৃশ্যপটগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে জীবন্ত আবেগগুলো কে কবর দিয়ে একটানে তিনবার কবুল বলে দিয়েছিলাম। কবুল বলার সাথে সাথে সৃষ্টিকর্তা আমার মধ্যে একেবারে পাথর হয়ে যাওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছিলেন। সেজন্য তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার, ইমো সকল প্রকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। সেল নাম্বার চেঞ্জ করলাম। ফেসবুকে লিখালিখি বাদ দিয়ে ছদ্দনামে বই বের করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ লিখালিখি ছেড়ে দিলে একসময় আমি আমার অস্তিত্বটাই হারিয়ে ফেলবো। তাছাড়া নিজেকে একটা কিছুতে ব্যস্ত রাখা তখন ফরজ ছিল।

যে মানুষটার সাথে সংসার শুরু করেছিলাম সেই মানুষটা স্বামী হিসেবে ঠিকঠাক হলেও প্রেমিক হয়ে উঠতে পারে নি কখনো। সে দায়িত্ববান তবে যত্নশীল নয়। দায়িত্বের বাইরে গিয়ে একদিনের জন্যও সে আমাকে বুঝতে চেষ্টা করে নি। কামুকতার নেশা ভুলে এক মুহূর্তের জন্যেও সে আমাকে ছুঁয়ে দেখে নি। আমার ঘামের গন্ধে না, সে মাতাল হয় দামী ব্রান্ডের পারফিউমের গন্ধে। জৈবিক চাহিদা মেটানোর খাতিরে সে আমার শরীরের কাছাকাছি এলেও, মনের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে নি কখনো। অথচ এই মানুষটা কে যদি একজন ভাল বন্ধু হিসেবে পেতাম আমি তাহলে একটা সময়ে গিয়ে ঠিকই প্রহর নামক যন্ত্রণা থেকে বের হয়ে আসতে পারতাম।

মানিয়ে নিতে নিতে আমিও একসময় মেনে নিতে শুরু করলাম। আমার সংসারে অর্থের অভাব না থাকলেও আন্তরিকতার অভাব ছিল প্রচুর। আর ভালবাসা? সে তো কখনো তৈরি-ই হয় নি। এত অপূর্ণতার মাঝেও আমার চার বছরের যমজ দুই মেয়ে হচ্ছে আমার একমাত্র প্রাপ্তি।

আজ পাঁচ বছর পর আমার ড্রয়িংরুমে প্রহর কে বসে থাকতে দেখে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম আমি। এখনো ঠিক আগের মতোই আছে,শুধু চশমার ফ্রেম টা চেঞ্জ হয়েছে। মুখোমুখি বসে আছি দুজন। কুশলতা বিনিময় না করে সরাসরি প্রশ্নে চলে গেলাম আমি,

– বাসার ঠিকানা কোথায় পেলেন?

প্রহর মুচকি হাসলো,

– লেখিকাদের বাসার ঠিকানা খুঁজে বের করা আজকাল অসম্ভব কিছু না।

থতমত খেয়ে গেলাম আমি,

– লিখালিখি ছেড়ে দিয়েছি অনেক আগেই। এখন আর আমি লেখিকা নই।

প্রহর এবার প্রশস্ত হাসি দিলো,

– সে তো ভার্চুয়াল জগতে লিখালিখি ছেড়ে দিয়েছেন। আপনার প্রত্যেকটা বই আমার কালেকশনে আছে।

ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,

– আমাকে চিনলেন কি করে?

প্রহর ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি,

– আপনার লেখার ধরন আর শব্দচয়নের সাথে আমি খুব ভালভাবে পরিচিত। তাই ছদ্দনাম ব্যবহার করেও আপনি নিজেকে আড়াল করতে পারেন নি।

– এতদিন পর কি মনে করে?

– যে কথাগুলো জানানোর সুযোগ আপনি আমাকে দেন নি, সেগুলো জানাতে এলাম আজ।

– নতুন করে আমি আর কিছু জানতে চাই না।

– কিন্তু আমি যে জানাতে চাই।

– তাতে কি কিছু পরিবর্তন হবে?

– হতেও পারে।

– কি?

– আমার প্রতি আপনার অনুভূতি।

– আমার এখন আর কোন অনুভূতি শক্তি নেই।

– আছে তবে অনুভূতিগুলো হয়তো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

– কি করে জানলেন?

– আমার প্রতি আপনার কোনো অনুভূতি না থাকলে এত বছর পর আমাকে দেখে আপনার হৃদস্পন্দন এত উঠানামা করতো না।

খেয়াল করে দেখলাম সত্যি-ই তাই। মানুষ টা এখনো আমাকে আগের মতোই পড়ে ফেলতে পারে!

– কি খাবেন বলুন। চা না কফি?

– আপাতত এক গ্লাস পানি।

কাজের লোক কে নাস্তা-পানি দিতে বলে আমি চুপ হয়ে গেলাম।

নীরবতা ভেঙে প্রহর কথা শুরু করলো,

– পাঁচ বছর আগে আমি আপনার অনুভূতিগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করতে পারি নি আমার কিছু ব্যর্থতার কারণে।

– ঠিক বুঝলাম না।

– প্রথমত সে সময় আমার কোন চাকরী ছিল না। যদিও এর জন্য আমি আপনার কাছে সময় চেয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু আমার আসল ব্যর্থতা হচ্ছে, আমি কখনোই আপনাকে মাতৃত্বের স্বাদ দিতে পারতাম না।

কথাটা শোনার সাথে সাথে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

এর মধ্যে চা নাস্তা পানি চলে এল। ট্রে থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে প্রহর আবার বলতে লাগলো,

– এ কথাটা আমি যেদিন জানতে পারি, সেদিন থেকেই আমি দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করি। তৎক্ষণাত ব্যাপার টা আপনাকে জানালে আপনি হয়তো সিম্প্যাথি দেখিয়ে থেকে যেতে চাইতেন। কিন্তু একটা সময় গিয়ে ঠিকই ভিতরে ভিতরে অনুতপ্ত হতেন। আমি তা চাই নি। ভেবে দেখুন তো, সারাটা জীবন “মা” ডাক না শুনে কাটিয়ে দিতে পারতেন? নারীজাতির পূর্ণতা তার মাতৃত্বে।

আমার চোখের সামনে আমার মেয়েদের মায়াভরা মুখ দুটো ভেসে উঠলো। প্রহর কে কি উত্তর দিবো বুঝতে পারছি না। তারপরও শুধু এতটুকু জিজ্ঞেস করলাম,

– বিয়ে করেছেন?

– নাহ্। কাউকে অনুতপ্ত হতে দিতে চাই না। উঠি আজ।পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।

চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আবার পেছন ফিরে তাকালো প্রহর,

– আরেকটা কথা, সেদিনের পর থেকে আজ অব্দি আমার আর জ্বর আসে নি। কাচের চুড়ির ভাঙা টুকরোগুলো এখনো সযত্নে রেখে দিয়েছি।

আমি প্রহরের চলে যাওয়ার পথে চেয়ে রইলাম।
মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে বারান্দার দোলনায় গিয়ে বসলাম। ভাবছি, এক জীবনে মানুষ সবকিছু একসাথে পায় না। প্রহর কে পেলে আমার জীবনে হয়তো ভালবাসার কোন কমতি থাকতো না কিন্তু মাতৃত্বের অপূর্ণতা থেকে যেত। আর এখন আমার জীবনে ফুটফুটে দুই মেয়ে আছে কিন্তু প্রহর নেই।

প্রহরের প্রতি আমার অনুভূতিগুলো কখনো ফ্যাকাসে হবে না। আজও সে আমার শিরায় উপশিরায় প্রতিটি রক্তকণিকায় তার উপস্থিতি জানান দিয়ে যায়।

লেখাঃ Nusrat Khan Ani