মায়া

1966
0

গত সপ্তাহে ইরফান এসেছিল তার নতুন বউকে নিয়ে নয়নতারাকে দেখতে! নয়নতারা ফেলফেল চোখে কতক্ষন তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে নিল! ইচ্ছে করলে সে আস্তে আস্তে দুই,একটা কথা বলতে পারে, কিন্তু সেদিন তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়েও দুই একটা শব্দ বের করতে পারলো না!

আজ প্রায় তিন মাস হতে চলল হসপিটালে নয়নতারা! মরন রোগের চিকিৎসা নেই, তবুও ইরফান তার শেষ দায়িত্ব পালন করছে! অবেলায় বিদায় নেওয়া মানুষগুলো তার জীবনের শেষ দিনে বিদায় নেয় কাছের মানুষের চোখের মায়া নিয়ে কিন্তু নয়নতারা বিদায় নিচ্ছে ইরফানের দায়িত্ব হয়ে! শুধুই দায়িত্ব! মায়া আর দায়িত্ব কি বিপরীতমুখী দুটি শব্দ, অথচ যখন এক হয় তখন সম্পর্ক প্রান পায়!ভালোই হয়েছে সে কিছু বলতে পারেনি। বলতে পারলে বলত, আর কয়টা দিনই নাহয় অপেক্ষা কর‍তে ইরফান , আমি সম্পর্কের মিথ্যা মায়া চোখে একে বিদায় হতাম!সবাই বলতো আহারে, মানুষটা এই বয়সে বউ হারালো , আর বাকিটা জীবন যে কি করে কাটে? দলে দলে মানুষ আসতো তোমাকে সান্ত্বনা দিতে, তারা তোমাকে মাথায় হাত রেখে বলতো, যে চলে গেছে তাকে তো ফিরিয়ে আনা যাবেনা, তুই আবার সংসারী হ, নিজের জন্য না হলেও তোর ছেলেটার দিকে চেয়ে আবার বিয়ে কর! তুমি তাদের দেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠতে, পাশের মানুষগুলোও তোমার কষ্টে দুই তিন ফোটা চোখের জল পাঞ্জাবির হাতায় মুছতে মুছতে যাওয়ার সময় বলে যেত, ছেলেটার মনের অবস্থা ভালো না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে বিয়ে করাতে হবে! তুমি ভিতরে ভিতরে খুশীতে আত্নহারা হতে আর তোমার বাইরে চলত শোকের মাতম!

নয়নতারার ৫ বছরের ছেলেটা হসপিটালে নয়নের সাথেই থাকে। নয়ন তার মাকে বারবার বলে মা নিরবকে তুমি বুঝিয়ে শুনয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দাও, আমাকে ছাড়া ওর থাকার অভ্যাস হোক! এইসব কথায় নয়নের মা ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে যেন কেউ তার কলিজাটা ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর তাকে মৃত্যু যন্ত্রণার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে! নয়নের ছেলেটার নাম নিরব হলেও স্বভাবে সে ভিষণ চঞ্চল।সে তার ডাক্তারীর খেলনা সেট বের করে মায়ের চিকিৎসা করে। সে স্টেথোস্কোপটা তার মায়ের বুকে চেপে ধরে বলে, চিন্তা করবেননা আমি ইনজেকশনটা দিয়ে দিচ্ছি আপনি কয়েক দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবেন, আর অষুধ গুলো মিয়ম করে তিনবেলা খাবেন। নয়ন তখন হাসতে হাসতে ছেলেটাকে কেনোলা পরা দুর্বল হাত দিয়ে খানিকক্ষণ তার বুকের মানিককে বুকে চেপে ধরে।যখন নয়নের একটু ভাল লাগে সে তার নিরবের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর আস্তে আস্তে করে বলে, বাবা আমি না থাকলে তুমি একদম কান্নাকাটি করবে না , তুমি তো ব্রেইভ বয়,আর ব্রেইভ বয়েরা কখনও কাঁদেনা বাবা। খুব মন দিয়ে পড়ালেখা করবে, রাতে যদি একা থাকতে ভয় হয় দাদীর সাথে ঘুমাবে, আর নতুন মা কে মামুনি বলে ডাকবে কেমন,এই কয়টা কথা বলতেই নয়নতারা হাপিয়ে উঠে , বড় বড় ধম নেওয়ার চেষ্টা করে। ছোট্ট ছেলেটা অসহায় ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,মামুনি আমার এসব শুনতে ভালো লাগেনা, তোমাকে যে অষুধ দিয়েছি তুম কি সেগুলো খেয়েছ? নয়ন বলে, খেয়েছি তো বাবা। নিরব তখন কতক্ষন নিরব থেকে বলে তুমিই তো আমার মামুনি, তাহলে আমি অই আন্টিকে কেন মামুনি ডাকবো? নয়ন চেষ্টা করে ইনিয়ে বিনিয়ে এটা সেটা ছেলেকে বুঝাতে কিন্তু নয়ন জানে সে চলে গেলে নিরবের জীবন বদলে যাবে, তার এসব উপদেশ কিছুই কাজে আসবে না! নয়নের খুব ইচ্ছে করে ভাগ্যবিধাতার কাছে অভিযোগ করতে আরেকটু সময় কি তাকে দেওয়া যেত না, তার নিরবের জন্য? যেদিন ইরফান আসলো তার নতুন বউকে নিয়ে, যতক্ষন সময় নয়ন তাকিয়ে ছিল সে সরাসরি তাকিয়ে ছিল ইরফানের চোখের দিকে জানতে কোন অপরাধবোধ আছে কিনা সেখানে, নয়ন সেই চোখে যা পেয়েছিল তারপর তার ইচ্ছে হয়নি অনেকটা সময় ধরে সেই নিষ্ঠুর সত্যটা দেখার। মানুষের সব কাজের স্পষ্ট ব্যাখ্যা আর সাফাই থাকে নিজের কাছে , ইরফানও হয়ত কোন সাফাই খুজে নিয়েছিল নিজের পক্ষ করে, তাই হয়ত সেই চোখে আর কোন অপরাধবোধ ছিল না!

বিয়ের পরপরই নয়ন বুঝতো ইরফানের রয়েছে সৌন্দর্যপ্রিতি! সে খুব গর্ব করে বলতো কত সুন্দর সুন্দর মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক ছিল!নয়ন তখন একবুক হতাশা চেপে রেখে বলতো, আমি খুব ভাগ্যবতী আমি তোমাকে পেয়েছি আর তুমি খুব দুর্ভাগা তুমি আমাকে পেয়েছ! যেদিন ইরফান তার বউকে নিয়ে হসপিটালে এল তার পরেরদিনই ইরফানের এক কাছের বন্ধু এসেছিল নয়নকে দেখতে। হয়ত মানুষটার নয়নের প্রতি খুব সহানুভূতি কাজ করেছিল।নয়নের মার সাথে ইরফানের বন্ধু যখন ইরফানের বিয়ের বিস্তারিত বলছিল নয়ন তখন খেয়াল করে তার শেষবেলার দুর্ভাগ্যের কথা শুনছিলো! নয়ন সব শুনছিল মুখে হাসি টেনে, সে তার দুর্ভাগ্যের উপর হাসছিলো! ইরফান যেই মেয়েটাকে বিয়ে করেছে তার নাম সুমি। সে তার স্টাফ রিয়াদের বোন! অফিসে সে তার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিল তখন সে ইরফানের চোখে পরেছিল আসলে চোখে না মনে ধরেছিল! ইরফান অবশ্য তার পছন্দকে মনে মনে রেখেছিল সঠিক সময়ের অপেক্ষায় কিন্তু বিপত্তি বাধলো তখন যখন ত রিয়াদ তার বোনের বিয়ের জন্য ইরফানকে দাওয়াত দিল! ইরফানের মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো, সে সদিন সন্ধ্যায়ই সুমিদের বাসায় চলে গেল, তার বাবা মাকে বোঝাতে চাইলো তারা যেন বিয়েটা ভেঙে দেয়,আর তাকে আরেকটু সময় দেয়, কয়েকমাস পরেই সে সুমিকে বিয়ে করবে! সুমির পরিবার অভাবী ছিল কিন্তু তার চেয়েও বেশী ছিল লোভী! তবে কারো আশায় তারা বিয়ে ভেঙে দিয়ে মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখতে নারাজ! বাধ্য হয়ে তাদেরকে আশ্বস্ত করতে ইরফান সেই রাতেই সুমিকে বিয়ে করে ফেলল!

ইরফান সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিল এই কথাটা নয়নের কানে বারবার বাজতে লাগল , যেন কেউ তার কানে বিষ ঢেলে দিচ্ছে, আর সেটা স্রোতের মত তার ভিতরে গড়িয়ে তার সবটাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে, আর পুড়িয়ে দিচ্ছে তার অস্তিত্বকে এই পৃথিবী থেকে ! নয়ন একবার চেয়েছিল বলতে, আর বইলেননা ভাই, খুব কষ্ট হচ্ছে! আরেকবার মনে হল হোক কষ্ট মনের কষ্ট দিয়ে আজ নাহয় শরীরের কষ্ট কাটাকাটি হয়ে যাক! নয়ন বিরবির করে বলতে লাগল, সঠিক সময়, সঠিক সময়! আমার মৃত্যু ইরফানের জন্য সঠিক সময়! নয়ন হাসতে লাগলো এটা ভেবে হয়ত ভাগ্যবিধাতা চায় বেঁচে থাকতেই সে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করুক আর মৃত্যুটা হোক তার জন্য সহজ আর প্রয়োজন তাই বুঝি শেষবেলায় প্রিয় মানুষের এই নিষ্ঠুরতা!

নয়ন আজ বিদায় নিয়েছে ইরফানের মিথ্যে মায়া, তার মায়ের একবুক যন্ত্রণা আর তার ছোট্ট নিরবের একরাজ্য অসহায়ত্বকে চোখে একে!

লেখাঃ ফারজানা আলম