কানে আযানের শব্দ ভেসে আসছে। বড় বোনের স্বরে। আমি রোযাদার। আমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য আপু এমন করে নকল আযান দিচ্ছে।
শোয়া থেকে চমকে উঠে দৌঁড়ে রান্না ঘরে যাই। ব্যাকুলতা নিয়ে বলি, মা, আপু আসছে বুঝি?
ডুবো তেলে বেসন মাখানো বেগুনের পাতলা ফালি ছাড়তে ছাড়তে শুকনো গলায় মা বলে,
না, এখন তোর আপু আসবে কোত্থেকে?
ও তো শশুর বাড়ি।
আজকে প্রথম রোযা রেখেছি। তাই একটু বেশি খারাপ লাগছে। মাথা কেমন ওলোটপালট হয়ে যাচ্ছে। ছেলে পেলে বাহিরে দুষ্টমি করে মাগরিবের আযান দিচ্ছে। আর সেইটি আমার কাছে বড় বোনের আযান মনে হচ্ছে।
প্রথম যেদিন পুরো রোযা রেখেছিলাম সে দিন তো আমার নাজেহাল অবস্থা। প্রাণ যায় যায়। বিছানায় পেট ঠেকিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছি বিছানায়। আযান দিলেই উঠবো আমি। হঠাৎ শুনি আযানের শব্দ। প্রথমে ভেবেছি, মিথ্যে শুনছি হয়তো। কান খাড়া করলাম। না, এযে সত্যিই আযান হচ্ছে। খুশিতে বাক বাক হয়ে বিছানা থেকে এক দৌঁড়ে মায়ের কাছে। ইফতারি খুঁজছি আমি।
আমার চেহারায় হাসি দেখে মা বলল, কি হয়েছে বাবা?
তোকে এমন খুশি লাগছে কেন?
মা, তুমি ইফতার করছো না কেন, আযান দিচ্ছে তো!
মা একটা বিরক্তি নিয়ে বলল, কোথায় আযান দিচ্ছে, পাগল হয়েছিস নাকি?
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তাহলে কী শুনলাম আমি? রোযা কি এতো কঠিন ভাবেই ক্রিয়া করছে আমার উপর?
মার কাছ থেকে ঘর মুখো হয়ে আসছি। দেখি দরজার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বড় আপু। মুচকি মুচকি হাসছে। বুঝে ফেললাম, এ আর কারোর কাজ নয়, এ আমার বড় আপুরই কাজ। আমাকে বিভ্রান্ত করতে আযান দিয়েছে। তেড়ে গিয়ে খামচানো শুরু করলাম। আমাকে ফিরাতে চেষ্টা করলো। পারলো না। সুযোগ মতো দিয়েছি একটা কামড় বসিয়ে। একেবারে দাঁত বসে গেছে। তাও আমি থামছি না। শেষমেষ আমাকে ফেলে দিয়ে একটা রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে থাকলো।
আমিও দরজার সামনে বসে থাকলাম। পরে অবশ্য মায়ের সমঝোতায় সে দিনের ঝগড়ার নিষ্পত্তি হয়।
রোযার মাস এলে মনে পড়ে সে বড় আপুর কথা। আমাকে একটু একটু করে তিনি রোযা রাখা শিখিয়েছিলে।
একেবারে কচি সময়ে দিনে তিনটে চারটে করে রোযা রাখতে বলেছেন। তখন প্রচন্ড শীত থাকতো। দিনের বেলা খুব জালাতাম আপুকে। ঘুমের আগে বারবার বলতাম। আপুর গলা ধরে, করুন ভাবে আবদার করতাম, আপু, তুমি উঠলে আমাকে তুলিও!
অনেক সময় হাতের সাথে ওড়না বেঁধে রাখতাম।
বিশ্বাস তো নেই। যদি না উঠায়?
মনে করতাম, আপু উঠলে হাতে টান লাগবে। সে টানে আমি উঠে যাবো। কিন্তু কীসের কি, একবার ঘুম আসলে এগুলো কি মনে থাকে?
সেহরির সময়ে যখন আমাকে উঠাতো তখন আর উঠতে চাইতাম না। গুটিশুটি মেরে পড়ে থাকতাম। কম্বলের নিচে। কিন্তু আমার বড় আপু!
তিনি তো আমারই বড় তাই না?
চ্যাংদোলা করে কম্বলের নিচ থেকে টেনে বের করতেন। পুকুরে নিয়ে চোখে পানি মেরে দূরে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। আমি ওড়নাটা নিয়ে মুখ মুছে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
খাবার খেতে শীত করলে প্লেট রেখে আপুর কোলে বসতে চাইতাম। আপু ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে ভাত চিবাতে চিবাতে বলত, না, কোলে বসা যাবে না?
দু হাত জোড় করে আপুকে বলতাম, আপু, প্লিজ, একটু বসি। খুব শীত করছে। তুমি একটু খাইয়ে দাওনা?
জায়গা দিতে চাইতো না আমাকে। আমি জোর করে কোলে গিয়ে বসতাম। তখন আবার এক হাতে জড়িয়ে ধরতো। এক লোকমা নিজের মুখে আরেক লোকমা আমার মুখে দিত।
সকালে উঠে সবাইকে বলতাম, আমি রোযা রেখেছি। আমার সাথি যারা উঠতে পারেনি ওদের কাছে বড়াই করে করে বলতাম। আমি রোযা রেখেছি। আমি রোযদার।
যারা বউ বউ খেলতো। আর ছোট ছোট দোকান নিয়ে বসতো আমরা কয়েক জন ডাকাত সেজে লুট করতাম। আমাকে ধরে গণ ধোলাই দেওয়ার আগে আমি হাত উচিয়ে সবাইকে থামাতাম, গম্ভীর কন্ঠে বলতাম, দাঁড়াও,
তোমরা জানো! তোমরা কাকে মারতে যাচ্ছো?
সমস্বরে বলতো, কাকে?
রোযাদারকে। তোমরা একজন রোযাদারকে মারতে যাচ্ছো।
ছি, লজ্জা হয় না তোমাদের?
নিজেরাতো রোযা রাখই না। যে রেখেছে তাকে আবার সদলবলে মারতে আস!
এ কথাগুলো বলে আমি রেহাই পেতাম যদি না সেখানে লাবনী থাকতো। লাবনী থাকলেই কাম সারা। আমার কথা শেষ হবার আগেই বলতো, তুই তাহলে রোযা রেখে ডাকাতি করতে এলি কেন? এ বলে হামলে পড়তো আমার উপর।
চোর ডাকাতি আর পুলিশ পুলিশ খেলার পরে ঘরে আসতাম। আর তখনই পেটে দিত একটা মোচড়। মরে যাই যাই। মুখে কিছু না দিলে এখনি বিদায়ের ঘন্টা বাজার অবস্থা। পেট ধরে বোনের কাছে যেতাম। রোযা রাখার তীব্র ইচ্ছে সাথে খাবারের তীব্র চাহিদার কথা বলতাম।
আপু আমাকে কানে কানে বলতেন, একটা বুদ্ধি আছে শুনবি?
হু, বলো, যা বলার তাড়াতাড়ি বল।
এরপর আঙ্গুল নেড়ে নেড়ে আমাকে বোঝাতে শুরু করলো, তোর এখন যা ইচ্ছে হয় খা। কোনো তোয়াক্কা করবি না। পেট পুরে খেয়ে রোযার নিয়ত করবি। ক্ষুধা লাগার আগ পর্যন্ত আর এক ফোঁটা জলও মুখে দিবি না। যখন ক্ষুধা লাগবে তখনই কেবল খাবি। তাহলে কী হবে?
আমিও আপুর সাথে বললাম, তাহলে কী হবে?
তাহলে তোর একটা রোযা পুরো হবে। এখন যদি তুই খাবার খাস তাহলে একটা হলো। এভাবে তিনবার খেলে তিনটা। আর চারবার খেলে তোমার চারটা রোযা হবে। অথচ আমাদের কেবল একটা হবে।
সত্যিই তো। খুব ভালো বুদ্ধি!
কি মজা! তোমাদের সারা দিনে হবে একটা। আর আমার হবে তিন চারটে!
হু, তাই। তবে কি জানিস?
তুই এগুলো গুণে রাখবি। যেদিন তোর ত্রিশটা রোযা হয়ে যাবে সেদিন থেকে আর রাখতে হবে না।
আমি বলতাম, তাই?
আপু মাথা নাড়িয়ে বলতো, হু।
আপু যতদিন আমাদের সাথে ছিল আমি আপুর কথার উপরই চলতাম। কয়েক দিনের মধ্যেই ত্রিশটা রোযা পুরো করে ঈদের আনন্দ শুরু করতাম।
পরে বুঝলাম তিনটে চরটে রোযা রাখার তত্ত্ব। আমার নির্যাতন থেকে বাঁচতেই ঐ পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলো। যে দিন থেকে পুরো রোযা রাখা শুরু করলাম সে দিন থেকে মাঝে মাঝেই আপু মাগরিবের আগেই আযান দিয়ে বসতো। আমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য। প্রথম প্রথম বোকা বানাতে পারলেও পরে আর বোকা বানাতে পারে নি অবশ্য। ঠিকই বুঝে ফেলতাম।
দু চার বছর আগের সেই ক্ষণটা এখন আমার মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে বড় আপু আযান দিচ্ছে। মায়ের কাছ থেকে ফিরে এসে রুমের দরজা বন্ধ করলাম। মাগরিবের আযানের আগে আমার চোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি ঝরছে। কেমন অবাধ্য হয়ে গেল আজকের চোখের জল।
সব বড় বোনকে নাকি এরাম চলে যেতে হয়। ছোট ভাইদের কিছু দিন আদর সোহাগ আর ভালোবাসায় ভাসিয়ে নাকি অন্য জায়গায় থাকতে হয়।
সে থাকুক। সবারই তো সংসার করা লাগে।
তারপরও সব বড় বোনদের জিজ্ঞেস করতে আমার বড্ড মনে চায়, এই যে হুটহাট করে আমাদের মনে হয়ে যায় তোমাদের কথা, সংসার চালানোর ফাঁকে অভাগা এ ছোট ভাইদের কথা ও কি কখনো মনে পড়ে তোমাদের?
সে যাই হোক, দুনিয়ার সব বড় বোন ভালো থাকুন। সংসার, স্বামী, ছেলে মেয়ে নিয়ে আপনাদের জীবন ভালো কাটুক। সুখী সমৃদ্ধ হোক আপনাদের পথ চলা। রমজান মাসে আজকে এ কামনাই করছি।
লিখেছেনঃ শাহাদাত রাজু
আসলে বিয়ের পর আপুদের মন সব দিকে থাকে। তারা ভাবে যে ছোট ভাইগুলো তাদের মিস করে না। আমরা ছোট ভাইরা খুব লাজুক ভালোবাসা প্রকাশে। আমার আপুও আমাকে কিছুটা ভুলেই গেছিল বিয়ের শুরুতে, আমারও কষ্ট লাগত, ফোন দিলে বলত পরে দিস।
আমি সহ্য না করতে পেরে একদিন ওর বাড়ি গিয়ে কেঁদে দিছিলাম আর বলছিলাম, “আপু তোমার কি আমায় একটু মনে পড়ে না? আমাকে এইভাবে ভুলে গেলে? আমার কি অপরাধ বলো? আমি যে তোমার সাথে কথা বলে থাকতে পারি না। প্লিজ বলো আমি কি করছি।”
আপু তখন গিলটি ফিল করে নিজেও কেঁদে দিছিল, বলছিল, “আসিফ ভাইয়া, তুই মন খারাপ করিস না। আমি আসলে বুঝতে পারি নাই যে আমার কলিজা আমাকে এতটা মিস করে। তোকে আমি সময় করে দুইবেলা ফোন দিব, তোর সব গল্প শুনব আমি।”
দুলাভাইকেও গিয়ে বলছিলাম আপুকে খুব মিস করি। প্লিজ একটু স্পেস করে দেন না আমার সাথে কথা বলার জন্য, করুণ ভাব নিয়ে। দুলাভাইও বুঝছিল।
এরপর থেকে ৪ বছর হলো, আমাকে প্রতিদিন আপু ফোন দিয়ে খবর নেয়। আমার পিচ্চি ভাগ্নী হওয়ার পর তো আরও মজা। ওকে যখন সামলায় আমাকে ভিডিও কল করে, দুই ভাই বোন গল্পও করি, আবার পিচ্চিটাকেও মন ভরে দেখি।
বোনের শ্বশুরবাড়ির সামনে একটু মাথানত করলে কোন সম্মান যায় না, তারা তখন সমস্যাটা বুঝে। তারপর তারাও কন্সিডার করে। আমার চোখ দেখেই ওদের মায়া করতেছিল। বোনের শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলো রাক্ষসও হয় না।