মার্গারেট হ্যামিলটন: যার প্রোগ্রামিংয়ে সম্ভব হয়েছে চন্দ্রজয়

340
0

পেছন ফিরে তাকালে, আমরা বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ ছিলাম।
অগ্রদূত হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প ছিল না; নতুন করে শেখার সময় ছিল না। 

— মার্গারেট হ্যামিলটন

মানবজাতির অন্যতম বড় অর্জন হিসাবে পরিচিত চাঁদে অবতরণ। কিন্তু এই অর্জন অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়ে যেত যদি না মার্গারেট হ্যামিলটনের মতো মেধাবী সফটওয়্যার প্রোগ্রামার না থাকতো। তার অদূরদর্শিতা আর নিরলস পরিশ্রম শুধু চন্দ্র অভিযানই নয়, বরং সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রকেও প্রসারিত করেছে। 

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

মার্গারেট হ্যামিলটনের জন্ম ১৯৩৬ সালের, ১৭ আগস্ট। তার জন্মস্থান যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা শহরের পাওলিতে। তিনি প্রথম কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রোগ্রামারদের একজন। শুধু তাই নয়, তিনিই প্রথম নারী যিনি নাসাতে যোগ দেন। জন্মের সময় তার নাম ছিল মার্গারেট হেফিল্ড। বিয়ের পর তার নামের পদবি পরিবর্তিত হয়। 

শিক্ষাজীবন 

ইন্ডিয়ানার রিচমন্ডের আর্লহ্যাম কলেজে গণিত এবং দর্শন অধ্যয়ন করার সময়, তিনি জেমস হ্যামিল্টনকে বিয়ে করেন। ১৯৫৮ সালে স্নাতক শেষ করে, তিনি অল্প সময়ের জন্য উচ্চ বিদ্যালয়ে গণিত পড়ান। এরপর তারা বোস্টন চলে আসেন।  

ল্যাবে কর্মরত মার্গারেট Image source: medium.com

মার্গারেট, ব্র্যান্ডেস ইউনিভার্সিটিতে অ্যাবস্ট্রেক্ট গণিত পড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে তার স্বামী হার্ভার্ড ল স্কুলে পড়ার সময়, তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে (এমআইটি) চাকরি নেন। এমআইটিতে তিনি লিব্রাস্কোপ এলজিপি-৩০ এবং পিডিপি-১ কম্পিউটারে, অধ্যাপক এডওয়ার্ড এন লরেঞ্জের সাথে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার সফটওয়্যার তৈরি করেছিলেন। পরে তিনি আবহাওয়াবিদ্যায় স্নাতকোত্তর করেন। 

গবেষণাক্ষেত্র

৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে মার্গারেট এমআইটির লিংকন ল্যাবরেটরিতে যোগ দেন। সেখানে তিনি সেমি-অটোমেটিক গ্রাউন্ড এনভায়রনমেন্ট (SAGE) প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। এটি ছিল প্রথম মার্কিন বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। তিনি বিশেষভাবে শত্রু বিমান শনাক্ত করার একটি প্রোগ্রামের জন্য সফটওয়্যার লিখেছিলেন।   

মার্গারেট পরবর্তীতে এমআইটির ইন্সট্রুমেন্টেশন ল্যাবরেটরিতে (বর্তমানে চার্লস স্টার্ক ড্রপার ল্যাবরেটরি) কাজ করেন। এই ল্যাব নাসার জন্য বৈমানিক প্রযুক্তি প্রদান করে। এখানে তিনি একটি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই দলটিকে অ্যাপোলো মিশনের ইন-ফ্লাইট কমান্ড এবং চন্দ্র মডিউলগুলোর নির্দেশিকা এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার জন্য সফটওয়্যার তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। 

নাসাতে যোগদান

সেই সময়, কোথাও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং শেখানো হতো না। তাই তিনি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার শব্দটি তৈরি করেন। কারণ তিনি অনুভব করেছিলেন যে, তিনি এবং তার দল যে কাজটি করছেন তা অ্যাপোলো মহাকাশযানের অন্যান্য কাজের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।   

নাসাতে সিস্টেম মডিউলে কাজ করার সময় মার্গারেট হ্যামিলটন Image source : brandon-valorisation.com

মার্গারেট নিজে বিশেষভাবে সিস্টেমের ত্রুটি সনাক্ত করতে এবং কম্পিউটার ক্র্যাশের তথ্য পুনরুদ্ধার করার সফটওয়্যারগুলোতে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। অ্যাপোলো ১১ মিশনের (১৯৬৯) সময় এই দুটি উপাদানই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিনকে চাঁদে নিয়ে গিয়েছিল। 

তার প্রায়োরিটি ডিসপ্লে ত্রুটি সনাক্তকরণ এবং পুনরুদ্ধার প্রোগ্রামে, তিনি নতুন হিউম্যান লুপ ধারণা তৈরি করেন। এটি সফটওয়্যারকে (মহাকাশচারীদের সাথে সমান্তরালভাবে চলমান) মহাকাশচারীদের বাধা দিয়ে এবং তাদের স্বাভাবিক ডিসপ্লের সাথে গুরুত্বপূর্ণ ডিসপ্লে প্রতিস্থাপন করে। যাতে অ্যাপোলো মিশনের সময় জরুরি পরিস্থিতিতে তাদের সতর্ক করা যায়।  

তিনি অ্যাপোলো অন-বোর্ড ফ্লাইট সফটওয়্যার থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে সিস্টেম এবং সফটওয়্যারগুলোর জন্য একটি আনুষ্ঠানিক তত্ত্ব তৈরি করেন। এটি মার্গারেটের ইউনিভার্সাল সিস্টেম ল্যাঙ্গুয়েজ (ইউএসএল) এর মূল ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। তিনি এর একীভূত সিস্টেম-টু-সফটওয়্যার ‘ডেভেলপমেন্ট বিফোর দ্য ফ্যাক্টের’ প্রতিরোধমূলক জীবনচক্র এবং এর অটোমেশন ০০১ এর জন্যও কাজ করেন।

অ্যাপোলো-৮ 

এক রাতে মার্গারেটের মেয়ে লরেন, ফ্লাইট সিমুলেটরে ‘নভোচারী’ খেলছিলেন। লরেন ফ্লাইটের মাঝখানে একটি প্রি-লঞ্চ প্রোগ্রাম P01 নির্বাচন করেছিলেন, ফলে ফ্লাইট সিমুলেটরটি বিধ্বস্ত হয়। মার্গারেট এটি দেখে বুঝতে পারেন যে যদি একজন মহাকাশচারী ভুল করে  মিশনের সময় ভুল কমান্ড কোড প্রবেশ করে, তাহলে বিপর্যয় ঘটতে পারে। 

অ্যাপোলো-৮ এ কাজ করার সময় অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে মার্গারেট Image source : odetta.ai/blogs

তিনি এমন একটি সফটওয়্যার ডিজাইনের সুপারিশ করেছিলেন যা এই ধরনের মানবিক ত্রুটিকে ওভার রাইড করে ফ্লাইট সিস্টেমগুলোতে কাজ করবে। কিন্তু তাকে বলা হয় যে এটি কখনই ঘটবে না, কারণ মহাকাশচারীরা প্রশিক্ষিত। 

পরের ফ্লাইটেই মার্গারেটের ধারণা সত্যি প্রমাণ করে, অ্যাপোলো-৮ এর চাঁদ-প্রদক্ষিণে এই ঘটনা ঘটে। মহাকাশচারী জিম লাভেল ভুল কমান্ড কোড প্রবেশ করেন। ফলে সমস্ত নেভিগেশন ডেটা মুছে যায় এবং মহাকাশচারীদের পৃথিবীতে পৌঁছানো ঝুঁকিতে পড়ে যায়।  

মার্গারেট এবং তার দল নয় ঘণ্টা সময় ব্যয় করে একটি সমাধান বের করার চেষ্টা করে। অবশেষে অ্যাপোলো-৮ নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য প্রয়োজনীয় নেভিগেশনাল ডেটা আপলোড করার একটি উপায় খুঁজে পায়। এই ঘটনার পরই মার্গারেট এবং তার দলকে ভবিষ্যতের কোনও সমস্যা প্রতিরোধ করতে সফটওয়্যার প্রতিরক্ষামূলক কোড লেখার অনুমতি দেওয়া হয়। 

অ্যাপোলো-১১

অ্যাপোলো চাঁদে অবতরণ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল যখন চাঁদে অবতরণ মডিউল ‘ইগল’ অবতরণের সময় একটি সতর্কতা অ্যালার্ম পাঠাতে শুরু করেছিল। এর অর্থ হল যে ইগলের কম্পিউটার সিস্টেমগুলো ওভারলোড হয়েছিল। 

মার্গারেট তার লেখা কোডের স্তুপের পাশে Image source : Wikipedia

মার্গারেটের প্রায়োরিটি ডিসপ্লে সিস্টমের জন্যই বাজ অলড্রিন এবং নিল আর্মস্ট্রং বুঝতে পারেন যে, কোথাও কোনো সমস্যা ছিল। ফলে, মিশন কন্ট্রোল হিউস্টন ত্রুটি কোডটি দেখে মিশনটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য যাওয়ার সংকেত দিতে সক্ষম হয়েছিল।

এই সময়ের মধ্যে এমআইটি দল সমস্যার উৎস খুঁজে বের করার কাজ করেছিল। যে রাডার থেকে সমস্যা হচ্ছিল, তারা আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিনকে সেই রাডারটিকে অন্য জায়গায় ঘুরিয়ে এর পাওয়ার সাপ্লাই কেটে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। যাতে করে, মহাকাশচারীদের পৃথিবীতে ফিরে আসার পর্যাপ্ত শক্তি থাকে।

যখন অ্যাপোলো মিশন পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তখন কাগজের বড় শিটে কোড লেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। একজন কি পাঞ্চ অপারেটর কাগজের কার্ডগুলোতে ছিদ্র তৈরি করতো। কোডগুলোকে কি পাঞ্চ কার্ড বলা হতো।  

‘লিটল ওল্ড লেডিস’ যারা তামার তার এবং চৌম্বকীয় বস্তুর তৈরি একটি দীর্ঘ তার বুনতেন। Image source : rocket-women.com

কোডগুলো ঠিক থাকলে, এদের একটি রেথিয়ন (Raytheon) কারখানায় পাঠানো হয়। সেখানে বেশিরভাগ নারী কাজ করতো। তাদের মধ্যে অনেকেই নিউ ইংল্যান্ড টেক্সটাইল মিলের প্রাক্তন কর্মচারী। তামার তার এবং চৌম্বকীয় বস্তুর তৈরি একটি দীর্ঘ তার বুনতেন। যে নারীরা কাজটি করেছিলেন তারা ‘লিটল ওল্ড লেডিস’ নামে পরিচিত ছিল। মার্গারেট পরিচিত ছিল ‘রোপ-মাদার’ হিসাবে।  

উদ্যোক্তা 

প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করার জন্য মার্গারেট ৭০-এর দশকের মাঝামাঝি এমআইটি ত্যাগ করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে হায়ার অর্ডার সফটওয়্যার কোম্পানিসহ প্রতিষ্ঠা এবং ১০ বছর পরে হ্যামিলটন টেকনোলজিস প্রতিষ্ঠা করেন।

স্বীকৃতি 

পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে, মার্গারেটের পদ্ধতিগুলো সফটওয়্যার প্রকৌশলের ক্ষেত্রে বর্তমান দিন পর্যন্ত একটি বড় প্রভাব ফেলেছে। মার্গারেট ১৩০টিরও বেশি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। মার্গারেট নাসার ব্যতিক্রমী স্পেস অ্যাক্ট অ্যাওয়ার্ড (২০০৩) সহ বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তিনি ২০১৭  সালে প্রকাশিত নাসা সেটের ফ্যান ডিজাইন করা লেগো ওমেনও (LEGO Women) ছিলেন। 

প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মার্গারেটকে ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্টাল মেডেল অফ ফ্রিডম প্রদান করেন। Image source : Wikipedia by White House

প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাকে ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্টাল মেডেল অফ ফ্রিডম দেওয়ার সময় বলেছিলেন, 

আমাদের মহাকাশচারীদের কাছে খুব বেশি সময় ছিল না,
তবে সৌভাগ্যক্রমে তাদের মার্গারেট হ্যামিল্টন ছিল। 

কিছু সময় আমাদের অন্য কারো অপেক্ষায় থেকে সমাধানের আশা করা সম্ভব হয় না। নিজ থেকে শিখতে হয়, নিজ থেকেই শুরু করতে হয়। মার্গারেট হ্যামিলটন সেই পথ তৈরি করেছিলেন, যাতে আজকের প্রজন্ম তাতে চলতে পারে। নাসাতে যোগ দেওয়া প্রথম নারী হিসাবে, মহাকাশ গবেষণাক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান তৈরিতেও তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।  

 

 

 

Featured Image: Wikipedia by Daphne Weld Nichols 
References: 

01. Margaret-Hamilton-American-Computer-Scientist. 
02. Profile/Margaret-Hamilton.
03. Amightygirl.com.  
04. Margaret Hamilton Nasa Software Engineer. 
05. Margaret-Hamilton.