পুরানো আমলের বিল্ডিংয়ের সারি, মাঝ দিয়ে লম্বা রাস্তা। এই রাস্তার দুই পাশে বসে হরেক রকমের পণ্যের পসরা। সাথে আছে মজাদার খাবারের দোকান। বিভিন্ন দেশের বণিকদের আগমন ঘটে ব্যবসায়িক কাজে। কাজ আর খাবারের মাঝে চলে গল্পের আদান-প্রদান। গল্পের এই বাজারের শহর পাকিস্তানের পেশোয়ার।
পেশোয়ার, খাইবার পাখতুনখোয়ার বৃহত্তম শহর এবং রাজধানী। পেশোয়ারের ইতিহাস অন্তত ৫৩৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের। এটি পাকিস্তানের এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে একটি।
অবস্থান
খাইবার গিরিপথ এবং সিন্ধু নদীর মধ্যবর্তী পেশোয়ার উপত্যকাটি, বিশ্বের ভাগ্য পরিবর্তনকারী বহু যুদ্ধের একটি প্রাচীন সাক্ষী। উপত্যকার পশ্চিম প্রান্তে সর্বোচ্চ দৃশ্যমান পর্বতের ছায়ায়, ত্রিশ মাইল দূরে পেশোয়ার শহরটি অবস্থিত। শহরটি গিরিপথের কাছে কাবুল নদীর একটি উপনদী বারা নদীর ঠিক পশ্চিমে অবস্থিত। ফুলের শহর হিসাবে পরিচিত এই শহর, তার ঐতিহ্য এবং শিকড়কে গর্বের সাথে ধরে রেখেছে।
ভৌগোলিক ইতিহাস
পেশোয়ার অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাথমিক সংস্কৃত সাহিত্য এবং ধ্রুপদী ঐতিহাসিক স্ট্র্যাবো, আরিয়ান এবং ভূগোলবিদ টলেমির লেখায়। গ্রিকো-ব্যাক্ট্রিয়ান রাজা ইউক্রেটাইডেস (Eucratides) (খ্রিষ্টপূর্ব ২য় শতক) পেশোয়ার উপত্যকাকে অধিভুক্ত করেন।
কনিস্ক, পুরুসাপুরকে তার কুষাণ সাম্রাজ্যের (খ্রিষ্টীয় ১ম শতাব্দী) রাজধানী করেছিলেন। ৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে এখানে মুসলমানদের শাসন শুরু হয় এবং ১৬ শতকের মধ্যে এটি আফগানদের দখলে ছিল, যারা নামমাত্র মুঘলদের উপর নির্ভরশীল ছিল। ১৮৩৪ সালের মধ্যে শিখদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের অংশ হিসাবে এটি ১৮৪৯ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এটি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে ছিল।
জাতিগত পরিচয়
খাইবার পাখতুনখোয়ায় বিভিন্ন উপজাতি, উপ-উপজাতি এবং গোষ্ঠী বাস করে। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব পরিচিতি রয়েছে। তবে পাঠান বা পশতুন নামেই তারা বেশি পরিচিত। বছরের পর বছর বড় শহরগুলো অন্যান্য স্থানের লোকদের মিশ্রণে পরিণত হয়েছে। পাঠানরা যুগে যুগে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের পুরানো জীবনধারা ধরে রেখেছে, যা পখতুনওয়ালি নামে পরিচিত।
পাঠান এখন জাতিগত শব্দ নয়, এটি একটি মর্যাদাকে নির্দেশ করে। এরা সোয়াত ও দিরে বসবাস করে। পাঠান উপজাতিরা প্রধানত ইউরেনীয় বংশোদ্ভূত, অন্যরা সৈয়দ (আরবীয়) এবং তুর্কি বংশোদ্ভূত। এরপর আছে আওয়ানরা, যারা প্রধানত হাজারা এবং পেশোয়ার উপত্যকায় বাস করে। তারা দির, সোয়াত এবং বাজাউরে বাস করে এবং পশতু ভাষায় কথা বলে। দির এবং আসমার সীমান্তে যারা থাকে, তারা তাদের ভারতীয় ভাষা ধরে রাখে।
অন্যান্য উপজাতি হলো জাট, বেশিরভাগ ডেরা ইসমাইল খান, সৈয়দ, তানাওলি, মল্লিয়ার, ধুন্দ, বালুচ, রাজপুতম শেখ, খারাল, মুঘল, কুরেশি, বাগবান, পরচা, কাসাব এবং গাখর। হিন্দু বর্ণের মধ্যে অরোরাসখাত্রী এবং ব্রাহ্মণ গুরুত্বপূর্ণ। জান্দোল এবং ময়দানে জাফির বংশোদ্ভূত অন্যান্য উপজাতিরা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে এবং এখন পাঠান হিসাবে গণ্য।
ইতিহাস
এর পূর্বে অবস্থিত শাহজি-কি ধেরি ঢিবি, উপমহাদেশের বৃহত্তম বৌদ্ধ স্তূপের ধ্বংসাবশেষ হিসাবে বৌদ্ধধর্মের সাথে শহরটির দীর্ঘ সম্পর্ক প্রমাণ করে। একসময় এটি প্রাচীন বৌদ্ধ রাজ্য গান্ধারের রাজধানী ছিল। শহরটি পারাসাওয়ারা এবং পুরুসাপুরা নামে পরিচিত ছিল, একে বেগ্রামও বলা হতো।
এর বর্তমান নাম পেশোয়ার, ভারতের মুঘল সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) দেওয়া। আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার সাথে ট্রানজিট-কারাভান বাণিজ্যের একটি মহান ঐতিহাসিক কেন্দ্র, পেশোয়ার।
খাবার
চাপলি কাবাব হল পেশোয়ারের একটি বিখ্যাত খাবার যা সমগ্র পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কাবাব গরুর মাংস বা ভেড়ার মাংসের কিমা দিয়ে তৈরি করা হয়। তাজা নান রুটি, সালাদ এবং চাটনির সাথে এটি পরিবেশন করা হয়।
এছাড়া পেশোয়ারি কারাহি হলো একটি মশলাদার এবং সুস্বাদু খাবার যা টমেটো, কাঁচা মরিচ, আদা এবং রসুন দিয়ে রান্না করা মটন, মুরগি বা গরুর মাংস দিয়ে তৈরি করা হয়। গরম তন্দুরি নান রুটি বা ভাপানো ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয়।
এছাড়া আছে মসুর ডাল, আলু এবং সুগন্ধি মশলা দিয়ে রান্না করা মাংসের সংমিশ্রণ, নমকিন মান্ডি যা খাস্তা নান রুটির সাথে পরিবেশন করা হয়। আরও আছে কাবুলি পোলাও, জর্দা, খির, পেশোয়ারি ফালুদা ইত্যাদি।
ঐতিহাসিক স্থাপনা
পেশোয়ার রামপুরা গেট, রেটি, কাছেহরি, আসামাই, কাবুলি, বাজৌরি, ডাবগাড়ি, রামদাস, বেরিসকিয়ান, সার্দ চাহ, সিরকি, কোহাটি, ইয়াক্কা থুট, গঞ্জ, লাহোরি, হাস্তনাগরি নামে বিশাল ১৬টি গেটের জন্য পরিচিত ছিল।
পেশোয়ারের ঐতিহাসিক ভবনগুলোর মধ্যে রয়েছে বালা হিসার। এটি দুরানীদের রাষ্ট্রীয় বাসভবনের ধ্বংসাবশেষের উপর শিখদের নির্মিত একটি দুর্গ, যেটি নওশেরার যুদ্ধের পর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আরও আছে একসময়ের বৌদ্ধ মঠ গোর খত্রী এবং পরে হিন্দু মন্দির।
এছাড়া আছে মুঘল স্থাপত্যের একটি অসাধারণ নিদর্শন মহাবত খানের সাদা মসজিদ (১৬৩০), ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল এবং সরকারি হাউস। রয়েছে অনেক পার্ক, চক ইয়াদগার এবং টাউন হল যা সামাজিক ও জনসমাবেশের স্থান।
ব্যবসায়িক কেন্দ্র
রাজধানী হওয়ায় পেশোয়ার বাকি প্রদেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে। সাম্প্রতিক সময়ে শহরটি আধুনিক শহরে রূপান্তরিত হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন বৃদ্ধি এবং একাধিক স্থাপত্য প্রকল্প চলমান থাকায়, শহরটি সফলভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি বিনোদন এবং খাদ্য শিল্পে দেখা গিয়েছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড দ্রুত শহরে জায়গা করে নিচ্ছে।
শিল্পের মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল ও চিনিকল, ফলের ক্যানিং, জুতা, চামড়ার কাজ, মৃৎপাত্র, মোম, তামার তৈরি জিনিস, কার্পেট, কাঠের কাজ এবং আসবাবপত্র। এটি ‘বারা’ বাজারের জন্য বিখ্যাত এবং আশ্চর্যজনক দামে যে বিপুল বৈচিত্র্যের জিনিসপত্র পাওয়া যায় তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।
কিসসাহ খোয়ানি বাজার
শুরুতে উল্লেখ করা গল্পের সেই বাজার প্রাচীন কিসসাহ খোয়ানি বাজার (গল্পকারদের স্থান) নামে পরিচিত। এটি বিদেশি ব্যবসায়ীদের মিলনস্থল। এখানে শুকনো ফল, পশমি পণ্য, কার্পেট, পুস্টিন (ভেড়ার চামড়ার পোশাক), কারাকুল (ভেড়ার চামড়া) ক্যাপ এবং চিত্রালি কাপড়ের ব্যবসা হয়।
যারা প্রায়শই এর বিখ্যাত চাপলি কাবাব এবং ঐতিহ্যবাহী কেহওয়াসহ অন্যান্য সুস্বাদু খাবার উপভোগ করতে এখানে আসতেন। এর মধ্য দিয়ে একে অপরের সংস্কৃতি, খাদ্য, শিল্প এবং সঙ্গীত সম্পর্কে গল্প বিনিময় করতেন।
এই স্থানের একটি ঐতিহাসিক আর মর্মান্তিক ঘটনা রয়েছে। ব্রিটিশ সরকার, খান আবদুল গাফফার খান ওরফে বাচা খানের মতো জাতীয়তাবাদী নেতাদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারেনি। বাচা খান ‘লাল শার্ট আন্দোলন’ নামে একটি অহিংস রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এটি বিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হিসাবে বিবেচিত হয়।
যদিও ব্রিটিশদের কাছে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনও অগ্রহণযোগ্য ছিল। সরকার তাদের প্রদেশে প্রবেশ করতে দিতে অস্বীকার করে ১৪৪ ধারা জারি করে। যার অধীনে কোনও জমায়েতের অনুমতি ছিল না। ঐ ধারা ভঙ্গ করে ১৯৩০ সালের ২৩শে এপ্রিল কিসসা খোয়ানি বাজারে জড়ো হওয়া শত শত নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা হত্যা করে।
ব্রিটিশরা ১৭৯ জনকে হত্যার কথা স্বীকার করলেও, মুসলমানরা বিশেষ করে খিলাফত কমিটির সদস্যরা দাবি করেছে অন্তত ৭০০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। বর্তমানে অল্প কিছু লোক, বেশিরভাগ কর্মী, ব্যবসায়ী, শহরের প্রবীণ এবং স্থানীয় ইতিহাসবিদরা, নিহত বীরদের স্মরণ করার জন্য কিসা খোয়ানির ইয়াগার-ই-শহীদানে (শহীদদের স্মৃতিসৌধ) জড়ো হয়ে তাদের জন্য প্রার্থনা করেন।
পেশোয়ারের রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। ইতিহাস বদলের সাক্ষী হওয়া এই শহর রাজত্ব বদলের কাহিনি ধরে রেখেছে এর স্থাপনায়। পেশোয়ারের প্রাচীনতা এর পুরানো বাড়ির নকশার মতোই স্থায়ী আর অভিজাত। গল্পের বাজারে নিত্য আদান-প্রদান ঘটে ইতিহাস, সংস্কৃতি আর সভ্যতার হাজার বছরের রীতিনীতি। পুরানো দিনের মতো এই যুগেও, পর্যটকরা ভ্রমণের সাথে নিয়ে আসে বাক্সভর্তি স্মৃতি আর ইতিহাসের স্পর্শ।
Featured Image: pail-piran.com References: 01. Peshawar. 02. Peshawar. 03. Races_And_Tribes. 04. Top-10-Mouthwatering-Food-of-Peshawar. 05. Peshawar. 06. Qissa-Khwani-Massacre.