এলভিস মধু: বিশ্বের সবচেয়ে দামি মধু

169
0

বর্তমান সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আগে মানুষ চিনি পছন্দ করতো, এখন তারা চিনির বদলে বেছে নিয়েছে মধুকে। আর এর পেছনে রয়েছে মধুর একাধিক ঔষধি গুণাবলি। মধু একপ্রকার মিষ্টি সাদযুক্ত তরল ঘন পদার্থ। মূলত বিভিন্ন ফুলের নির্যাস থেকে মৌমাছি ও পতঙ্গের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে এটি তৈরি।

তাছাড়া এটি উচ্চ ঔষধি গুণসম্পন্ন ভেষজ তরল, যা সর্দিকাশি থেকে শুরু করে ওজন কমানো সহ আরও অনেকক্ষেত্রেই বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তাই বাজারে এর চাহিদাও দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। তাছাড়া মধু বিশ্বে ব্যবহৃত সবচেয়ে বেশি মিষ্টি উপাদানগুলোর একটি। বিশ্বের প্রায় সবখানেই মধুর দেখা পাওয়া যায় বলে এর চাহিদাও থাকে বছর জুড়ে।

বিশ্বজুড়ে কয়েক রকমের মধুর ব্যবহার প্রচলিত থাকলেও এর দাম নির্ভর করে মধুর গুনগত মান ও এর প্রকারের ওপর। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোন কোন জায়গায় মধু তৈরি হচ্ছে এর উপরও এর দাম নির্ভর করে। তবে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দামি মধু হলো এলভিস। যার বাজার মূল্য প্রতি কেজিতে প্রায় নয় লক্ষ টাকা।

এই মধুর এতো দামের পেছনে মূল কারণ একমাত্র তুরস্কের ব্লাক সি নামক অতি দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলেই এই জাতের মধু পাওয়া যায়, যা সংগ্রহ করা বেশ কষ্টসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ। আবার সে অঞ্চলে গেলেই যে মধুর সন্ধান মিলবে এমন ও নয়, তাই বলতে গেলে এই জাতের মধু প্রায় দুষ্প্রাপ্যই। তাছাড়া অনান্য মধুর থেকে এর স্বাদ এবং গুণগত মানও বেশ আলাদা। তাইতো এলভিসকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে দামী মধু।

বিরল এবং মূল্যবান পণ্য এলভিস, Image Source : Mashed

এলভিস শব্দটি এসেছে প্রাচীন এলভস সংস্কৃতি থেকে। যারা তাদের করুণা, প্রজ্ঞা এবং প্রকৃতির প্রতি অনুরাগে আজও বিশ্বে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।  প্রাচীন এই এলভিস সংস্কৃতির অনেকগুলো দিক আমাদের আজও মুগ্ধ করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো তাদের মধু, যা এলভিস মধু নামে বিশ্বজুড়ে সু-পরিচিত। উৎপত্তিগত দিক বিবেচনায় এলভিস একটি বিরল এবং মূল্যবান পণ্য, যা শুধুমাত্র প্রাচীন, রহস্যময় গহিন বনেই পাওয়া যেতো। এরা মূলত প্রকৃতির সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য বিখ্যাত।

অতি উচ্চ খনিজ সমৃদ্ধ এলভিস মধু সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি  নিবিড়ভাবে সুরক্ষিত একটি প্রক্রিয়া, যা বেশ গোপনীয়তা মেনে করা হয়ে থাকে। তবে যে কেউ চাইলেই এই মধু সংগ্রহ করতে পারে না। কারণ প্রায় ১৪০০ মিটার গভীর গুহা থেকে সংগ্রহ করা হয় পৃথিবীর দামি এই মধু। আর সংগ্রহের জন্য একমাত্র পাঠানো হয় উচ্চ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পর্বত আরোহীদের। এখানকার মৌমাছিগুলো অ্যামব্রোসিয়াল পদার্থ তৈরির জন্য দায়ী।

“সিলভান মৌমাছি” নামে পরিচিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই মৌমাছিগুলো তুরস্ক এবং এর আশেপাশের পাহাড়ে ঘেরা বনাঞ্চলগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। তবে এই মৌমাছির কিছু কিছু প্রজাতি নেপালের হিমালয় অঞ্চলগুলোতেও দেখা যায়। এই মৌমাছিগুলো পাহাড়ের গায়ে জন্মানো রডোডেন্ড্রন নামক গাছের ফুল থেকে এই মধুগুলো সংগ্রহ করে, যার গায়ে থাকে গ্রায়ানোটক্সিন নামের এক বিষাক্ত যৌগ। যেটি হ্যালুসিনেশন ঘটাতেও সক্ষম। অভিজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী তাই এই মধু অধিক মাত্রায় গ্রহণ না করাই ভালো। তবে এদের ঔষধি কার্যকরীতা ব্যাপক সমৃদ্ধ।

স্বাদে ও গুণে অনন্য এলভিস মধু, Image Source : Arad Branding

বৈশিষ্ট্য এবং স্বাদের কথা বিবেচনায় নিলে এলভিস মধু অন্য সকলের চেয়ে আলাদা মূলত তার ব্যতিক্রমী স্বাদ এবং অনান্য জাগতিক গুণাবলীগুলোর জন্য। বর্তমানে বানিজ্যিক ভাবে এলভিস মধুর  উৎপাদন বাড়ায় এর গুণমান রক্ষায় একে শহর থেকে দূরের কোনো গহীন বনাঞ্চলে বা গুহায় আলাদা করে প্রতিপালনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, যেখানে মানুষের চলাচল একদম নেই বললেই চলে।

তাছাড়া এখানকার মৌমাছিগুলো তাদের স্ফটিক-স্বচ্ছ চেহারার জন্যও বিখ্যাত। প্রায়শই এরা একটি ক্ষীণ, ইথারিয়াল আভা দিয়ে ঝিকিমিকি করে আশেপাশে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেয়। এই এলভিস মধুর ঘ্রাণ অনেকটা এর মধুরতা এবং সূক্ষ্ম ফুলের সংমিশ্রণে তৈরি হয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা এটিকে সূর্যালোক এবং চাঁদের আলোর একটি সূক্ষ্ম সংমিশ্রণ হিসেবেও বর্ণনা করেছেন।

এলভিস মধুর রয়েছে অসাধারণ স্বাদ, আর এর বাইরে বিবেচনা করলে, এই এলভিস মধুকে রহস্যময় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। চাকভাঙা এলভিস মধু বাজারে বিক্রিত অনান্য মধুর চেয়ে কতখানি আলাদা তা এর গুনাগুণ পর্যবেক্ষণ না করলে বোঝার কোনো উপায়ই নেই। বিশ্বজোড়া চাহিদার কথা মাথায় রেখে যেহেতু এই মধু বর্তমানে ব্যবসায়িক স্বার্থে চাষ করা হচ্ছে, তাই এর বাজারজাতকরণের আগে বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করে নেয়াটাও জরুরি। আর এই পরীক্ষার কাজটি করা হয় সরাসরি তুরস্কের ফুড ইনস্টিটিউট গুলো থেকে।

তুরস্কের এক দুর্গম গুহায় মধুর অনুসন্ধান চালাচ্ছে আরোহীরা, Image Source : The Daily Meal

তাছাড়া এলভিসদের লোককাহিনীতে, এটি বিশ্বাস করা হয় যে এই মধু খাওয়ার ফলে এটি প্রকৃতির সাথে মানুষের সংযোগ বাড়ায়, পাশাপাশি প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করার এবং বনের আওয়াজ বোঝার ক্ষমতা দেয়। তবে অনেকে এটিও দাবি করেন যে এলভিস জাতের মধু মানুষের মাঝে চিন্তায় স্বচ্ছতা এবং উচ্চতর অন্তর্দৃষ্টিও নিয়ে আসতে সক্ষম। আজ পর্যন্ত তুরস্ক এবং এর আশেপাশের বনাঞ্চলগুলোতে যেখানে এই মধু পাওয়া যায় সবচাইতে বেশি সেখানে অনেক ভ্রমণকারী এবং অভিযাত্রী বিখ্যাত এই মধুর সন্ধানে যাবার চেষ্টা চালিয়েছেন, শুধুমাত্র এর স্বাদে আকৃষ্ঠ হয়ে। কিন্তু বেশিরভাগই ব্যার্থ হয়েছেন।

মনে রাখা জরুরি, এলভিস মধু এলভস সংস্কৃতির ঐতিহ্য এবং তাদের নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠানেও এই মধুর গুরুত্ব অনেক। এলভিস সংস্কৃতির লোকেরা এটিকে প্রায়শই তাদের পবিত্র অনুষ্ঠানগুলোতে ব্যবহার করেন, যেখানে এলভস বন এবং প্রাকৃতিক বিশ্বের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয়। এছাড়াও উক্ত অনুষ্ঠানগুলোয় মধু এলভসদের বন্ধুত্ব এবং মৈত্রীর প্রতীক হিসেবে, শুভেচ্ছা এবং বিশ্বাসের সাথে বিনিময় করা হয়।

এলভিসের সংরক্ষণ এবং বিরলতা এর উৎপাদনের গোপন প্রকৃতির কারণে এবং সীমিত অঞ্চল যেখানে এটি পাওয়া যায়, এলভিস মধু অত্যন্ত বিরল প্রজাতির এবং মূল্যবান। সিলভান মৌমাছি এবং তারা যেখানে বাস করে সেই বন রক্ষা করার জন্য এলভসদের নিজস্ব কঠোর ব্যবস্থা রয়েছে, যা তাদের এই অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসইতা নিশ্চিতকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সহায়তা করে।

এলভসদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে জড়িত এই এলভিস মধু, Image Source : Treehugger

তাছাড়া এলভসদের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য এবং ঐতিহ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এলভিস মধু এলভসদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে জড়িত। এটি তাদের জীবন, পুনর্নবীকরণ এবং বনের মধ্যে তাদের একে অন্যের সাথে স্থায়ী ও বাণিজ্যিক সংযোগ স্থাপনের  প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়।

এর বাইরেও এলভসদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদযাপনে, এই মধু একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র। প্রায়শই এলভসরা নিজেদের জন্ম, বিবাহ এবং এমনকি শেষকৃত্যের মতো উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো স্মরণীয় করে রাখতে উক্ত অনুষ্ঠানগুলোয় এলভিস মধুর ব্যবহার করেন। যার ফলে এই মধুর মাহাত্ম্য এলভসদের কাছে কয়েকগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।