ফ্রেডি মার্কারি: একজন রক-আইকনের জীবন ইতিহাস

122
0

রক-আইকন শব্দটি শোনামাত্র মাথায় কিছু শিল্পীর নাম ঘুরপাক খায়। যেমন-এলভিস প্রিসলি, দ্য বিটলস, জর্জ হ্যারিসন, জেনিস জোপলিন, ফ্রেডি মার্কারিসহ আরো অনেক শিল্পীর নাম। শিল্পীরা স্রোতের ন্যায় আসে এবং আবার চলেও যায়-তাদের মধ্যে কেউ কেউ খ্যাতি অর্জন করে আবার কেউ ভাগ্য পরিবর্তন করে, কিন্তু তাদের মধ্যে সবাইই কিংবদন্তী হতে পারে না। এবং তারা মানুষদের ভাবনার জগতেই সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে কিংবা ভাবতে দেয় তাদের যা তারা ভাবতে চায়। ফ্রেডি মার্কারি ছিলেন সেই ধরনেরই একজন মানুষ।

মঞ্চে সর্বদা চঞ্চল, উদ্যমী এবং বিতর্কিত, আর মঞ্চের বাইরে নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রাখা এবং নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিজের মতোই গোপন করে রাখার জন্যে ফ্রেডি মার্কারির খ্যাতি ছিল প্রচুর। জনসমক্ষে তিনি ঠিক যতটা খোলামেলা ছিলেন, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ঠিক ততটাই নিঃসঙ্গ। তিনি তার পুরোটা জীবন কাটিয়েছেন গোপনে থেকে-এমনকি তিনি মারাও গিয়েছিলেন একদম গোপনে। নিজের অসুস্থতার কথা সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখে, তাদের কাছ থেকেও যারা তার খুবই কাছের ছিল, এমনকি তার মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগ অবধি।

ফ্রেডি মার্কারির জীবন ঠিক যতটা দুঃখজনক ছিল, আবার ঠিক ততটাই বিষ্ময়করও ছিল বটে। তার মৃত্যুর এতগুলো বছর পরও, এখনো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শ্রোতা কিংবা মিউজিশিয়ান তার গান শুনে মুগ্ধ হচ্ছে এবং অনুপ্রাণিত হচ্ছে এবং এখনো মানুষজন আগের মতোই তাকে ঠিক ততটাই আকর্ষণীয় রক-আইকন বলেই মনে করে থাকে। বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন উপায়ে, এখনো মানুষ তাকে স্মরণ করে।

ফ্রেডি মার্কারি তার আসল নাম নয়। তার আসল নাম হচ্ছে- ফররুখ বুলসারা। তার পরিবার পার্সি ছিল এবং জাতিগতভাবে তারা জরাথুস্ট্রীয় ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তাঞ্জানিয়ার জানজিবারের ১৯৪৬ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহন করেন তিনি। ইন্ডিয়ার বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) এক বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হোন এবং সেখানেই পিয়ানো শেখার হাতেখড়ি হয় তার। তার শৈশবের কিছুটা অংশ ঔপনিবেশিক আফ্রিকাতে কেটেছে। ১৯৬৩ সালের দিকে জানজিবার থেকে লন্ডনে চলে যেতে বাধ্য হয়। আর খুব সম্ভবত সেই সময়ের মাঝামাঝিতেই তিনি তার প্রথম ব্যান্ড হেকটিক এর সাথে কাজ করেন।

হেকটিক ব্যান্ডের সদস্যরা। Image Source: scroll.in

লন্ডনে তিনি আইলওয়ার্থ পলিটেকনিকের গ্রাফিক্স ডিজাইনের কোর্সে ভর্তি হন, এবং সেখানেই এক ইন্ডিয়ান শিক্ষকের কাছ থেকে ফ্রেডি ডাকনামটি উপহার পান। তার মা, জের বুলসারা, তাকে বাধ্য করেছিলেন তার বেডরুমে লুকিয়ে রাখা সকল গানের লেখাগুলো বাদ দিয়ে গ্রাফিক্স ডিজাইনের একটা ভালো চাকুরীর জন্য আবেদন করতে। কিন্তু তার মায়ের কথা শুনার পরিবর্তে, তিনি তার প্রতিবেশীদের ত্যক্ত করে ফেললেন গানের সুরে এবং সেখান থেকে চলে গেলেন।

ফ্রেডিরও একটা লজ্জা কিংবা আতংক ছিল আর সেটা হচ্ছে তার গজদন্তের সমস্যা। জন্মের সময় তার উপরের পাটির দাঁতের পেছন দিকে চারটা অতিরিক্ত গজদাঁতেরও জন্ম হয়েছিল। এবং বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সেই গজদন্তগুলোরও বিকাশ হয়েছিল। ফলে, মুখ খুলে কথা বলতে কিংবা বড় করে হাসি দিতে তার এক ধরনের লজ্জাবোধ কাজ করতো। এমনকি তার সহপাঠিরা তাকে ‘বাকি’ নামেও ডাকতো।

সেই ছোট বেলার বিভ্রান্তিকর ব্যাপারটাই ফ্রেডির মধ্যে রয়ে গিয়েছিলে এমনকি সে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যাওয়ার পরও। প্রায় সময়ই তাকে হাসার সময় এক হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে দেখা যেত। তার ভীতিটা এতটাই প্রবল ছিল যে তিনি কখনো এটার চিকিৎসা করাননি কিংবা করাতে চাননি কেননা যদি তাতে তার কন্ঠস্বরের কোন ক্ষতি হয়ে যায়।

লন্ডনেই একাধিক ব্যান্ডের ছেলেদের সাথে তার পরিচয় হয়। এমনকি পরবর্তীতে একই ব্যান্ডের সদস্য ড্রামার রজার টেইলর এবং গিটারিস্ট ব্রায়ান মে-এর সাথেও পরিচয় হয় তখনই। ঐ সময়টাতেই আইবেক্স নামে একটা ব্যান্ডের লিড ভোকাল হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেন। টেইলর এবং মে-এর সাথে যোগদানের পূর্বে আরো কিছু ব্যান্ডে কাজ করেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে বেইজিস্ট জন ডিকনের সাথে পরিচয় হওয়ার মধ্য দিয়ে কুইন ব্যান্ডের যাত্রা শুরু হয়।

কুইন ব্যান্ডের সদস্যরা। Image Source: brittanica.com

প্রথম দুটো এলবাম জাতীয় পর্যায়ের খ্যাতি এনে দিলেও বিশেষ করে শীর হার্ট এটাক (১৯৭৪) এবং অ্যা নাইট এট দ্য অপেরা (১৯৭৫) কুইন ব্যান্ডকে জগতজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। মিউজিকের ক্ষেত্রে হার্ড রক এবং গ্লাম রকের ফিউশন খ্যাত মার্কারির বোহেমিয়ান র‍্যাপসোডি গানটি মার্কারিকে একজন রক আইকনে পরিণত করে। বোহেমিয়ান র‍্যাপসোডি মূলত সাত-মিনিটের একটা রক অপেরাটা। অপেরাটা হচ্ছে এক ধরনের ক্ষুদ্র গীতিনাট্য। নিজের কন্ঠস্বরের ওভারডাব করে, চার-অক্টেভের ভোকাল রেঞ্জে এমন এক সৃষ্টি তৈরী করলেন যা আজো অবধি মানুষদেরকে ভাবাতে বাধ্য করে।

একজন গায়ক এবং গীতিকারের প্রতিভা ছাড়াও, মার্কারির মঞ্চ মাতানোর মতো দক্ষতা ছিল। তিনি খুব ভালো করেই জানতেন কীভাবে শ্রোতাদেরকে বিনোদন দেয়া যায় এবং কীভাবে তাদের সাথে মিশে যাওয়া যায়। তিনি কষ্টিউম ব্যবহার করতেন- বিশেষ করে স্কিনটাইট স্প্যানডেক্স এর মতো কাপড়- এবং স্টেজের চারপাশে ঘুরে ঘুরে, দর্শকদের সাথে আনন্দে মজে যেতেন। আর তাছাড়া, মার্কারি অন্য বিভিন্ন ব্যান্ডের এলবামের প্রচ্ছদের শিল্প নির্দেশনার কাজও করতেন মার্কারি।

৭০ দশকের শেষের দিকে এবং ৮০ এর দশকের শুরুর দিক থেকে কুইনের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। নিউজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড (১৯৭৮) এলবামের উই আর দ্য চ্যাম্পিয়ন গানটি আমেরিকা এবং ব্রিটেনের টপ লিস্টে ছিল বেশ কয়েক সপ্তাহ। এর সাথে আরেকটা গান ছিল উই উইল রক ইউ- যা সে সময় থেকে এমনকি এখনো অবধি বড়সড় কোন ক্রীড়া অনুষ্ঠানে ক্রীড়া সংগীতের ন্যায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সবসময় নিত্যনতুন চিন্তাধার এবং নতুন নতুন শব্দের প্রয়োগ, ১৯৮০ এর দশকে অ্যানাদার ওয়ান বাইটস দ্য ডাস্ট গানের মধ্যে দিয়ে কুইন ডিস্কো-ফ্লেভারের জগতেও তাদের পদচিহ্ন এঁকে রেখে গিয়েছে। সে বছরই দ্য গেম এলবামের ক্রেজি লিটল থিং কলড লাভ গানটাতে কুইন ব্যান্ডের সবাই তাদের রক-এবিলিটি এবং নিজেদের জাত চিনিয়েছিলেন যা লিখেছিলেন মার্কারি নিজে।

বোহেমিয়ান র‍্যাপসোডির প্রচ্ছদ। Image Source: imdb.com

মঞ্চের বাইরের ব্যক্তিগত জীবনে ফ্রেডি একজন উভকামী ছিলেন, কিন্তু তার সকল সম্পর্কেরই গোপনীয়তা বজায় রাখতেন। তিনি খুব ব্যয়বহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তার পছন্দের মধ্যে সবচাইতে বেশী যা প্রাধান্য পেত তা হচ্ছে শ্যাম্পেইন এবং বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা পেইন্টিংস, একবার চীনে একটি হাতে-আঁকা পেইন্টিংসের জন্যে তিনি চার হাজার মার্কিন ডলারও খরচ করেছিলেন।

১৯৮৯ সালের দিকে, ফ্রেডি তার সাধারণ জীবনযাপন থেকেও নিজেও গুটিয়ে ফেলে, কুইনের পরবর্তী এলবামের প্রচার-প্রচারনার কাজও এবং বিভিন্ন ট্যুরের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দেন, জনমতে ফ্রেডির স্বাস্থ্যের অবনতির গুজব রটে যায়। কিন্তু ফ্রেডি মার্কারি কখনোই কারো সহমর্মিতা কিংবা দয়া নিয়ে বাঁচতে চাননি। তাই নিজের এইডস ধরার পরপরই কাউকে কিছু না জানিয়েই নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন। এমনকি তিনি তার বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে পরিবারের কাছ থেকেও এই অপ্রিয় সত্যটি লুকিয়ে রেখেছিলেন।

তারপর ১৯৯১ সালের ২৩ নভেম্বর ফ্রেডি এক বিবৃতিতে প্রকাশ করে,

আমি কিছুদিন আগে এইচআইভি-পজিটিভ এর পরীক্ষা করিয়েছিলাম এবং বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আমি এইডস আক্রান্ত। আমি এই কথা কাউকে জানাইনি এমনকি আমার কাছে মানুষদেরকেও না। কেননা আমার মনে হয়েছে এই কথা না জানিয়ে আমি আমার আশেপাশের আরো হাজারটা মানুষকে রক্ষা করেছি। অযথা বিভ্রান্তি কিংবা সহমর্মিতা কোনটাই আমি চাইনি। যাইহোক, এখন সময় এসেছে পুরো বিশ্বজুড়ে আমার বন্ধুবান্ধব এবং ভক্তদের এ সত্যিটা জানানোর এবং আমি আশা করছি আমার ডাক্তারের সাথে আমার সকল ভক্ত এবং বন্ধুবান্ধব আমার পাশেই থাকবেন যাতে এই ভয়ানক রোগটার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি।

এই বিবৃতির দেয়ার ঠিক পরের দিনই লন্ডনের ম্যানশনে এইডস-সম্পর্কিত ব্রোঞ্চিয়াল নিউমোনিয়ার ফ্রেডি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মাত্র ৪৫ বছর বয়সে।

১৯৯২ সালের এপ্রিলে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে একটা কনসার্টের আয়োজন করা হয় যার নাম দেয়া হয়, ট্রিবিউট টু ফ্রেডি মার্কারি: কনসার্ট এইডস অ্যাওয়ারনেস, যেখানে বিশ্বমাতানো ডেফ লেপার্ড থেকে এল্টন জন সবাই উপস্থিত ছিলেন এবং গান পরিবেশন করেন শুধুমাত্র এই রক-আইকনের স্মরনে। ২০০১ সালে, আমেরিকান মিউজিক ইতিহাসে অবদান রাখার জন্যে সে দেশ থেকে মার্কারি এবং তার ব্যান্ডের অন্যান্য সদস্যদের রক এন্ড রোল হল অফ ফেম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

এইডসে আক্রান্ত হওয়া মৃত্যুবরণ করা সেলিব্রেটিদের মধ্যে প্রথম ছিলেন ফ্রেডি মার্কারি। ফ্রেডি হয়তো এই রোগের বিরুদ্ধে একাই লড়ে গেছেন গোপনে, কিন্তু তার স্মরনে এবং তার লিগেসি পুরো বিশ্বের মানুষকে এই রোগের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে লড়াই করতে শিখিয়েছে। এটাই হয়তো বোহেমিয়ান রেপসোডির উজ্জ্বল দ্বীপ্তির প্রতিফলন।

 

 

Feature Image:  Suzanne Sines Paintings/Pixels  
References:

01. Freddie Mercury. 
02. Who was the real Freddie Mercury.