১৯৭০ দশকের গোড়ার কথা। জাপানে এক দম্পতি হিসায়ামার দিকে যাচ্ছিল। মিয়াওয়াকা থেকে সেখানে যেতে তাদের পাহাড়ের উপর একটি সরু রাস্তা পার হতে হয়। ইনুনাকি টানেলের ঠিক আগে গাড়িটি একটি বিকট শব্দ করে বন্ধ হয়ে যায়। কোনো উপায় না দেখে তারা সাহায্যের জন্য জঙ্গলের দিকে যেতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর, তারা হাতে লেখা একটি সাইন দেখতে পায়। তাতে লেখা ছিল,
জাপানের সংবিধান এই সীমানার বাইরে প্রযোজ্য নয়।
প্রথমে ভয় পেলেও আর কোনো পথ না পেয়ে তারা এগিয়ে যায়। কয়েকশ মিটার এগিয়ে তারা একটি ছোট গ্রামে প্রবেশ করে। এমন জায়গা তারা আগে কখনও দেখেনি। দেখে মনে হচ্ছিল স্থানটি পরিত্যক্ত এবং জীর্ণ, সাথে প্রতিটা ঘরে ঝুলে রয়েছে অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা। কোনো মানুষ বা পশুপাখির শব্দও নেই। একদম মৃত্যুর মতো নীরবতা।
মুহূর্তের মধ্যেই এক ব্যক্তি তাদের সামনে উপস্থিত হন। কিছু বোঝার আগেই সেই ব্যক্তি যুবকটিকে হত্যা করেন। মেয়েটি পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বৃদ্ধ তাকে শক্ত করে ধরে রাস্তায় ফেলে দেয়। সে মাথা ঘুরিয়ে সবচেয়ে কাছের বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, প্রতিটি বাড়ির সবাই মৃত।
সেই দম্পতির আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তাদের গাড়িটি এখনও সেখানে অপেক্ষা করছে। এই গল্পটি জাপানের অনেক কিংবদন্তির মধ্যে বিখ্যাত একটি। গল্পের সেই ব্যক্তি ছিল একজন কৃষক যে একদিন বিনা কারণে সবার উপর আক্রমণ শুরু করে। গ্রামের সবাইকে মেরে ফেলার পর সে এখনও নতুনদের জন্য অপেক্ষা করছে।
ইনুনাকি টানেলের অবস্থান
টানেলটি ইনুনাকি জলাধারের কাছে, ফুকুওকা প্রিফেকচারের মিয়াওয়াকা শহরে, নাগাসাকি থেকে প্রায় একশ মাইল উত্তরে একটি পাহাড়ের মধ্য দিয়ে দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত। টানেলটি বক্র এবং ১০০ মিটারেরও কম লম্বা।
ইতিহাস
দেশের পশ্চিমাঞ্চলে ইনুনাকি পর্বত অঞ্চলে লুকানো, ইনুনাকি টানেল ১৯৪৯ সালে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। দুই দশক পর, ১৯৭৪ এবং ১৯৭৫ সালের মধ্যে কাছাকাছি একটি নতুন টানেল নির্মিত হয়। পুরানো টানেলটি অব্যবহৃত হয়ে সংরক্ষণের অভাবে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। কিংবদন্তি আছে যে, টানেলটি একবার জাপানি সামরিক বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জৈবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের পরীক্ষার স্থল হিসাবে ব্যবহার করেছিল।
আজ ইনুনাকি টানেল বা জাপানি ভাষায় ‘হাউলিং ডগ টানেল’, জাপানের সবচেয়ে ভুতুড়ে জায়গাগুলোর মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। এর নামের সাথে যুক্ত রয়েছে আরেকটি কিংবদন্তি। এক ব্যক্তি তার কুকুরের চিৎকার থামাতে কুকুরটিকে হত্যা করে। এর কিছুক্ষণ পর, সেই ব্যক্তি এবং তার পুরো পরিবারকে হত্যা করা হয়। কুকুরটি শুধু তার মালিককে সতর্ক করছিল।
অনেকেই জানিয়েছেন প্রায়ই তারা টানেলের ভেতর থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ এবং ভয়ংকর চিৎকারের শব্দ শুনেছেন। বর্তমানে, বড় কংক্রিটের ইট দিয়ে এর প্রবেশপথ আটকে দেওয়া হলেও, দুঃসাহসীরা সহজেই প্রবেশ করতে পারে।
উমেয়ামা কাউচি হত্যাকাণ্ড
টানেলটি নিয়ে বিভিন্ন গল্পের কারণ খুব সম্ভবত একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড, যা আসলেই ইনুনাকি টানেলে ঘটেছিল। টানেলটি দূরবর্তী এবং খুব কম ট্রাফিক হওয়ায়, এটি ছিল অপরাধচক্রসহ বিভিন্ন গ্যাংদের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।
১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরের এক বিকেলে, কিশোরদের একটি দল ২০ বছরের উমেয়ামা কাউচিকে অপহরণ করে এবং নির্যাতন করে টানেলের গভীরে জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়। তবে সমস্ত অপরাধীকেই পরে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং ১৯৯১ সালে তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
কিংবদন্তি গল্প
স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে, টানেল নির্মাণের সময় দুর্ঘটনায় অনেক শ্রমিক মারা যায়। তাদের মৃতদেহ এর দেয়ালের মধ্যে সমাহিত করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তাদের অতৃপ্ত আত্মা আজ অবধি এলাকাটিকে তাড়া করছে বলে মনে করা হয়। ২০০০ সালে, একটি মৃতদেহ নিকটবর্তী বাঁধে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত তার পরিচয় পাওয়া যায়নি।
ইনুনাকি গ্রাম
ইনুনাকি গ্রামের মূল রহস্য হলো এর অস্তিত্ব ছিল কি না? ১৯৯০ এর দশক থেকে জাপানে এবং অনলাইনে এর গুজব অব্যাহত রয়েছে। ধারণা করা হয়, গ্রামটি জাপানের নাগাসাকি থেকে প্রায় একশ মাইল উত্তরে ফুকুওকা প্রিফেকচারের ইনুনাকি পাহাড়ের আশেপাশে কোথাও অবস্থিত। এই পরিত্যক্ত গ্রামটিতে শুধু ইনুনাকি টানেলের মাধ্যমেই প্রবেশ করা যায়।
যারা গ্রামে প্রবেশ করে তাদের সকলেরই নৃশংস মৃত্যু হয়। এই কাহিনির মাঝেও হাতে লেখা সাইনের উল্লেখ আছে। যার অর্থ, এখানে যারাই প্রবেশ করে তাদের প্রত্যেকেরই বাস্তব বা অতিপ্রাকৃত ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে হবে যা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
কিংবদন্তি বিভিন্ন কাহিনি
বলা হয়, ইনুনাকি গ্রামটি প্রাথমিক এডো যুগে ছিল। নির্যাতিত এবং দুর্ব্যবহারের শিকার কৃষকরা, সমাজের সাথে সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে নির্বাসনে থাকতে এই স্থানটি বেছে নেয়। আবার কেউ বলে, ইনুনাকি গ্রাম একসময় কুষ্ঠরোগীদের উপনিবেশ ছিল।
গ্রামটিতে মরণব্যাধি ছড়িয়ে পড়লে, কর্তৃপক্ষ কাউকে গ্রামে প্রবেশ বা বের হতে নিষেধ করে এর সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সেখানে সবাই মারা যায় বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। শহরের বিচ্ছিন্ন অবস্থা ইনব্রিডিংকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যে তারা সাধারণ মানুষের আচরণ পরিত্যাগ করেছিল।
আরেকটি কিংবদন্তি এখনও আছে। যখন ইনুনাকি বাঁধটি তৈরি করা হয়, তখন স্থানীয় এনার্জি কোম্পানির অসাধু এজেন্টরা, সে এলাকার যারা তাদের জমি বিক্রি করতে চায় না তাদের ঘরগুলোতে ব্যারিকেড দিয়েছিল। বাঁধ তৈরি হয়ে গেলে, তারা নিজ বাড়িতেই ডুবে মারা যায়। এবং এখন তাদের আত্মা এই এলাকাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। একইসাথে, বাঁধের ঠিক দক্ষিণের ব্রিজটি আত্মহত্যার জায়গা হিসাবে পরিচিত।
অন্য একটি কিংবদন্তি অনুসারে, গ্রামবাসীরা গ্রামে প্রবেশকারী যে কাউকে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত। নরখাদক সম্পর্কে গল্পগুলো এই কিংবদন্তির সাথে যুক্ত। আর তাই যে কেউ ইনুনাকি গ্রামে যায় সে কখনো জীবিত বের হয় না। তবে এই আখ্যানগুলোর কোনটিই নিশ্চিত নয়। সবই গল্প যা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে।
তবে সত্য কী?
এক সময় ইনুনাকি উপত্যকায় ইনুনাকি নামে একটি সত্যিকারের গ্রাম ছিল। এটি ইডো সময়কালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ১৬৯১ থেকে ১৮৮৯ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এটি সিরামিক পণ্য এবং ইস্পাত উৎপাদনের জন্য পরিচিত ছিল। পরে, কয়লা খনন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৬৫ সালে ইনুনাকি-গোবেককান নামে একটি দুর্গ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার ধ্বংসাবশেষ আজও আছে।
১৯৭০ সালে ইনুনাকি বাঁধ তৈরি হলে শহরটি পরিত্যক্ত হয় এবং জনসংখ্যা পার্শ্ববর্তী ওয়াকিটা এলাকায় চলে যায়। তারপরে এটি কাছাকাছি ইয়োশিকাওয়া গ্রামের সাথে একীভূত হয়, যা পরবর্তীতে বছরের পর বছর ধরে অন্যান্য এলাকার সাথে মিশে যায়। ইনুনাকি গ্রামটি এখন মিয়াওয়াকা শহরে অবস্থিত। উপরে বর্ণিত ভূতের শহরের সাথে এই গ্রামের কোন সম্পর্ক নেই।
গুজবের উৎস
সুতরাং, যদি টানেল সম্পর্কে সত্যিই ভীতিকর কিছু না থাকে, তবে এই গল্পগুলো কোথা থেকে আসছে? ইনুনাকি গ্রামের গল্পটি ১৯৯৯ সালে নিপ্পন টিভিতে একটি বেনামি চিঠি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। চিঠির লেখক পুরানো ইনুনাকি টানেলের আশেপাশে একটি ছোট পথের কথা বলেছে। তারপর তিনি ‘জাপানি সংবিধান এই সময়ের আগে কার্যকর নয়’ লেখাসহ খুন হওয়া দম্পতি এবং হিংস্র গ্রামবাসীর বর্ণনা দেন। ১৯৮৮ সালে কোইচি উমেয়ামার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ইনুনাকি পর্বত এবং টানেল প্রথম তার অলৌকিক কার্যকলাপের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
তদন্ত
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফুকুওকা ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন সাংবাদিকদের একটি ছোট দল সেখানে পাঠিয়েছিল। দলটি টানেলের ভেতর থেকে অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেয়েছিল। টানেল খোলার সময় তাপমাত্রা ১২° সেন্টিগ্রেড থেকে ৯-এ নেমে যায়। যদিও এটি স্থিতিশীল মাটির তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। গুহার বাইরে থেকে ভেতরে বাতাসের তাপমাত্রার পার্থক্য কোনোভাবেই অসাধারণ কিছু নয়। তারা আসলে কিছুই খুঁজে পায়নি।
বর্তমান অবস্থা
এই টানেল এবং গ্রামের কিংবদন্তি তাকাশি শিমিজুর ২০২০ এর চলচ্চিত্র ‘হাউলিং ভিলেজ (犬鳴村)’- এর অনুপ্রেরণা ছিল। ছবিটির সাথে, ইনুনাকি টানেল নামে একটি হরর গেম নভেম্বর ২০১৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল। হাউলিং ভিলেজ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর থেকে ইনুনাকি টানেল জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ফিল্মের আগে, কথিত ভুতুড়ে জায়গাটি তদন্ত করতে প্রচুর লোক এসেছিলেন। কিন্তু ২০২০ সালের পর মহামারি সত্ত্বেও, এখানে উপচে পড়া ভিড় হয়েছে।
সাইটটি এখন আবর্জনা, গ্রাফিতি, পার্টি এবং মদ্যপান থেকে সমস্ত ধরনের আবর্জনায় পূর্ণ। এই অঞ্চলের বসবাসকারী লোকেরা টানেলের কাছে যেতেও ভয় পায়। তবে তা অলৌকিক কার্যকলাপের কারণে নয়, বরং বিভিন্ন অপরাধচক্রের আনাগোনার জন্য।
মিয়াওয়াকার আশেপাশের পুরো এলাকাটিকে ভুতুড়ে এলাকা হিসেবে গণ্য করা হয়। এর ঘন অরণ্য এবং কঠিন ভূখণ্ড এটিকে একটি কঠিন অঞ্চলে পরিণত করেছে। বাড়িঘর এবং মানুষের অনুপস্থিতি পুরো এলাকাটিকে রহস্যময় করে তোলে। তার সাথে প্রচলিত মিথ এবং গল্পগুলো এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
তবে, প্রতিটি গল্পেরই ভিন্ন সংস্করণ পাওয়া যায়। এটি নির্ভর করে কে গল্পটি বলছেন তার উপর। তাছাড়া, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর গাছপালা জরিপ করতে এখানে আসে। বয় স্কাউটরাও ঘন ঘন আসে। সমস্ত চিকুহো জুড়ে, প্রকৃতিপ্রেমীরা পর্বতারোহণ এবং মাছ ধরতে আসে। সুতরাং, আসলেই যদি কোনো অলৌকিক কিছু থাকতো বা সেই কল্পনার গ্রাম থাকতো, তবে কেউ না কেউ তা খুঁজে পেত। আর তাই, এটি অমীমাংসিত রহস্য অথবা গল্পই হয়ে রয়েছে।
Featured Image: Wikipedia by Pontafon References: 01. 7-Terrifying-Japanese-Urban-Legends. 02. Old-Inunaki-Tunnel. 03. Inunaki-Village. 04. Is-Inunaki-Village-Real.