১৭৮৩ সালের এক গ্রীষ্মকাল, আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহর। সময়টা খুব সুখকর নয় আমেরিকার ইতিহাসে। বিপ্লবী যুদ্ধ চলছে, এরই মধ্যে এক মহামারি ছড়িয়ে পড়লো। মহামারিতে আক্রান্ত হলেন একজন আমেরিকান যোদ্ধা। প্রবল জ্বরে অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। আর সেখানেই উন্মোচিত হয় প্রায় দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে লুকিয়ে রাখা গোপন তথ্য।
আমেরিকান সৈন্যবাহিনীতে সেই সময় নারীদের অংশ নিতে দেওয়া হতো না। মনে করা হতো, নারীরা এর জন্য উপযুক্ত নয়। কিন্তু তাদের ধারণা বারবারই ভুল প্রমাণ করেছেন অদম্য সাহসী অনেক নারী। তাদেরই একজন ডেবোরা স্যাম্পসন, যিনি পুরুষের ছদ্মবেশে আমেরিকান বিপ্লবী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তার সাহস আর দৃঢ়তার উদাহরণই আজকের ইতিহাস।
জন্ম ও শৈশব
১৭ ডিসেম্বর ১৭৬০ সালে, ম্যাসাচুসেটসের প্লাম্পটনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জোনাথন স্যাম্পসন জুনিয়র এবং মা ডেবোরা (ব্র্যাডফোর্ড) স্যাম্পসন। ডেবোরার সাত ভাইবোন ছিল। তার বাবা-মা দুজনই ছিলেন বিশিষ্ট তীর্থযাত্রীদের বংশধর: মাইলস স্ট্যান্ডিশের জোনাথন এবং প্রিসিলা অ্যাল্ডেন।
তার স্ত্রী, ম্যাসাচুসেটস গভর্নর উইলিয়াম ব্র্যাডফোর্ডের প্রপৌত্রী। তবুও, স্যাম্পসনরা আর্থিকভাবে সবসময়ই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এমনকি জোনাথন সমুদ্র ভ্রমণ থেকে ফিরে আসতে ব্যর্থ হওয়ার পরে, তার দরিদ্র স্ত্রী তার সন্তানদের বিভিন্ন পরিবারে রাখতে বাধ্য হয়েছিল।
ডেবোরা প্রথমে একজন দূর সম্পর্কের আত্মীয়ার বাড়ি ছিলেন। পরে তারা অপারগতা দেখালে ১০ বছর বয়সে ডেবোরা মিডলবরোর একজন কৃষক, ডেকন বেঞ্জামিন থমাসের কাছে একজন চুক্তিবদ্ধ দাস হিসেবে আবদ্ধ হন।
স্যাম্পসন স্ব-শিক্ষিত ছিলেন। তাই ১৮ বছর বয়সে চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে, ১৭৭৯-৮০ সালের গ্রীষ্মকালীন সেশনে একজন শিক্ষক হিসাবে এবং শীতকালে তাঁতি হিসাবে কাজ করেন।
যুদ্ধে যোগদান
১৭৮২ সালে আমেরিকার বিপ্লবী যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে দেশপ্রেমিক স্যাম্পসন, রবার্ট শার্টলেফ নামে ছদ্মবেশ ধারণ করে চতুর্থ ম্যাসাচুসেটস রেজিমেন্টে যোগ দেন। নিউইয়র্কের ওয়েস্ট পয়েন্টে, হাডসন উপত্যকার সবচেয়ে সক্রিয় সৈন্যদের অংশ হিসাবে তাকে ক্যাপ্টেন জর্জ ওয়েবের ‘কোম্পানি অব লাইট ইনফ্যান্ট্রিতে’ নিয়োগ দেওয়া হয়।
তাকে ম্যানহাটনে ব্রিটিশ আর্মিদের পোশাক এবং ব্যবহৃত জিনিসের খোঁজ করার জন্য নিরপেক্ষ অঞ্চল স্কাউট করার বিপজ্জনক কাজ দেওয়া হয়। এই অঞ্চলটি জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটন আক্রমণ করার কথা ভাবছিলেন। স্যাম্পসন তার বেশিরভাগ সময় সেনাবাহিনীতে নিউইয়র্কের লোয়ার হাডসন রিভার ভ্যালি অঞ্চলে কাটিয়েছেন, যেটি তখন নিউট্রাল গ্রাউন্ড নামে পরিচিত ছিল।
জুন মাসে, স্যাম্পসন এবং দুইজন সার্জেন্ট একটি অভিযানে প্রায় ৩০ জন পদাতিক সৈন্যের নেতৃত্ব দেন যেটি টরিসের সাথে একটি সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। তিনি একটি টরি বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করেন এবং সেখানে ১৫ জনকে আটক করা হয়।
নিউ উইন্ডসর ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালীন, তিনি জেনারেল জন প্যাটারসনের ওয়েটার হিসাবে কাজ করেছিলেন। এই সময় স্যাম্পসন ‘কাউবয়’ বলে পরিচিত কিছু দলের বিরুদ্ধে অনেক সংঘর্ষের অংশ ছিলেন। কথিত আছে, যুদ্ধের সময় যখন তার বাম উরুতে গুলি লাগে, তখন তিনি নিজেই গুলিটি বের করেন।
ফিলাডেলফিয়ায়, একটি মহামারি চলাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। উপস্থিত চিকিৎসক বার্নাবাস বিনি তার চিকিৎসা করার সময় স্যাম্পসনের আসল পরিচয় জানতে পারেন। তিনি একটি চিঠির মাধ্যমে জেনারেল প্যাটারসনের কাছে তার পরিচয় প্রকাশ করেছিলেন।
অবসর
২৩ অক্টোবর, ১৭৮৩ সালে সম্মানজনক অবসর পেয়ে, স্যাম্পসন ম্যাসাচুসেটসে ফিরে আসেন। ৭ এপ্রিল, ১৭৮৫-এ, তিনি শ্যারনের বেঞ্জামিন গ্যানেটকে বিয়ে করেন এবং তাদের তিনটি সন্তান ছিল, আর্ল, মেরি এবং পেশেন্স।
১৭৯২ সালে, তিনি সফলভাবে ম্যাসাচুসেটস রাজ্য আইনসভায় তার সেনাবাহিনীতে চাকরির বেতনের জন্য আবেদন করেন এবং ৩৪ পাউন্ড পুরস্কার পান। ১৭৯৭ সালে, তিনি যুদ্ধের সময় কাঁধের ক্ষতের জন্য অক্ষমতার দাবি করে কংগ্রেসে আবেদন করেছিলেন। তার আবেদন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। তিনি ম্যাসাচুসেটস রাজ্য থেকে একটি সামরিক পেনশনও পেয়েছিলেন।
তার জীবনের গল্পটি ১৭৯৭ সালে হারম্যান মান লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল- ‘দ্য ফিমেল রিভিউ: অর, মেমোয়ার্স অব অ্যান আমেরিকান ইয়াং লেডি’। যদিও এতে কিছু তথ্যগত ভুল ছিল বলে গবেষকরা মনে করেন।
লেকচার সার্কিট
১৮০২ সালে তিনি তার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমেরিকার প্রথম নারী হিসাবে একটি বছরব্যাপী বক্তৃতা সফর শুরু করেন। তিনি বোস্টন, প্রভিডেন্স, হোল্ডেন, ওরচেস্টার, ব্রুকফিল্ড, স্প্রিংফিল্ড, নর্দাম্পটন, আলবানি, শেনেকট্যাডি, বলস্টন এবং নিউ ইয়র্ক সিটিতে বক্তব্য রাখেন। তিনি একা এই যাত্রা করেছিলেন এবং প্রায়ই অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থতা সত্ত্বেও, তিনি তার লেকচার সার্কিট শেষ করেন এবং ১৮০৩ সালের এপ্রিল মাসে দেশে ফিরে আসেন। এই সফরে কখনও কখনও তিনি সম্পূর্ণ সামরিক পোশাকেও আবির্ভূত হতেন।
শেষ জীবন
বক্তৃতা সফরের পর, স্যাম্পসন আবার কংগ্রেসের কাছে আবেদন করেন। এবার তার আবেদন সফল হয়। ১১ মার্চ, ১৮০৫-এ, তাকে প্রতিবন্ধী প্রবীণদের জন্য পেনশন তালিকায় রাখা হয়। বাকি বেতন প্রত্যাখ্যান না হওয়া পর্যন্ত তিনি তার সমস্ত বকেয়া অর্থের জন্য কংগ্রেসের কাছে প্রচার চালিয়ে যান। তিনি ১৮২৭ সালের ২৯ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।
স্যাম্পসনের মৃত্যুর চার বছর পর, তার স্বামী একজন সৈনিকের স্বামী হিসাবে বেতনের জন্য কংগ্রেসে আবেদন করেছিলেন। তাকে অর্থ প্রদান করা হয়েছিল, যদিও এটি পাওয়ার আগেই তিনি মারা যান।
সময় আর স্থান ছাপিয়ে অমর হয় তারাই যারা নিজের বিশ্বাস আর স্বপ্নের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে। কোনো বাধা তাদের দমাতে পারে না। অন্যদের জন্য তারা নতুন পথ তৈরি করে দিয়ে যায়। এই সবগুলো বৈশিষ্ট্যই ছিল ডেবোরা স্যাম্পসনের। আর তাই, দেরিতে হলেও আজকের সময় তাকে মনে করছে ভবিষ্যতের ইতিহাসে স্থায়ী করে রাখতে।
Featured Photo: thoughtCo References: 01. Deborah-Sampson-American-Revolutionary-War-Hero. 02. Deborah-Sampson. 03. Reliving-History/Deborah-Sampson.