প্রিন্সেস ডায়ানা: বাস্তবিক রূপকথার নিঃসঙ্গ এক রাজকন্যার গল্প

451
0

১৯৯৭ সালের আগস্টের ৩১ তারিখ। বিবিসির একটা খবর শুনে, সমস্ত দুনিয়া যেন শোকস্তব্ধ, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। কোটি মানুষের ভালোবাসা, আদর্শ, স্বপ্নের রাজকুমারীর মৃত্য সংবাদ ভেসে বেড়াতে লাগল আকাশে বাতাসে। যার পুরো নাম ডায়ানা ফ্রান্সেস স্পেন্সার। তাকে রাজকীয়ভাবে ডাকা হয় ডায়ানা, প্রিন্সেস অফ ওয়ালস।

তার অন্য পরিচয় উইলিয়াম ও হ্যারি-এর মা তিনি, এবং ব্রিটেনের বর্তমান রাজা চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জ এর প্রথম স্ত্রী। ১৯৮১ সালে তাদের বিবাহের পর থেকে ১৯৯৬ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া পর্যন্ত তাকে হার রয়াল হাইনেস দি প্রিন্সেস অফ ওয়েল্‌স বলে সম্বোধন করা হতো। পরবর্তীতে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাকে শুধু ডায়ানা, প্রিন্সেস অফ ওয়েল্‌স বলে সম্বোধনের অনুমতি দেন।

তবে বিশ্ববাসীর কাছে সে প্রিন্সেস ডায়ানা, সবার পছন্দের একজন মানুষ। ফ্যাশন থেকে মানবতার সেবা ও সৌন্দর্য, সে যাইহোক না কেন মৃত্যুর ২৫ বছর পরেও তাকে টক্কর দেয়া মুশকিল। তার জীবনের অনেক কিছু যেমন খোলা বই এর মতো, তবু সেখানেও আছে অনেক গোপন শব্দ। আজকের আয়োজন প্রিন্সেস ডায়ানাকে কেন্দ্র করেই। 

ডায়ানা ফ্রান্সেস স্পেন্সার

ডায়ানা, ওয়েলসের রাজকুমারী দ্য অনারেবল ডায়ানা ফ্রান্সেস স্পেন্সারের জন্ম ১৯৬১ সালের ১ জুলাই নরফোকে। তার বাবা তার আর্লডম হবার পর, তিনি ১৯৭৫ সালে, মার ১৪ বছর বয়সে লেডি ডায়ানা স্পেন্সারের খেতাব পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। এই খেতাবের পুরো নাম ‘৯ম আর্ল অব স্পেন্সার’। 

Sources: Getty Images

ডায়ানা ছিলেন পিতা এডওয়ার্ড জন ভিসকাউন্ট এলথর্প এবং মাতা ফ্রান্সিস রুথের কন্যা। মাত্র ৬ বছর বয়সে বাবা মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। এই ঘটনার পর, সৎ মা এবং বাবার সাথে থাকতেন তিনি। বিচ্ছেদের জন্য লড়াই মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তার শৈশব কাটে নর্দাম্পটনে।পরবর্তীতে লেডি ডায়ানা স্পেন্সার ১৯৮১ সালের জুলাই এর ২৯ তারিখ লন্ডনের সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে প্রিন্স অফ ওয়েলসকে বিয়ে করেন।

ডায়ানা প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় অত দক্ষ না হলেও গান-নাচ, খেলাধুলাসহ সাঁতারে ছিলেন দক্ষ। তিনি ব্যালেডান্সে ছিলেন নিপুণ, কিন্তু তার পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতা এখানে বাধ সাধে। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত লম্বা হবার দরুন, তার এই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। শিশু পরিচারিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু হলেও পরবর্তীতে লন্ডনের একটি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কাজ করেছেন বাবুর্চী হিসেবেও।  

ডায়ানা, প্রিন্সেস অফ ওয়ালস

১৯৭৭ সালে লেডি ডায়ানা আর চার্লসের পরিচয়। তখন চার্লস ছিলেন ডায়ানার বোন সারাহের প্রেমিক। এরপর সময়ের সাথে সাথে তাদের সমগ্র গভীর হতে থাকে। এক নৌভ্রমণের প্রাক্কালে তাদের সম্পর্ক আরো পরিণত হয়। ১৯৮১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, লেডি ডায়ানা আর দ্য প্রিন্স অফ ওয়ালসের বিবাহের ঘোষণা দেয়া হয়। একই বছর ২৯ জুলায় সাড়ম্বরে তাদের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। 

১০০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ রেডিও আর টেলিভিশনে সে অনুষ্ঠান দেখেন এবং হাজার হাজার মানুষের পদচারনায় মুখর ছিল বাকিংহাম প্যালেস থেকে ক্যাথিড্রালের পথ। সেই ২৯ জুলাই তার থেকে নাম হল ডায়ানা, প্রিন্সেস অফ ওয়ালস। যার সৌন্দর্য-রূপ-ফ্যাশন-গুণ আজো সবার আদর্শ।  

Sources: Getty Images

প্রিন্স আর প্রিন্সেসের বিয়ে ছিল রূপকথার মতোই। ২৫ ফুটের ভেইল, ১৮ শতকের স্পেন্সার ফ্যামিলির টিয়ারা, ১০,০০০ মুক্তো বসানো সাদা ওয়েডিং ড্রেসে ডায়ানাকে পরী কিংবা রূপকথার রাজকন্যা বলেই মনে হয়েছিল। বলাবাহুল্য তার গুণ-রূপ সৌন্দর্যে তিনি যে একজন বাস্তবের রাজকন্যা ছিলেন, আজো আছেন।

এতগুলো বছরেও তার জায়গা কেউ নিতে পারেনি, পারবে বলেও মনে হয় না। রূপকথার মতো তার জীবন শুরু হলেও, রূপকথা আর বাস্তবতার মধ্যে অনেক ফারাক। ১৯৮২ সালে চার্লস-ডায়ানার প্রথম সন্তান হ্যারি এবং ৮৪ সালে উইলিয়ামের জন্ম। জীবনে তার অনেক উত্থান পতন এসেছিল। তবে তার দুই সন্তান ছিল তার সবচাইতে অমূল্য ধন। 

প্রিন্সেস ডায়ানা এবং রূপকথার নটে গাছ 

সময়ের সাথে সাথে প্রিন্সেস ডায়ানার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, চার্লসকে ছাড়িয়ে যায়। কিছুটা একগুঁয়ে ধরনেরও ছিলেন তিনি। বিবাহিত জীবন তার সুখের ছিল না। তাই বোধকরি বাইরে চ্যারিটির কাজে নিজেকে নিমগ্ন রেখেছিলেন। ব্রিটিশ পরিবারের কঠোর নিয়মের বেড়াজালে নিজেকে বন্দী পাখির মতো মনে হতো তার, অথচ তিনি কী হতে চেয়েছিলেন! তার কথায় প্রকাশ পেয়েছিল তার একাকীত্বের কথা, তিনি বলতেন, তার একাকীত্ব আর কষ্ট ভোলার একমাত্র উপায় তার সন্তানেরা। 

Sources: express.co.uk

একদিকে যেমন প্রিন্স আর প্রিন্সেসের বয়েসের ফারাক, প্রিন্সের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, দু-জনের মতের অমিল, নিয়মের ঘেরাটোপসহ নানাবিধ কারণে তাদের সম্পর্কে চীর ধরে। এই সময় ডায়ানা জেমস হাইয়ুত নামে একজনের সাথে সম্পর্কে জড়ান আর চার্লস জড়ান প্র্যাক্তন প্রেমিকা ক্যামিলা পার্কারের সঙ্গে। বর্তমানে ক্যামিলার সঙ্গেই সংসার করছেন তিনি, দখল করেছেন ব্রিটেনের রাজ্যভার। 

ডায়ানার তথাকথিত প্রেমিকের তালিকায় ছিলেন জনপ্রিয় গায়ক ব্র্যায়ান অ্যাডামস থেকে দেহরক্ষী পল। ১৯৯৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিচ্ছেদ হয়,  এরপর মিশরীয় এক পরিচালক ও ব্যবসায়ী দোদি আল ফায়েদ-এর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান ডায়ানা। যদিও শেষ পর্যন্ত নিজেদের ‘ভালো বন্ধু’ আখ্যান দিয়ে গেছেন। 

প্রিন্সেসের জনপ্রিয়তা কেবল রাজ বধু হিসেবেই নয়, তার মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মায়া-মমতা সবকিছু মিলেই ছিল। একে তো রাজবধু থেকে প্রাক্তন রাজবধু, এর উপরে নতুন প্রেম, বিবাহ বিচ্ছেদ, সমাজের মানুষের জন্য কাজ করা, কোমল অন্তর, দুর্দান্ত ফ্যাশন সেন্স, অপূর্ব মুখশ্রী, অন্তর-বাহিরের সমান সৌন্দর্য। এই জনপ্রিয়তার রেশ ধরে তাকে সামনা করতে হতো হলুদ সাংবাদিকসহ নানান মানুষের। 

১৯৯৭ সালে এক প্রমোদভ্রমণে বন্ধু দোদির সাথে ফ্রান্সে আসেন এককালের রাজ বধু কিংবা না হওয়া ব্রিটেনের রাণী। সাংবাদিকদের হাত থেকে পালাতে গিয়ে ৩০ আগস্ট দিবাগত রাতে গাড়ি দুর্ঘটনা, এক টানেলর দেয়ালে এবং পিলারের সঙ্গে গাড়ির ধাক্কায়, প্রাণ হারান ডায়ানা। 

Sources: thesun.co.uk

চালক এবং দোদি ঘটনাস্থলে মারা যান। বেঁচে ছিলেন তার দেহরক্ষী। জেভিয়ারের মতে তিনি আশা করেছিলেন, প্রিন্সেসের জীবন হয়তো রক্ষা পাবে, অ্যাম্বুলেন্সেও সে জীবিত ছিল, কিন্তু হাসপাতালে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে অবসান ঘটে এক রাজকন্যার, যে বাঁচতে চেয়েছিল নিজের মতো করে। অথচ রূপকথার কী নির্মম পরিসমাপ্তি! 

ডয়ানার শেষ শব্দ

১৯৯৭ সালে ডায়ানাকে উদ্ধার করেন জেভিয়ার, দীর্ঘ সময় পর, দ্য সান পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন মারা যাবার আগে কী বলেছিলেন রাজকন্যা। 

My God, what’s happened

তার দেহ-কায়াটায় এই পৃথিবীতে নেই, ৬ সেপ্টেম্বর তাকে এলথ্রোপ নামে পারিবারিক এস্টেটে সমাহিত করা হয়। উদ্ধারকারী ব্যক্তি সেই ভয়াবহ ঘটনার আবহ থেকে বের হতে পারেননি বলে জানান। আদতে সেই ঘটনার ভয়াবহতা বা আবহ থেকে কেউই বের হতে পারেনি, সে হোক তার দুই রাজপুত্র বা জনমানুষ।

শেষকৃত্যের সেই ফুলেল শববাহী শকটের দৃশ্য যেন আজো চোখে ভাসে, তার বিবাহের সময় যেমন মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, ফুল আর ভালোবাসায় বরণ করেছিল তাকে। শেষবিদায়ে কোটি মানুষ অশ্রু দিয়ে বিদায় দিয়েছিলেন। 

Sources: Getty Images

রাজ পরিবারের বধু হয়েও তার মন পড়ে থাকত এই সাধারন মানুষের কাছে। দেশে বিদেশে সাধারন মানুষ তাকে আপন করে নিয়েছিল। প্রিন্সেস ডায়ানা আজো উচ্চারিত হয় সবার মুখে, তার হাত ধরেই বোধহয় কালো পোশাক আজ প্রতিবাদের প্রতীক। তার সেই সময়ে পরিধান করা পোশাক আর অলঙ্কার, ফ্যাশন-ট্র্যাডিশনে সবার আগে আজো। তার উপস্থিতি আছে প্রিন্স হ্যারি আর প্রিন্স উইলিয়ামের মধ্যে।  

বেঁচে থাকতে হয়তো তিনি কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা-শান্তি পরিবার থেকে পান নি, কিন্তু সমগ্র বিশ্ব তাকে আজো ভালোবাসে, সম্মান করে, স্মরণ করে, এর চাইতে প্রাপ্য আর কী হতে পারে? 

 

 

 

Feature Image: tvinsider.com
Sources: 

01. Diana, Princess of Wales. 
02. Diana, Princess of Wales. 
03. Princess Diana. 
04. 9 Secrets About Princess Diana. 
05. PRINCESS DIANA. 
06. Princess Diana's final words.