কৃষ্ণচন্দ্র। অধিকাংশই যাকে চেনে গোপাল ভাঁড় কার্টুনের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র হিসেবে। যাকে বাংলার ইতিহাসের নায়ক খলনায়ক উভয়ই বলা চলে। কৃষ্ণচন্দ্রের রাজনৈতিক ইতিহাস খুবই বৈচিত্র্যময়। আর সেই ইতিহাসে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির ভূমিকা অনস্বীকার্য। খুব কাকতালীয় আর খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে এই রাজবাড়ি একাধারে বাংলার পরাধীনতা আবার স্বাধীনতা দুই ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে।
আফগান শাসকদের আর মারাঠাদের হটাতে কৃষ্ণচন্দ্রের যেমন ভূমিকা ছিল তেমনই মীরজাফর এর সাথে আঁতাত করে ইংরেজদের দলে ভিড়ে নবাব সিরাজদ্দৌলাকে সিংহাসন থেকে হটিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য ডোবাতেও তার ভূমিকা ছিল।
‘একই অঙ্গে ভিন্ন রুপ’ কথাটা যার ওপরে খাটে তিনিই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। কিন্তু কৃষ্ণনগরের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা তিনি নন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১০৭৭ সালে তৎকালীন বাংলার শাসনকর্তা আদিশূর যজ্ঞ সম্পাদনা করতে কর্ণাটক হতে পাঁচজন ব্রাহ্মণ আনেন। এদের মধ্যে ভট্টনারায়ণ একজন। তখনকার বিক্রমপুরের অর্থনৈতিক অবস্থা অনূকূলে থাকায় ভট্টনারায়ণ সেখানে বসতি স্থাপন করেন। ওনার উনবিংশ পুরুষ পরে ষোল শতকের শেষ দিকে কাশীনাথ নামে একজনের জন্ম হয়। ততদিনে ভট্টনারায়ণের বংশধরেরা ধনবান হয়ে ওঠেন।
সেই সময় বিক্রমপুর বারো ভূঁইয়াদের অধীনে চলে গেলে কাশীনাথ তার গর্ভবতী স্ত্রীকে সাথে নিয়ে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হোন। কিন্তু পথিমধ্যে কাশীনাথ বারো ভূঁইয়ার সৈন্য কর্তৃক নিহত হলে তার স্ত্রী বাগওয়ান পরগণার জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নেন, এবং একটি পুত্রসন্তান জন্ম দেন, যার নাম রামচন্দ্র। নিঃসন্তান জমিদার হরেকৃষ্ণ সমাদ্দার কাশীনাথ-পুত্রকে নিজ সন্তানের মতো পালন করেন এবং রামচন্দ্রের নামের সাথে সমাদ্দার যুক্ত করে দেন। পরবর্তীতে রামচন্দ্র সমাদ্দার চারটি পুত্র লাভ করেন।
রামচন্দ্র সমাদ্দারের পুত্রদের মধ্যে একমাত্র ভবানন্দের নাম জানা যায়। কৃষ্ণনগর রাজবংশের ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বারো ভুঁইয়া দমনে, বিশেষ করে বাংলা বিজয়ে মানসিংহকে সাহায্য করার জন্য পুরস্কার হিসাবে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে ভবানন্দ মজুমদার সম্মান লাভ করেন এবং সঙ্গে পান নদিয়া, সুলতানপুর, মারুপদহ, মহৎপুর, লেপা, কাশিমপুরের মতো ১৪টি পরগনা। তাঁকেই বলা হয় নদিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।
ভবানন্দের পর নবদ্বীপের রাজা হন তার পুত্র রামজীবন এবং রামজীবনের পর নবদ্বীপের মসনদে বসেন রাঘব রায়। আরেকটা ব্যাপার হলো, ভবানন্দ প্রথমে তার ও বাবা রামচন্দ্রের জন্মস্থান বাগোয়ান গ্রামে রাজধানী স্থাপন করলেও, পরে ভবানন্দের পৌত্র, রামজীবনের পুত্র রাঘব রায় বাগওয়ান থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসেন ‘রেবতী’ গ্রামে৷
রাঘব রায়ের পুত্র রুদ্র রায় ছিলেন পরম কৃষ্ণভক্ত৷ তিনি শ্রীকৃষ্ণের নামানুসারে রেবতী গ্রামের নামকরণ করেন ‘কৃষ্ণনগর’৷ তিনি ঢাকা থেকে আলাল বক্স নামে এক স্থপতিকে আনিয়ে চকবাড়ি, কাছারিবাড়ি, হাতিশালা, আস্তাবল, নহবৎখানা এবং পঙ্খ অলঙ্কৃত দুর্গাদালান এসব নির্মান করান।
রুদ্র রায়ের পর সিংহাসনে বসেন রঘুরাম। আর এই রঘুরামের সন্তান হলেন পরবর্তী মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, যিনি ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। কৃষ্ণচন্দ্র ১৮ বছর ও অতিশয় বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও রাজনিয়ম অনুযায়ী মহারাজ রঘুরাম তার সিংহাসনের উত্তরসূরী হিসেবে তার ছোট ভাই রামগোপালকে করে যান। এরপর ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে রঘুনাথ মারা গেলে কৃষ্ণচন্দ্র ছল-কৌশলের আশ্রয় নিয়ে কাকা রামগোপালকে সিংহাসন থেকে হটায়।
শুরু হয় কৃষ্ণনগরের স্বর্ণযুগ। অর্থনীতি, সমরশক্তিতে উত্তরোত্তর উন্নতি হতে থাকে। ইতিহাসের পাতা একটু উল্টালেই তা দেখা যাবে। তাঁর রাজত্বকালেই ফুলে ফেঁপে ওঠে রাজ্য। তাঁর আমলকে ‘নদীয়ার স্বর্ণযুগ’ বলা হয়৷ সেই সময়ে রাজ্যের পরগনার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪টি আর রাজ্যের বিস্তৃতি হয় ৮৫০ ক্রোশ। কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার বিখ্যাত কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তার রাজ্যের পরিধি নিয়ে লিখেছিলেন যে,
অধিকার রাজার চৌরাশী পরগণা,
খাড়ি জুড়ী আদি করি দপ্তরে গণনা।
রাজ্যের উত্তর সীমা মুরশিদাবাদ,
পশ্চিমের সীমা গঙ্গা ভাগিরথী খাদ।
দক্ষিণের সীমা গঙ্গা-সাগরের ধার,
পূৰ্ব্ব সীমা ধুল্যাপুর বড় গঙ্গা পার।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের নাম বললে সর্বপ্রথমে শিল্প-ঐতিহ্যের কথা আসে। কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন শাক্ত পদাবলিকার রামপ্রসাদ সেন, অন্নদামঙ্গল কাব্য প্রণেতা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, বিশিষ্ট জ্ঞানী-বাগ্মী-হাস্যরসিক-বিচক্ষণ গোপাল ভাঁড় প্রমুখ বাংলার গুণী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষক। বাংলার কাব্য ইতিহাসের মাইলস্টোন খ্যাত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অনুরোধে লেখা হয়। কৃষ্ণনগরের জগদ্বিখ্যাত মৃৎশিল্পের সূত্রপাত তার সময়ে তারই উদ্যোগে ঘটে। তারই হাত ধরে শুরু হয় শাক্তরাস ও জগদ্ধাত্রী পূজা। তবে এর মধ্যে জগদ্ধাত্রী পূজার জন্য কৃষ্ণচন্দ্র বিখ্যাত হয়ে আছে।
কথিত আছে যে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ইংরেজদের সাহায্য করছে এই সন্দেহে ১৭৬৪ সালে মীরকাশিম মুঙ্গেরের কারাগারে বন্দি করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর পুত্র শিবচন্দ্রকে। মীরকাশিম কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাণদণ্ডেরও আদেশ দিয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র গোপনে তার দূত মারফত এই সংবাদ মেরতলার প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এবং তাঁর প্রাণ রক্ষার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। কারাগারেই কৃষ্ণচন্দ্র এক কুমারী দেবীর স্বপ্নাদেশ লাভ করেন এবং কারাগার থেকে মুক্তিলাভের প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে যে, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সত্যি কারামুক্ত হয়েছিলেন।
কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করার পরেই কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড়কে নিয়ে উপস্থিত হন মেরতলার প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে। কৃষ্ণচন্দ্র এই স্বপ্নের কথা জানান এবং জানতে চান কে এই দেবী? কালীশঙ্কর তাকে জানান, এই দেবী স্বয়ং চণ্ডী। প্রাচীনকালে এই দেবীর পুজোর প্রচলন ছিল। রাজা তখন জানালেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি এই দেবীর পুজোর আয়োজন করতে চান। এর উত্তরে কালীশঙ্কর জানান, কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবীর পুজোর বিধান আছে। হাতে সময় কম থাকলেও কৃষ্ণচন্দ্র পুজোর সমস্ত আয়োজন করবেন বলে জানিয়েছিলেন।
কৃষ্ণচন্দ্র তাকে অনুরোধ করেছিলেন পুজোয় পৌরোহিত্যের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। শোনা যায় কালীশঙ্কর রাজাকে যথাযথ সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। সেই থেকেই শুরু হল রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো। সনাতন ধর্ম গবেষকদের মতে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তক। অনেকেই মনে করেন, পরের বছর থেকে চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয়েছিল ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর উদ্যোগে।
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রাজনৈতিক দিক থেকে ছিলেন বেশ কৌশলী। নবাবী আমলে বাংলায় কেবল ৭ জন হিন্দু রাজা ছিলেন, যাদের ভেতর একজন হলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। এবং এদের ভেতর সবচাইতে বিচক্ষণ ছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার মুসলিম শাসকদের শাসন করার দিন ফুরিয়ে এসেছে। আর এই সময় ব্রিটিশরা যেকোনো সময় পুরো ভারতবর্ষ এর ক্ষমতা দখল করতে পারে, তা ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তা বুঝতে পেরেছিলেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অন্য হিন্দু রাজাদের বোঝাতে সক্ষম হন তাদের সনাতন ধর্ম মুসলিম শাসকদের হাতে নিরাপদ নয়। বরং ব্রিটিশদের কাছে তাদের ধর্ম বেশি নিরাপদ। আর তাই সকল হিন্দু রাজাদের সমর্থন নিয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র হাত মিলান লর্ড ক্লাইভ এর সঙ্গে। আর ইংরেজদের সাথে হাত মেলানো ছিল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সবচেয়ে বড় ভুল।
তিনি ধর্মের স্বার্থে নিজের স্বকীয়তাকে ইংরেজদের হাতে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় রবার্ট ক্লাইভ এর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে নেন। ১৭৫৭ সালে যখন রবার্ট ক্লাইভ নবাব সিরাজুদ্দউলা এর সাথে পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধে লিপ্ত হন; সেসময় রনক্ষেত্রে জাওয়ার আগে রবার্ট ক্লাইভ এই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ইংরেজদের সহযোগিতা করায় কৃষ্ণচন্দ্রকে পুরো নবদ্বীপের ক্ষমতা আর ‘মহারাজ’ উপাধি দেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
কৃষ্ণচন্দ্রের দুই স্ত্রী ছিলেন। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে শিবচন্দ্র, ভৈরবচন্দ্র, হরচন্দ্র, মহেশচন্দ্র ও ঈশানচন্দ্র এই পাঁচ পুত্র জন্ম গ্রহণ করেন; দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে শম্ভুচন্দ্রের জন্ম হয়। শম্ভুচন্দ্র পিতার বিরুদ্ধাচারী হওয়ায় কৃষ্ণচন্দ্রের অপ্রিয় হয়েছিলেন। শিবচন্দ্র সিংহাসনে বসলে শম্ভুচন্দ্র নিজ মায়ের সাথে হরধাম নামক স্থানে গিয়া বাস করতে শুরু করলেন।
অন্যরা শিবনিবাসেই থেকে গেলেন। এখনও শিবনিবাস ও হরধামে কৃষ্ণচন্দ্রের বংশ বিভক্ত হয়ে টিকে আছে। এরপর ১৭৮৩ খ্রীস্টাব্দে এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ ১৫ দিন অনাহারে থেকে অলকানন্দ নদীর তীরের গঙ্গাবাসে মারা যান মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র।
Feature image source: unplash
References:
01. রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ—শিবনাথ শাস্ত্রী। প্রকাশনী- নিউ এজ পাবলিসার্স। প্রকাশকাল-১৯০৪ (১ম সংস্করণ)।
02. ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কিন্তু জগদ্ধাত্রী পুজোর কথা বলে না।