কৃষির ভবিষ্যত ও টেকসই উন্নয়ন

318
0

একবিংশ শতাব্দীতে অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় কৃষিক্ষেত্রেও পড়েছে প্রযুক্তির প্রভাব। আজকের প্রযুক্তি নির্ধারণ করছে আগামীর ভবিষ্যত। মানব সভ্যতার প্রাচীন চালিকাশক্তি কৃষির ভবিষ্যতও আজ নির্ভর করছে এই প্রযুক্তির উপর। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স, IoT (ইন্টারনেট অব থিংস)সহ নানা প্রযুক্তি আজ কৃষিক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া, বর্তমানে কৃষিক্ষেত্রেকে টেকসই করার জন্য গৃহীত হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। 

বর্তমানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭.৮ বিলিয়ন। এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খাদ্য চাহিদা। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে হলে ২০৫০ সালের মধ্যে খাদ্যের যোগান বাড়াতে হবে শতকরা ৬৮ ভাগ। নিশ্চিতভাবে এই অল্প সময়ের মধ্যে তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে শুধু যে খাদ্য যোগান দিতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়।   

এই জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট সংখ্যা হচ্ছে মধ্যবিত্ত, যাদের দৈনিক খাদ্য চাহিদায় শর্করার উপরে রয়েছে আমিষের চাহিদা। আবার এই ধরণের খাদ্য চাহিদা প্রভাব ফেলছে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের উপর। ফলে মানুষের খাদ্যাভাসের প্রভাব পড়ছে পৃথিবীর সার্বিক অবস্থার উপর।  

মানুষের খাদ্যাভাস, খাদ্যের চাহিদা, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সব কিছু ঠিক রেখেই আজ কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োজন একটি টেকসই ব্যবস্থাপনা। এর জন্য প্রয়োজন নতুন পদ্ধতি যাতে এই বিপুল সংখ্যক জনগণের খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। 

কৃষির ভবিষ্যত। Image Source: re-imagine.eu

প্রথমেই প্রথাগত পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। কৃষিক্ষেত্রে এমন পদ্ধতি আনা প্রয়োজন যা একইসাথে পরিবেশের উপর প্রভাব কমাবে আবার উৎপাদনও বাড়াবে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে ব্যবহৃত কৃষি প্রযুক্তির মূলে ছিল যান্ত্রিক উৎকর্ষতা, কিংবা কৃষিপণ্যের উন্নত জাত উৎপাদন করা। কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে কৃষিক্ষেত্রে রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স, অটোমেশন, প্রিসাইশন ফার্মিং-এর মতো প্রযুক্তিগুলো সংযুক্ত হচ্ছে। 

অটোমেশনের মাধ্যমে কৃষিকাজে রোবট, ড্রোন, স্বয়ংক্রিয় ট্রাক্টর এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার প্রিসাইশন ফার্মিং-এর মাধ্যমে কৃষিপণ্যের চাহিদা অনুযায়ী সেচ, সার প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। এতে করে পণ্যের চাহিদা, পণ্য উৎপাদনের সময়, গুণগত মান নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হয়। 

এছাড়াও, সামনের দিনগুলোতে কৃষিপণ্যের পরিবহন ব্যয় কমাতে অঞ্চলভিত্তিক চাষাবাদকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। অর্থাৎ, অঞ্চলভেদে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট খাদ্য দ্রব্য উৎপাদনে উৎসাহী করা হবে। এতে করে পণ্যের পরিবহন ব্যয় এবং সময় দুই-ই কমিয়ে আনা যাবে। 

প্রিসাইশন ফার্মিং, অঞ্চলভিত্তিক চাষাবাদ এর সাথে আরেকটি নতুন পদ্ধতি হয়তো ভবিষ্যতের দিনগুলোতে যুক্ত হবে, এটি হলো ভার্টিক্যাল ফার্মিং বা উলম্ব চাষাবাদ। এই পদ্ধতিতে উলম্ব জমিতে কিংবা উলম্ব যেকোনো তলে চাষাবাদ করা হয়। এরই সাথে হাইড্রোপোনিকস নামক পদ্ধতিতে চাষাবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। 

অটোমেশনের মাধ্যমে কৃষিকাজ। Image source: getac.com

ভার্টিক্যাল ফার্মিং এবং হাইড্রোপোনিকস এই দুই পদ্ধতিতেই মাটি, পানি এবং জমি অপেক্ষাকৃত কম দরকার হয়। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির নিউওয়ার্কে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভার্টিক্যাল ফার্ম গড়ে উঠেছে। আশা করা যায় সামনের দিনগুলোতে কৃষকগণ ভার্টিক্যাল ফার্মিং এর প্রতি আরো আকৃষ্ট হবেন।  

কৃষিক্ষেত্রে কেবল নিত্যনতুন পদ্ধতি আনলেই চলবে না এর সাথে প্রয়োজন কীভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায় এমন পদ্ধতি অবলম্বন করা। বর্তমান পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ হলো মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী। এই বিরাট জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে প্র‍য়োজন আমিষ জাতীয় খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি। কেননা তাদের খাদ্য তালিকায় শর্করা জাতীয় খাবারের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় আমিষ জাতীয় খাদ্য। 

আবার এই আমিষ জাতীয় খাদ্যের যোগানের জন্য যে পশুখাদ্যের প্রয়োজন তার জন্য চারণভূমি দরকার। এই চারণভূমি মোট কৃষি জমির প্রায় এক ভাগের তিন অংশ। সুতরাং, আমিষের চাহিদা পূরণ করার জন্য প্রয়োজন এমন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা যাতে আমিষের উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি এর জন্য বরাদ্দকৃত জমির কিছু অংশ কৃষিপণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। 

এই উভমুখী উপযোগিতা পূরণ করতে প্লান্ট বেসড এবং কালচারড মিট দারুন ভূমিকা রাখতে পারে। ইতোমধ্যেই বাজারে মাংসের বিকল্প হিসেবে প্লান্ট বেসড মিটের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। বার্গার কিং এর মতো ফুড চেইনগুলো তাদের মেন্যুতে যোগ করছে নিত্যনতুন প্লান্ট বেসড মিট দ্বারা তৈরি আইটেম। 

কৃষিকাজে রোবট image source: christiankromme.com

আবার যারা এখনই প্লান্ট বেসড মিট গ্রহণ করতে চান না তাদের জন্য রয়েছে কালচারড মিট। কালচারড মিট আসলে আসল মাংসের মতোই তবে এটি তৈরি করা হয় সরাসরি ল্যাবরেটরিতে প্রানিকোষ থেকে। এখনও কালচারড মিট তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা একেও আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যুক্ত করে নিব। ২০২০ সালে সিঙ্গাপুর সর্বপ্রথম কালচারড মিটকে স্বীকৃতি দেয়।  

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রযুক্তি হলো থ্রি-ডি প্রিন্টিং। থ্রি-ডি প্রিন্টিং এর ব্যবহার অন্যান্য সব ক্ষেত্রের মতো কৃষি ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ইতোমধ্যে বার্সেলোনায় অবস্থিত নোভামিট নামক একটি কোম্পানি থ্রি-ডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্লান্ট বেসড বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য এমনকি মাংস পর্যন্ত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।  

OECD-FAO Agriculture Outlook Project অনুসারে আগামী এক দশক, কৃষি, মৎস্য, খামার এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। যদিও বাড়তি চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবেনা। বরং খাদ্য উৎপাদন হবে ধীর গতিতে। তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে চীনের ক্ষেত্রে। 

চীনে আগামী এক দশক খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। চীনের পাশাপাশি ভারতেও দুগ্ধজাত খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে। যদিও সার্বিকভাবে পুরো পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদনে ধীরগতি দেখা গেলেও তা বাড়তি খাদ্য চাহিদার পূরণে সক্ষম থাকবে। বিশেষ করে ভারত এবং চীনের উৎপাদনের মাধ্যমে এই চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে। 

কৃষি ক্ষেত্রে থ্রি-ডি প্রিন্টিং image source: 3dprinting.com

সামনের দিনগুলোতে কৃষি পদ্ধতিতে টেকসই ব্যবস্থাপনা গ্রহণ আরো গুরুত্ব পাবে। এই লক্ষ্যে অর্গানিক এবং পুনঃউৎপাদনশীল চাষাবাদের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। একইসাথে মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি করা, কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিকের ব্যবহার কমানো, জীববৈচিত্র‍্য রক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কৃষিক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কৃষির উপরও পড়তে পারে। এই বিবেচনায় বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে প্রতিকূল জলবায়ু সহনশীল কৃষি পণ্য উৎপাদনে গুরুত্ব আরোপ করছেন। খরা প্রতিরোধী, উচ্চতাপ সহনশীল, কীটনাশক সহনশীল, পণ্য উৎপাদনে অগ্রসর হচ্ছেন। তাছাড়া কৃষকগণও গতানুগতিক চাষাবাদ পদ্ধতিতে নতুন পদ্ধতি সংযোজন করছেন টেকসই খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে। তারা চাষাবাদের সময়, চাষাবাদের ধরনে ভিন্নতা আনছেন, যাতে বৈরী আবহাওয়ার সাথে মোকাবেলা করতে পারে। 

কৃষির ভবিষ্যত আজ কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই। বরং তা ব্যক্তিগত চাষাবাদকে ছাড়িয়ে আজ পৌঁছে গেছে বৈশ্বিক চাষাবাদের দোড়গোড়ায়। কৃষির উন্নয়নে আজ প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। ইতোমধ্যে এরূপ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ শুরু হয়েছে। খাদ্যের অপচয় রোধ এবং খাদ্য উপাদানের সুষ্ঠু বন্টন করার মাধ্যমে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেতে পারে।

কৃষির ভবিষ্যত আজ নানা রকমের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজন টেকসই এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনা। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আজ কৃষক, বিজ্ঞানী, কূটনীতিবিদ, ভোক্তা সকলের মধ্যে একতা প্রয়োজন। 

 

 

 

Feature Image: istock.com 
References: 

01. What is the future of food and farming? 
02. The Biggest Future Trends In Agriculture And Food Production. 
03. Technology: The Future of Agriculture. 
04. Agriculture’s connected future.