সময়ের আবর্তনে কলমের বিবর্তন

219
0

কলম একটি লেখার যন্ত্র, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানবতার বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির সাথে রয়েছে। কলমের উদ্ভাবন এবং বিবর্তনের একটি আকর্ষণীয় ইতিহাস রয়েছে। এর প্রাচীন উৎপত্তি থেকে শুরু করে আধুনিক কালের বিভিন্ন লেখনী পর্যন্ত, কলমটি রূপান্তরের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে এসেছে, যা প্রযুক্তি, সংস্কৃতি এবং সামাজিক চাহিদার অগ্রগতিকেও প্রতিফলিত করে।

কলমের সমৃদ্ধ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আদিম হাতিয়ার তৈরির সময়কাল থেকে আজকের জটিল লেখা তৈরির উপকরণ পর্যন্ত এর বিকাশের একটি বিস্তর ইতিহাস রয়েছে। উৎপত্তিগত দিক থেকে বিবেচনা করলে কলমের উৎপত্তি প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যেও খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, যা সে সময়কার তথ্য রেকর্ড করার একটি মাধ্যম ছিল। তবে প্রাথমিক লেখার সরঞ্জামগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় ছিল খাগড়া কলম এবং পাখির পালক থেকে তৈরি কুইল।

খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩০০০ বছরের পুরনো প্রাচীন মিশরীয়রা, প্যাপিরাস স্ক্রলে লেখার জন্য নলখাগড়ার কলমের ব্যবহার শুরু করে। একইভাবে, সুমেরীয় সভ্যতার লোকেরা মাটির ট্যাবলেটে কিউনিফর্ম অক্ষর ছাপানোর জন্য একটি ভিন্ন আকৃতির লেখনীর ব্যবহার শুরু করেছিল, যা সে সময়কার লেখার প্রাচীনতম রূপগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল।

এরপর মধ্যযুগে এসে লেখার উপকরণগুলোতে পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করা যায়। খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে এসে বিকশিত কুইল কলম বলতে গেলে লেখার কাজে এক প্রকার বিপ্লবই ঘটিয়েছিল।

তথ্য রেকর্ড করার মাধ্যম হিসেবে প্রাচীন কলমের ব্যবহার। Image Source: Promotional Pens Australia

তাছাড়া, গজ বা রাজহাঁসের ডানার পালক থেকে তৈরি কুইলগুলোও আগের সরঞ্জামগুলোর তুলনায় কিছুটা সূক্ষ্ম এবং নিয়ন্ত্রিত লেখার অভিজ্ঞতা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছিল। সেই সময়ে লেখক এবং সন্ন্যাসীরা নিজেদের একান্ত প্রচেষ্টায় শ্রমসাধ্যভাবে বিভিন্ন পান্ডুলিপির অনুলিপি এবং জ্ঞান বিস্তারের কাজে কুইল কলম ব্যবহারের প্রচলন ঘটান। এর কিছুকাল পরেই সমগ্র ইউরোপ জুড়ে জ্ঞান সংরক্ষণ এবং শিক্ষা বিস্তারের কাজে এই জাতীয় কলমের ব্যবহার ক্রমেই বাড়তে থাকে।

পরবর্তীতে রেনেসাঁর সময়কে এই কলম শিল্পের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একই সময়ে ১৭ শতকে বিকশিত ইস্পাত নিবের মতো উদ্ভাবনগুলো লেখকের লেখার স্থায়িত্ব এবং গুণগতমানকে আরও উন্নত করেছে। তবে যাইহোক, ১৭ শতকের প্রথম দিকে কিন্তু সত্যিকারের ফাউন্টেন পেনের আবির্ভাব ঘটেনি। এর প্রথম আবির্ভাব ঘটে ১৬৩৬ সালে, জার্মান উদ্ভাবক ড্যানিয়েল শোয়েন্টারের হাত ধরে।

শোয়েন্টার একটি অন্ত:র্নির্মিত কালির জলাধারসহ একটি কলম তৈরি করেছিলেন, যা একটি অবিচ্ছিন্ন কালি প্রবাহ করতে সক্ষম। তার এই নকশাটিই পরবর্তীকালে ফাউন্টেন পেনের বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করে দিয়েছিল। ১৯ শতকের শিল্প বিপ্লবের সময়কালে কলম শিল্পের উৎপাদনে ব্যাপক উৎপাদন কৌশল যোগ করা হয়। ১৮২৭ সালে জন জ্যাকব পার্কারের হাত ধরে পেটেন্ট করা ইস্পাত কলমের নিব, লেখার উপকরণের প্রধান সামগ্রী হয়ে ওঠে।

সেখানে স্টিলের নিবের স্থায়িত্ব এবং নমনীয়তা মসৃণ লেখা প্রদানে সহায়তা করে এবং এটি এই কলমগুলোর গ্রহণ যোগ্যতা সাধারণ মানুষের কাছেও আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সময়ে পুনরায় প্রতিস্থাপনযোগ্য কালি কার্তুজের সাথে ফাউন্টেন পেনের প্রবর্তনও লক্ষ্য করা যায়, যা লেখককে বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করতে সক্ষম ছিল।

হরেক রকমের ফাউন্টেন পেন, Image Source: Promotional Pens Australia

এরপর ২০ শতকে এসে বলপয়েন্ট কলমের প্রবর্তনের সাথে সাথে কলম শিল্পে আরো একটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার প্রত্যক্ষ করা গেছে। ১৯৩৮ সালে, লাসজলো বিরো, যিনি পেশায় একজন হাঙ্গেরিয়ান-আর্জেন্টিনীয় সাংবাদিক ছিলেন। তিনি একটি কলম ব্যবহার করেছিলেন যার কালি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে কলমটির ডগায় একটি ছোট বল ব্যবহার করা হয়েছিল। তার এই উদ্ভাবন কলমকে দোয়াতে ডুবানোর প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে মসৃণ লেখা পাবার অভিজ্ঞতা দিয়েছিল।

বলপয়েন্টের কলমগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এসে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কারণ এটি উচ্চ উচ্চতায় এবং ভূপৃষ্ঠের যেকোনো স্থানেই লেখার ক্ষেত্রে ভালো ফলাফল দিতে পেরেছিল। ২০ শতকের শেষে এসে, রোলারবল এবং জেল কলম সেই সময়কার ঐতিহ্যগত বলপয়েন্ট কলমের বিকল্প হিসেবে মার্কেটে আবির্ভূত হয়।

এই দুটি কলমের মধ্যে রোলারবল কলমে একটি জল-ভিত্তিক কালি ব্যবহার করা হয়েছিল, যা লেখকদের মসৃণ এবং আরও তরল লেখার অভিজ্ঞতা দিয়েছিল। এরপর জেল কলম এসে, ১৯৮০ এর দশকে তরল কালি এবং বলপয়েন্ট কলমের সুবিধাগুলোকে একত্রিত করে, যা লেখায় প্রাণবন্ত রঙ এবং মসৃণ লাইন সরবরাহ করতো। বর্তমানে এই কলমগুলো শিল্পী এবং ছাত্র উভয়ের কাছেই সমানভাবে জনপ্রিয়।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে ডিজিটাল প্রযুক্তির আবির্ভাব টাচস্ক্রিনকে সঠিকভাবে ব্যবহারের লক্ষ্যে ডিজাইন করা অত্যাধুনিক স্টাইলিশ কলম তৈরির দিকে মনোনিবেশ করা হচ্ছে। এই কলমগুলো ব্যবহারকারীদের স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেটের মতো ডিভাইসগুলোর সাথে যুক্ত থাকে এবং স্ক্রিনে সরাসরি লিখতে এবং আঁকাতে সহায়তা করার পাশাপাশি প্রযুক্তির সাথে মানুষের যোগাযোগ পদ্ধতিতে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছে।

বহু পুরনো রিড কলম, Image Source: Joseph Brodsky’s Cat-Tumbir

কলমের ইতিহাস মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং উদ্ভাবনের জন্য আমাদের নিরলস সাধনার প্রমাণ। বহু পুরনো সাধারণ রিড কলম থেকে অত্যাধুনিক লেখনীর কলম পর্যন্ত, লেখার উপকরণের যে বিবর্তন তা সমাজের পরিবর্তিত চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে।

যেহেতু আমরা প্রতিনিয়তই আমাদের সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে আমাদের এই পৃথিবীকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, যেখানে কলম মানুষের অগ্রগতির একটি স্থায়ী প্রতীক এবং জ্ঞান বোঝার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসাবে আজও রয়ে গেছে।

যদিও কুইল কলমগুলো লেখকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তবে সেগুলো তৈরি করার প্রক্রিয়াটি ছিল বেশ জটিল। উদাহরণস্বরূপ বলতে গেলে বলতে হবে, বিখ্যাত ইতালিয়ান চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিপরীত কলমের কথা। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি ১৫ শতকের শেষদিকে এসে নিজেই একটি অনন্য কলম ডিজাইন করেছিলেন, যাকে উল্টানো যেতো।

ভিঞ্চির ডিজাইন করা কলম। Image Source: newpentrace.net

ভিঞ্চির তৈরি এই কলমটি ব্যবহারের দুটি পদ্ধতি ছিল, যার একটি উভয় প্রান্তে ব্যবহার করা যেতো, আর অন্যটি হলো বিভিন্ন নিবের আকারেও ব্যবহার করা যেতো। এই উদ্ভাবনের ফলে ভিঞ্চি বিভিন্ন কলমের প্রয়োজন ছাড়াই লেখা এবং আঁকার মধ্যে পরিবর্তনের পার্থক্য বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এসে বলপয়েন্ট কলম ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করলেও এটি চ্যালেঞ্জ মুক্ত ছিল না কখনোই। এদিকে কলমটি থেকে কালি ফুটো হয়ে বেরিয়ে আসার সমস্যাটিও ক্রমেই বাড়তে থাকলো, যা পরে স্পেস পেনের বিকাশে সহায়তা করে।

স্পেস পেন সর্বপ্রথম তৈরি করে নাসার বিজ্ঞানী পল সি. ফিশার। এই কলমটি তৈরিতে একটি চাপযুক্ত কার্তুজ ব্যবহার করা হয়েছিল, যাতে কালি বাইরে বেরিয়ে আসতে না পারে। কলমটি খ্যাতি অর্জন করে যখন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এটিকে মহাকাশে নভোচারীদের ব্যবহারের জন্য পাঠায়, এর আগে মহাকাশে শুধু পেন্সিল ব্যবহার করা যেতো।

প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কালে কলমের বিবর্তন চিত্র ,Image Source: Graf Von Faber Castell

তাছাড়া, কলমের বিস্তার পর্যালোচনা করতে গেলে জানা যায়, প্রাচীন রোমানরা একটি উদ্ভাবনী কালি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল যা সহজেই মুছে ফেলা যেতো। এই কালি কার্বন কালি নামেও পরিচিত ছিল, যা কালি এবং আঠা থেকে তৈরি করা হয়।

আজ, কলম নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এর উদ্ভাবন এবং স্থায়িত্বের উপর ফোকাস করছে। তাছাড়া, এর পরিবেশ বান্ধব বিকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ এবং রিফিলযোগ্য কালি কার্টিজ থেকে তৈরি কলম সমূহ, যা পরিবেশগতভাবেই সচেতন পণ্য উৎপাদনে সহায়তা করে।

কলমের ইতিহাস, সংস্কৃতি, উদ্ভাবক এবং উদ্ভাবন প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে বলা যায়, প্রাচীন রিড কলম থেকে আধুনিক লেখার কলম পর্যন্ত আজ অবধি যত কলম এসেছে সেগুলোর প্রত্যেকটিই আমাদের লেখার উপকরণ হিসেবে বিবর্তন মানবতার সৃজনশীল চেতনা এবং আমরা দৈনন্দিন লেখার কাজে যে সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করি সেগুলোকে উন্নত করার নিরলস প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করে।

 

 

 

Featured Image: Statesman Stationery 
References: 

01. Pen Writing Implement. 
02. The History of Pens. 
03. History of the Pen.