রুদাকি: ফারসি কবিতার জনক

248
0

মুলিয়ান নদীর মিষ্টি সুবাস,
মনে পড়ে এতদিন আগের ফেলে আসা স্মৃতি।
আমার পায়ের নিচে অক্সাসের রুক্ষ বালি,
সিল্কের মতো নরম আর মিষ্টি তাদের আদর।

ফেলে আসা স্মৃতি, বিশেষ করে আমাদের ছোটবেলার দিনগুলো আটকে থাকে কিছু স্থান, প্রকৃতি আর মানুষের মাঝে। এর মধ্যে শান্তি আছে, আরামদায়ক উষ্ণতা আছে যা কঠিন সময়ে শক্তি দেয়। ঠিক এই কবিতাটির মতো।

প্রচলিত আছে, এই কবিতার রচয়িতা জন্মান্ধ ছিলেন। আর তাই হয়তো তার অন্যান্য ইন্দ্রিয় দিয়ে তিনি চারপাশের পরিবেশ অন্যদের থেকে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন। তবে এই কথা সঠিক হোক বা না হোক, কবি তার জীবনে কিছু সুন্দর এবং অবিস্মরণীয় কবিতা লিখেছিলেন। প্রতিভাবান এই কবির নাম রুদাকি, তাকে ফারসি কবিতার জনকও বলা হয়।   

রুদাকি নতুন ফারসি ভাষায় অর্থাৎ, বর্তমান ফারসি ভাষায় আরবি হরফে রচনাকারী প্রথম আলোচিত কবি। ২২৪ খ্রিষ্টাব্দে সাসানীয় শাসনের পর থেকে, এমনকি পরবর্তী আরব বিজয়ের পরেও, ফারসি ছিল এই অঞ্চলের সরকারি ভাষা। ফারসি পরবর্তী মুসলিম রাজবংশের সরকারি ভাষা হিসাবে টিকে ছিল, যদিও আরবি লিপিতে লেখা এটিকে ‘নতুন ফারসি’ বলা হতো। নতুন ফারসি, পুরানো ফারসিভাষী সীমানার বাইরে মধ্য এশিয়ায়, এমনকি উত্তর ভারতেও ছড়িয়ে পড়ে। 

পরিচয় 

রুদাকির পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ জাফর ইবনে মোহাম্মদ। জন্ম সম্ভবত ৮৬৯ সালে, বর্তমান তাজিকিস্তানের রুদাকে এবং মৃত্যুও একইস্থানে সম্ভাব্য ৯৪০/৯৪১ সালে। কবিতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান গায়ক এবং যন্ত্রবাদক। রুদাকি ভালো বীণা বাজাতেন। তার কণ্ঠে ছিল জীবন ও সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা। খোরাসানি শৈলীতে স্তুতি গাইতেন, সাথে গান, গজল এবং মাথনবিও রচনা করতেন। তিনি রুবাই বা চার লাইনের বিশেষ ধরনের কবিতা উদ্ভাবনের জন্যও পরিচিত। 

ফারসি পাণ্ডুলিপিতে রুদাকির কবিতা Image source: Wikipedia by Christies.com

প্রাথমিক জীবন 

রুদাকির প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। সেই সময়ের কিছু জীবনীকার উল্লেখ করেছেন, তিনি জন্মান্ধ ছিলেন। কিছু পণ্ডিত বলেছেন, তিনি রঙ এবং বর্ণনার প্রাণবন্ত ব্যবহারে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। রুদাকি, বুখারাতে সামানিদ শাসক দ্বিতীয় নাসার (৯১৪-৪৩)-এর দরবারে, ৯৩৭ সালে তার অনুগ্রহ হারানোর আগ পর্যন্ত কবি হিসাবে কাজ করতেন। তার পুরো জীবন কষ্ট আর দরিদ্র্যতার মধ্যে গিয়েছে।

তার সম্পর্কে প্রচলিত গল্প থেকে জানা যায়, যে শেষ জীবনে নির্যাতনের স্বীকার হয়ে খুব সম্ভবত তিনি অন্ধ হয়ে যান। অন্যরা মনে করে যে, তিনি আমিরের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজের শিকড়ে অর্থাৎ, জন্মস্থানে ফিরে আসেন। 

কাব্যশৈলী 

তার আনুমানিক ১০০,০০০টি কবিতার কথা জানা যায়। এর মধ্যে ১,০০০টিরও কম টিকে আছে, যা অনেক সংকলন এবং জীবনীমূলক কাজের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তার কবিতাগুলো একটি সাধারণ শৈলীতে লেখা, যার মধ্যে রয়েছে আশাবাদ এবং মনোমুগ্ধকর কাব্যময়তা এবং তার জীবনের শেষ দিকের মর্মস্পর্শী বিষাদ। 

সাহিত্যে তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো ‘কালিলাহ ওয়া দিমনা (Kalīla wa-Dimna)’-এর আরবি থেকে নতুন ফারসি ভাষায় অনুবাদ। রুদাকির এই মহান রচনাটিও হারিয়ে গেছে এবং আর পাওয়া যায়নি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই উপকথাগুলো নতুন করে রচনার জন্য, রুদাকির এই হারিয়ে যাওয়া অনুবাদের উপর অনেক বেশি ঋণী, যা পারস্য-মুসলিম সাহিত্যে তার খ্যাতি নিশ্চিত করেছে।

কালিলাহ ওয়া দিমনা-এর আরবি সংস্করণ Image source: Wikipedia

স্বীকৃতি 

ধ্রুপদী ফারসি কবিতার জনক হিসাবে, রুদাকির বিশ্বে একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। রুদাকি তাজিক-ফারসি ভাষার একজন অগ্রদূত হিসাবেও পরিচিত। কবির জন্য সর্বদা বিভিন্ন স্মরণসভা ও অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তার ভাস্কর্যগুলো পারস্যভাষী দেশগুলোর বিভিন্ন শহরের চত্বরে স্থাপন করা হয়েছে। বুধ গ্রহের একটি সংঘর্ষের স্থানের নামকরণ করা হয়েছে কবির নামে। 

তার মৃত্যুর পর থেকে, রুদাকি তার কল্পনার চেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছে। ২০০২ সাল থেকে তার সমাধিতে ‘রুদাকি দিবস’ এর সাথে মিল রেখে ২২ সেপ্টেম্বর একটি স্মরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। একটি জাতির জাতীয় নায়ক হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। 

তাজিকিস্তানে এখন রাস্তা, স্কুল পার্ক পুরস্কার এবং গ্রন্থাগার রয়েছে যা এই প্রাচীন কিংবদন্তির নামে নামকরণ করা হয়েছে। পাঞ্জাকেন্টে কবির মূর্তিগুলো সারা দেশের বেশিরভাগ শহরের শোভাবর্ধন করে।  

রুদাকির ভাস্কর্য Image source: World History

সমাধি 

তাজিকিস্তান প্রজাতন্ত্রে অবস্থিত তার সমাধিটি, রুদাকি নামের সাথে সংযুক্ত সমস্ত আড়ম্বর এবং অনুষ্ঠান থেকে শান্ত এবং খাঁটি। এটি ১৯৫৮ সালে নির্মিত হয়েছিল। এর পরিবেশ, মনোরম বাতাস এবং পবিত্রতা একটি শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। একটি সাজানো বাগানের মধ্যে অবস্থিত এবং প্রচুর গোলাপের ঝোপ দ্বারা বেষ্টিত, সমাধিটি সাধারণের মধ্যে ভিন্ন। গেট দিয়ে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেই দেখা যাবে উপরে কবির সবচেয়ে বিখ্যাত বাণী, 

এই পৃথিবীতে বন্ধুদের মুখ দেখার চেয়ে
বড় আনন্দ আর কিছু নেই।

নুড়ি রাস্তাটি পাথুরে এবং এবড়োখেবড়ো। সমাধির কাছে যাওয়ার সাথে দেখা যাবে অনেক ফুল এবং আশেপাশে পাহাড়। তারপরই চখে পড়বে সবুজ গম্বুজযুক্ত ইট-নির্মিত কাঠামো এবং সুচারু খোদাই করা কাছে দরজা। মাজারের ভিতরে পুরনো সাদা দেয়াল, মাঝখান থেকে উজ্জ্বল সূর্যের আলো একদম শীর্ষ থেকে ভেতরে প্রবেশ করছে। 

রুদাকির বিশ্রামের স্থানটি একটি পরিষ্কার-কাটা মার্বেল স্ল্যাব দ্বারা চিহ্নিত। উপরে ফারসিতে রুদাকির কথা লেখা,

যারা অভিজ্ঞতা থেকে শেখে না
তারা শিক্ষকের কাছ থেকে কিছুই শিখবে না।

রুদাকির সমাধি Image source: Wikipedia by Jamal Nazareth

এছাড়াও, সমাধির মাঠের মধ্যে, রুদাকির জীবন এবং সুগদ অঞ্চলের নিদর্শনগুলো প্রদর্শন করে একটি ছোট জাদুঘর রয়েছে। এছাড়াও, একটি ছোট লাইব্রেরি রয়েছে যেখানে রুদাকি এবং অন্যান্য বিভিন্ন ফারসি কবিদের কিছু বই রয়েছে।

পশ্চিমা পণ্ডিতরা তাকে ইরানের হোমার এবং তাজিকিস্তানের চাসার বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, রুদাকি যে সময়ে তার দুর্দান্ত মাস্টারপিসগুলো লিখেছিলেন, ইউরোপ তখন অন্ধকার যুগের মধ্য দিয়ে লড়াই করছিল। রুদাকির সময় থেকে এগিয়ে থাকা এবং দার্শনিকতার পরিচয় পাওয়া যায় এই লাইন দুটিতেও।

কোন সাধারণ শিক্ষক কখনই পৌঁছাবেন না,
যাদের সময় শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। 

রুদাকি, দৃষ্টিশক্তির আশীর্বাদ থেকে হয়তো বঞ্চিত ছিলেন, তবে তার চিন্তা এবং কাজ তাকে অনন্য করে তুলে ছিলেন।ইরানে রুদাকিকে অন্যতম সেরা বলে মনে করা হয়। রুদাকির কবিতা তার কল্পনাশক্তি, ভাবপ্রবণতা এবং শব্দের সুসংগততার প্রতিনিধিত্ব করে এবং এই কারণেই তিনি সামানিদ দরবারে একটি উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। 

 

 

 

Featured Image: Wikidata 
References:

01. Biography/Rudaki. 
02. Celebrities/Rudaki. 
03. Rudaki-Singer-Musician-and-Poet. 
04. Tomb-of-Rudaki-Tajikistan. 
05. Tajikistan/Abu-Abdullah-Rudaki.