নিশিয়ামা ওনসেন কিউকান: পৃথিবীর এক প্রাচীনতম হোটেল

192
0

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম হোটেলটি জাপানের শহর হায়াকাওয়াতে এর ছোট্ট এক গলির মাঝে আকাইশি পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত। ৭০৫ সালে কিয়ান সাম্রাজ্যের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত ১৩২৮ বছরের পুরনো এই প্রাচীনতম হোটেলটি আজও মানুষের চাতুর্য এবং আতিথেয়তার চিরন্তন প্রমাণ হিসেবে জাপানের ভূখন্ডে স্ব-গৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।

হায়াকাওয়াতে শহরের প্রাচীন এই স্থাপনাটি প্রতিনিয়তই স্মৃতির পাতায় অতীতের প্রতিধ্বনি রেখে চলেছে বহু শতাব্দী ধরে, যা এখানে ভ্রমণকারী থেকে শুরু করে স্থানীয় রাজা এবং অঞ্চলটির ঐতিহ্যগত দিকগুলোকেই পরোক্ষভাবে বর্ণনা করে। বর্তমান বিশ্বে জাপানের প্রাচীনতম এই হোটেল, ওল্ড ওয়ার্ল্ড হোটেল নামে পরিচিত হলেও জাপানি ভাষায় একে বলা হয় নিশিয়ামা ওনসেন কিউনকান।

জাপানের কিয়ান সাম্রাজ্যের জনপ্রিয় সম্রাট তেনজির শাসনকালে ৩৭ কক্ষ বিশিষ্ট এই হোটেলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যার প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং সম্রাটের ঘনিষ্ঠ সহোচরের পুত্র নিজেই, যার নাম ফুজিওয়ারা মাহিতো। পরবর্তী সময়ে এসে বিশ্ববাসীর কাছে হোটেলটি একটি অতুলনীয় বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে, যা হাজারো হারানো ইতিহাসের সাক্ষী।

জাপানের হায়াকাওয়াতে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম হোটেল। Image Source- Gaijinpot Blog

যাত্রা শুরুর পর থেকে হোটেলটির মলিকানায় একাধিকবার হাতবদল হয়েছে ঠিকই। কিন্তু প্রতিটি মালিকই তার নিজস্ব ভঙ্গিতে হোটেলটিকে পরিচালনা করে গেছেন, যা এর স্থাপত্যশৈলি ও কারুকার্যেই স্পষ্টত। হোটেলটির স্থাপত্যশৈলী সময় বদলানোর সাথে সাথে বিভিন্ন যুগের দ্বারা প্রভাবিত, যার ভিত্তি হিসেবে এর ধ্রুপদী স্থাপত্য রীতিকে ধরা হয়। আর এর প্রমাণ মিলে হোটেলটির জটিল ডিজাইন করা খিলান এবং কলামগুলোতে।

শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫২ প্রজন্মের হাত ধরে অপরিবর্তিত রয়ে গেছে হোটেলটির কার্যভার। দর্শনার্থীদের কাছে বর্তমান সময়ে এসে হোটেলটি ভ্রমণ এবং এর ভেতরে প্রবেশ অনেকটা টাইম ট্রাভেলে করে হারিয়ে যাবার মতোই অনুভূতি দিয়ে থাকে। বর্তমানে প্রাচীন এই স্থাপনাটির সুশোভিত প্রতিটি কক্ষ চমৎকার প্রাচীন জিনিসপত্র এবং তৎকালীন সময়ের গৃহসজ্জার সামগ্রী দিয়ে সুসজ্জিত, যা হোটেলটির অতীত স্বর্ণযুগের কথাই দর্শনার্থীদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়।

বিশ্ব বিখ্যাত সেলিব্রিটি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ গেস্ট হিসেবে ওল্ড ওয়ার্ল্ড হোটেলের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন, এখনো করছেন। হোটেলটিতে ঢোকার পথের একটি দেয়ালে এর বর্ণাঢ্য ইতিহাস এবং হোটেলটিতে নানা সময়ে আগত বিখ্যাত সব অতিথিদের একটি স্মারক বোর্ডও ঝোলানো রয়েছে।

গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের পক্ষ থেকে বিশ্বের প্রাচীনতম হোটেলের সনদপত্র। Image Source: yahoo lifestyle

যেখানে হোটেলটিতে নানা সময়ে আগত দেশ-বিদেশের বহু সম্মানিত ব্যক্তি থেকে শুরু করে খ্যাতনামা শিল্পী, এমনকি প্রখ্যাত রাষ্ট্রনায়কদের স্মারকলিপিও আইকনিক এই স্মারক দেয়ালে প্রত্যক্ষ করা গেছে। তাছাড়া, এখানে আগত প্রায় সকল অতিথিই হোটেলটির গেস্টবুকে একটি অনন্য চিহ্ন রেখে গেছেন, যা সময়ের ইতিহাসে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে এবং এখানটায় আগত অতিথিদের কৌতূহলী করে তোলে।

তাছাড়া হোটেলটির প্রাচীরগুলো নিজেরাই এক একটি প্রাচীন সভ্যতার স্বাক্ষী। বর্তমানে যারা হোটেলের স্টাফ সদস্য হিসেবে কর্মরত রয়েছেন, তারা হোটেলটির অতীতের আকর্ষণীয় সব গল্পের সাথে এখানে আগত অতিথিদের আমন্ত্রণ জানান, যা আগত অতিথিদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।

হোটেলটিতে সর্বশেষ সংস্কার কাজ করা হয় আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে, আনুমানিক ১৯৯৭ সালে। তবে, বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে হোটেলটিতে রয়েছে বিলাসবহুল স্পা সেন্টার থেকে শুরু করে বিশ্বমানের খাবার ব্যবস্থা, অত্যাধুনিক শরীর চর্চা কেন্দ্র, সুইমিংপুল, ইনডোর গেম, বারসহ নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের উপযোগী অত্যাধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা।

বিখ্যাত ওল্ড ওয়াল্ড হোটেলের ভেতরের একটি কক্ষ এটি, Image Source:Travel+Leisure

ওল্ড ওয়ার্ল্ড হোটেলটি আন্তর্জাতিকভাবেও বেশ সমাদৃত এবং বর্তমানে এটি গর্বের সাথে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন এই হোটেলটিকে নিয়ে লোকমুখে বেশ কিছু জনপ্রিয় কাহিনীও প্রচলিত। ধারণা করা হয়, বর্তমান হোটেলটির স্থানে সর্বপ্রথম একটি সরাইখানা ছিলো। সেই সরাইখানার মালিক সেখানে আগত অতিথিদের নিজের সাধ্য অনুযায়ী আতিথেয়তা দিয়ে বরণ করে নিতেন।

কথিত আছে, তিনি এক ঝড়ের রাতে একজন ভ্রমণকারীর কাছ থেকে কিছু দর্শন লাভ করেন, যিনি মূলত দেবতা ছিলেন এবং ছদ্মবেশে তার কাছে এসেছিলেন। তিনি সরাইখানার মালিকের উদারতা ও আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে তাকে এই বলে আশীর্বাদ করেছিলেন যে, তার এই সরাইখানাটি তার আতিথেয়তার প্রতীক হিসেবে আগামী কয়েক শতাব্দী ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। আর শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে, আজ সেই সরাইখানাটিকে আমরা বর্তমান রূপে দেখতে পাচ্ছি, যা সরাইখানা থেকে দুর্দান্ত এক হোটেলে নিজেকে রূপান্তরিত করেছে।

চলার পথে হোটেলটি তার দীর্ঘ অস্তিত্ব জুড়ে, বহু ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষ্য বহন করছে। হোটেলটি পৃথিবীর বহু প্রাচীন যুদ্ধ, বিপ্লব এবং শান্তিচুক্তিরও স্বাক্ষী হয়ে আছে। হোটেলটির দেয়ালে আজও এখানে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন কালজয়ী চুক্তি, জোট গঠন এবং গোপন সব তথ্য আদান-প্রদানের স্মারক স্মৃতি হিসেবে লিপিবদ্ধ।

ওল্ড ওয়াল্ড হোটেলটির আধুনিক স্থাপত্য কাঠামোর অংশ বিশেষ, Image Source-Travel+Leisure

তাছাড়া, হোটেলটির স্থাপত্য কাঠামোতে হরেক স্থাপত্য শৈলীর সংমিশ্রণ লক্ষণীয়, যা এটিকে আরও বিস্ময়কর করে তুলেছে। হোটেলটির নির্মাণ অবকাঠামো এবং এর সুসজ্জিত কলাম, দেয়ালে অলঙ্কৃত খোদাই, এখানটায় গত হওয়া সময়ের স্মৃতিগুলোকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। হোটেলটির মূল্যবান সম্পদের মধ্যে এখনো রয়ে গেছে এর প্রাচীন চিত্রকর্মগুলো, সেই সাথে আছে প্রাচীন পাণ্ডুলিপিও।

শুধু তাই নয়, আছে এর বিস্তৃত সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ সমূহও, যা যুগ যুগ ধরে নানান ইতিহাসের স্বাক্ষ্য বহন করছে। এখানকার প্রতিটি শিল্পকর্মেরই একটি আলাদা গল্প আছে, যা আমাদের সময়ের আগে যারা এসেছিলেন তাদের জীবন ধারার বর্ণনা দেয়, বর্ণনা দেয় সেই সময়কার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের।

বর্তমানে এই ওল্ড ওয়ার্ল্ড হোটেলের নিজস্ব একটি ফাউন্ডেশন রয়েছে, যার সমাজের প্রতিও বেশ কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। ফাউন্ডেশনটি সামাজের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সামাজিক অনান্য বিষয়েও সমানভাবে ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে মনে রাখা জরুরি, এই ওল্ড ওয়ার্ল্ড হোটেলের ফাউন্ডেশনটি একটি অলাভজনক সংস্থা, যারা বিশ্বজুড়ে শিক্ষা, ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উন্নয়ন উদ্যোগকে সক্রিয় ভাবে সমর্থন করে।

এখান থেকেই পরিচালিত হয় ওল্ড ওয়াল্ড হোটেলের সামাজিক সকল কার্যক্রম,Image Source:EaseMyTrip

পাশাপাশি তারা সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির অর্থায়ন থেকে শুরু করে পরিবেশ সংরক্ষণ প্রকল্পে অংশ নেয় অর্থাৎ ফাউন্ডেশনটি সকলদিক থেকেই সমান ভাবে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে যথেষ্ট কাজ করে যাচ্ছে।

ওল্ড ওয়ার্ল্ড হোটেলটি বিশ্বের প্রাচীনতম একটি হোটেল, যেটি মানব সভ্যতার সারাংশও বটে। হোটেলটির স্থাপত্যরীতি আজও এক আশ্চর্য বিস্ময়েরই নাম, যেটি সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণ ও এর তাৎপর্যের একটি জীবন্ত প্রমাণ। প্রাচীন এই হোটেলটির  মনোমুগ্ধকর স্থাপত্য শৈলি এবং কালজয়ী ঐতিহ্য থেকে টেকসইয়তা একে আজও বিশ্ববাসীর কাছে অনন্য করেই রেখেছে।

তাছাড়া, সৃষ্টিলগ্ন থেকেই হোটেলটি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে জড়িত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার আতিথেয়তা এবং শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিক্রম করেছে। সাম্প্রতিক কালে এসে, হোটেলটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন হোটেল হিসেবে গিনেজ বুক অব ওয়াল্ড রেকর্ডসে জায়গা করে নিয়েছে। প্রাচীন এই হোটেলটিতে এখনো পর্যটকেরা আসেন আগ্রহ নিয়ে তাদের অবসর কাটাতে, হোটেলটির বহু পুরনো রোমাঞ্চকর কক্ষে রাত্রিযাপনে।

 

 

 

Featured Image: Startup Pakistan 
References:

01. The World's Oldest Hotel Has Been in the Same Family for 52 Generations. 
02. 10 of the World's Oldest Hotels. 
03. What it’s like to stay at the world’s oldest hotel.