প্রডিজি শকুন্তলা দেবী: একুশ শতকের মানব কম্পিউটার

248
0
Shakuntala-Devi
Sources: tumblr.com

এশিয়া মহাদেশে, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রডিজির সংখ্যা তুলনামূলক কম। আজ থেকে প্রায় ৯০-৯৫ বছর আগে তো সেই সংখ্যা ছিল আরো কম। কারণ ছিল, ধর্মীয় কুসংস্কার, সুযোগের অভাব, শিক্ষার অভাব ইত্যাদি।

এর আগে জানা দরকার প্রডিজি কী? বা কারা? প্রডিজি বা Prodigy হলো সেই সব মানুষ যাদের প্রকৃতিগতভাবেই রয়েছে অসাধারণ গুণাবলী। এবং খুব ছোট বয়েসেই সেই প্রতিভা দেখতে পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ১০০ বছর আগে জন্মেছিলেন এমনই এক নারী প্রডিজি।

বাবা সার্কাসকর্মী হবার সুবাদে তার বেড়ে ওঠা ছিল সার্কাস ঘিরেই। সার্কাসের তাবু থেকে কীভাবে তার নাম উঠল গিনেজ ওয়ার্ল্ড বুকে? ১৩ অংকের দুটো সংখ্যা হোক কিংবা ২৩ অংকের হোক, তার গুণ করতে ৩০ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগতো না। গণিতবিদ্যায় অসাধারণ দক্ষতার পাশাপাশি জ্যোতির্বিদ্যাতেও ছিল তার অগাধ বিচরণ। তিনি হলেন শকুন্তলা দেবীলেখক হিসেবেও যার নাম বেশ গর্বের সাথে উচ্চারিত হয়।

sources: postoast.com

শুরুর গল্প

প্রডিজি শকুন্তলা দেবীর জন্য ১৯২৯ সালে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর কর্ণাটকের গুট্টাহল্লী গ্রামে। হতদরিদ্র এই হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের পেশা ছিল সার্কাসে কাজ করা। বাবা সুধারা রাজা রাও সার্কাসে কাজ করতেন। সাড়ে তিন বছর বয়েসে তিনি দেখেন তার মেয়ে তাসের নম্বর মুখস্ত করে ফেলেছে। সেই সময়ে তার বাবা গুরুত্ব না দিলেও পাঁচ বছর বয়সে আর অবহেলা করতে পারেননি।

প্রথমবারের মতো গণিতকে সার্কাসের মঞ্চে আর দশটা খেলার মতো করে উপস্থাপন করা হলো। মাত্র এক বছরের মধ্যে তার এই অসাধারন প্রতিভা দেখাবার সুযোগ পান মাইশোর ইউনিভার্সিটিতে। সেই ছোট বয়সেই পরিবারের হাল ধরেছিলেন তিনি। বলা ভালো তিনিই ছিলেন সেই সময়ে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ছয় বছর বয়সের সেই শো ছিল প্রডিজি শকুন্তলার জীবনের আলোর দিশা।

হিউমান কম্পিউটার শকুন্তলা দেবীর গল্প

শকুন্তলা দেবী যেমন বড় বড় সংখ্যার গুণ যেমন করতে পারতেন, তেমনই বর্গমূল আর উচ্চতর বর্গমূল বের করতে পারতেন। ছোটবেলায় বাবা তাকে মজার ছলে ক্যালকুলেটর বলে ডাকতেন। এই নাম যে সত্যি হয়ে উঠবে তা হয়তো কেউই ভাবেননি। সময়টা ১৯৫০ সাল, বিবিসির একটি অনুষ্ঠানে নিজের প্রতিভার পরিচয় দেন শকুন্তলা দেবী। একের পর এক জটিল সংখ্যা নিয়ে চমক দেখাতে থাকেন।

Sources: mid-day

এক পর্যায়ে কম্পিউটার আর শকুন্তলা দেবীর উত্তরে গরমিল দেখা যায়। লেজলি মিসেলের উপস্থাপনায় এই অনুষ্ঠানে প্রমাণিত হয় কম্পিউটারের গণনা ভুল। পরবর্তীতে রোমের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই রকম ঘটনা ঘটে। এই সব খ্যাতির দরুণ এক সময় তাকে মানব কম্পিউটার নামকরণ করা হয়।

১৯৮০ সালের ১৮ জুন, ইম্পেরিয়াল কলেজ অব লন্ডনে ১৩ অংকের দুটো সংখ্যা ৭,৬৮৬,৩৬৯,৭৭৪,৮৭০ এবং ২,৪৬৫,০৯৯,৭৪৫,৭৭৯ মাত্র ২৮ সেকেন্ডে সমাধান করে দেন। সেদিনের পর থেকে যেন তার পরিচিতি অন্য এক মাত্রা পায়। শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি তিনি এই নম্বরগুলো লিখতে খাতা বা কলম কিংবা পেনসিল করেননি। এর আগে ১৯৫০ সালের দিক থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনি তার দক্ষতার পরিচয় রাখতে শুরু করেন।

১৯৪৪ সালে প্রথম দেশের বাইরে পা রাখেন লন্ডনে। যে ওপেন শো তিনি করতেন, দর্শকদের থেকে সরাসরি প্রশ্নগ্রহণ করতেন, ১০ নাম্বারের কিউব রুট কিংবা ৭ ডিজিট নাম্বারের রুট বের করতে তৎকালীন সময়ের কম্পিউটারের সময়ের চাইতেও অনেক কম সময় নিতেন।তিনি এতটাই বুদ্ধিমতি ছিলেন যে, কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও দক্ষতার সাথে যেমন অংক কষেছেন, অন্যদিকে যেকোন বছরের, যেকোন মাসের বার এবং দিন নির্ভুলভবে বলতে পারতেন। একটু আগেই ১৩ ডিজিটের দুটো সংখ্যার কথা বলছিলাম।

Sources: nytimes.com

এর ঠিক দু’ বছর পর, এই অসাধারন প্রতিভাসম্পন্ন শকুন্তলা দেবীর নাম গিনেস বুক অব রেকর্ডসে স্থান পায়। ১৯৮০ সালে তার নাম হিউমান কম্পিউটার নামকরণ করা হয়। তার অনেক কীর্তির মধ্যে আর একটা হলো ২০১ ডিজিটের একটি নম্বরের ২৩তম রুট মাত্র ৫০ মিনিটে বের করে দেয়া। এটা ১৯৮৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্ণিয়ার আর্থার জেনসন, সাইকোলোজির অধ্যক্ষকে অবাক করে দিয়েছিল।

বহুগুণসম্পন্না এই নারী ১৯৮০ সালে দক্ষিণ মুম্বাই (বোম্বে) এবং মেদাক (বর্তমান তেলাঙ্গানা) থেকে লোকসভা নির্বাচণে ইন্দিরাগান্ধীর বিপরীতে লড়েছিলেন। যদিও তিনি জয়লাভ করতে পারেননি। এরপর থেকে তিনি জোতির্বিদ্যায় বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি একাধিক বই লিখেছেন জোতির্বিদ্যা, নাম্বার, পাজল, হিউমান মেমোরিসহ আরো অনেক বিষয়ের উপরে।

শোনা যায়, তার স্বামী একজন সমকামী ব্যক্তি ছিলেন, তাই তার ঘটে বিচ্ছেদ। স্বামী পরিতোষ ব্যাণার্জী ছিলেন একজন আইএএস অফিসার। ১৯৬০ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। ১৯ বছর পর, ১৯৭৯ সালে তারা আলাদা হয়ে যান। যদিও মেয়ে অনুপমার মতে তার পিতা সমকামী ছিলেন না।

যদিও শকুন্তলা দেবীর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব হোমোসেকসুয়ালিটি’ বইটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়। বইটি ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হলেও নানা ধরনের সামাজিক এবং ধর্মীয় কারণে অতটা সামনে আসতে না পারলেও পরবর্তীতে বিশ্ববাজারে স্বীকৃতি লাভ করে।

Sources: cuemath

তবে তাদের কন্যা অনুপমা ব্যানার্জীর মতে, তার বাবা সমকামী ছিলেন না। সর্বগুণসম্পন্না শকুন্তলা দেবী নানা বিষয়ে দক্ষতার ছাপ রেখেছেন, সেই বিষয়ে আমরা আগেই বলেছি। তিনি জোতির্বিদ্যা চর্চাতেও অসাধারন ছিলেন। এস্ট্রোলজি ফর ইউ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি।

অনেক বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, মুভি স্টার এবং বিজনেস টাইকুনদের ব্যক্তিগত জ্যোতিষবিদ হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস অনুসারে, তিনি একদিনে ৬০ জন মানুষের জন্মতারিখ, স্থান-কাল সম্পর্কে জেনে তাদের জীবনের যেকোন তিনটি তথ্য সম্পর্কে উত্তর দিতেন।

তার রচিত বই এর মধ্যে- পাজল টু পাজল, সুপার মেমোরি, ইট ক্যান বি ইয়োর্স, ম্যাথাবিলিটি, বুকস অব নাম্বারস উল্লেখযোগ্য। তিনি ক্রাইম থ্রিলারও লিখেছেন। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত এই বই এর নাম ছিল পারফেক্ট মার্ডার। ২০১১ সালে তিনি শকুন্তলা দেবী এডূকেশন ফাউন্ডেশন পাবলিক ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে তিনি কাজ করতে চেয়েছিলেন।

শেষ অধ্যায়

দীর্ঘদিন ধরে কিডনীজনিত রোগ, হৃদরোগে ভুগছিলেন এই মানব কম্পিউটার। কয়েক বছর আগে, ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল নিজ জন্মস্থান বেঙ্গালুরুতে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে তিনি মারা যান। মৃতুকালে তার বয়স ছিল ৮৩ বছর। ২০২০ সালে করোনা চলাকালীন সময়ে, তার জীবনী ভিত্তিক সিনেমা মুক্তি পায়, বিখ্যাত অভিনেত্রী বিদ্যাবালান নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এতে তার জীবন সম্পর্কে সামান্য ধারনা পাওয়া যায়।

তবে শকুন্তলা দেবীর মতো মহিরথীদের নিয়ে যত জানা যায় তত বেশি অবাক হতে হয়। সবাই তাকে মানব কম্পিউটার নামে ডাকলেও নিজে তা মানতে নারাজ ছিলেন। তার মতে, একজন সাধারন মানুষের সাথে কম্পিউটারের তুলনা করা অযৌক্তিক। কারণ মানুষের শক্তি-দক্ষতা কম্পিউটারের চাইতেও বেশি। তার ভাষায়,

Human memory is not merely the repository of information in the brain. It is much more than this, and something that a machine can never be: a power, a force by which we mentally reproduce not just information but also our experiences, by which we shape our perceptions, introspect, interpret and analyze the direction our life has taken.

― Shakuntala Devi, Super Memory: It Can Be Yours

 

 

 

Feature Image: thelogicalindia.com 
Sources:

1. Shakuntala Devi Movie. 
2. Shakuntala Devi. 
3. All About Shakuntala Devi. 
4. Shakuntala Devi. 
5. What was the Secret of Shakuntala Devis Calculating Abilities. 
6. Shakuntala Devi.