আলীকদম: যেখানে বুনো সৌন্দর্য নেয় দম (পর্ব-১)

187
0

আরো একবার চলো ফিরে যাই 
পাহাড়ের ঐ বুকেতে দাঁড়াই
আকাশের হাতছানিতে সারা দেই
কি হবে না ভেবে…!

অফিসে কাজের ফাঁকে এই গান শোনার তালে তালে ‘কি হবে না ভেবে’ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে ঈদের লম্বা ছুটিতে পাহাড়ে যাবো। যেই ভাবনা সেই কাজ। এরিমধ্যে অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে এই নিয়ে বিস্তর আলাপ হয়ে গেল। এমন সময়ে সুসময়ের বন্ধুর মতোই প্রথমবারের মতো অফিস কর্তৃপক্ষ ঈদের ছুটি নির্ধারিত করলো সর্বমোট ৭ দিন। যেজন্য আমাদের হাতে ছিল না ট্যুর এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ। 

কিন্তু পাহাড়ে যে যাবো কুকিচিনের কর্মকান্ডে তো বান্দরবানের অর্ধেকের বেশি অঞ্চল ভ্রমণ নিষিদ্ধের তালিকায়। এখন একটাই পথ খোলা আর সেটা হচ্ছে আলীকদম। বান্দরবানের এই উপজেলাটা বুনো সৌন্দর্যে পূর্ণ। অন্যান্য উপজেলাতে পর্যটকদের আনাগোনা অনেক বেশি হলেও আলীকদমে যাতায়াত ছিল সেই তুলনায় অনেক কম। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্যান্য উপজেলা বন্ধ হওয়াতে আলীকদমই হয়ে উঠেছে পাহাড়প্রেমীদের একমাত্র ভরসা। 

ঈদের দ্বিতীয় দিন রাতে চলে যাই কলাবাগানের শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারে। ঢাকা টু আলীকদমের সরাসরি বাস না পেয়ে ঢাকা টু কক্সবাজারের বাসে টিকেট কেটেছিলাম। কেননা, কক্সবাজার যাওয়ার পথে চকরিয়াতে নেমে আলীকদম যেতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘন্টার কাছাকাছি। ঢাকা থেকে আমাদের বাস ছাড়ে রাত ১০ টায়। আর সকাল ৭টার কাছাকাছি সময়ে নামিয়ে দেয় আমাদের চকরিয়ার নতুন বাসট্যান্ডে। নেমেই ঢুকে পড়ি ভরপেট নাস্তা করতে। কেননা, এরপর থেকেই শুরু হবে আমাদের যাত্রা।  

নাস্তা সেড়ে লোকাল বাসে ১০০ টাকা জনপ্রতি টিকেটে চকরিয়া টু আলীকদমের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। আমরা যে বাসে উঠেছিলাম সেটার নাম ছিল মাতামুহুরি পরিবহন। এছাড়াও, আরো অনেক পরিবহনসহ মাইক্রো বাস এবং চান্দের গাড়ি আছে যাতায়াতের জন্য। লামা টু আলীকদম সড়ক দিয়ে বাস ছুটে চলেছে নিজস্ব গন্তব্যে।

বান্দরবান আমাদের এভাবেই স্বাগত জানিয়েছিল। Image Source: © Wazedur Rahman Wazed

আশেপাশের প্রকৃতি যেন প্রাকৃতিক দৃশ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে আগতদের মুগ্ধ করার প্রত্যয় নিয়ে। পথিমধ্যে দুইবার দুটো আর্মি চেকপোস্টে থেমে নিজের পরিচয়ের প্রমাণস্বরূপ আপনাকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি এবং সেই ফটোকপিতেই নিজের ও অভিভাবকের নাম ও নাম্বার লিখে জমা দিতে হবে। 

লামাতে প্রথমবার গাড়ি থামবে ইয়াংছং আর্মি ক্যাম্পে। তবে বাসে থাকা শুধুমাত্র ট্যুরিস্টদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিতে হয়। আমাদের ছিল ৭ জনের গ্রুপ। ৭ জন না নেমে টিম লিডারকে পাঠিয়েছিলাম কথা বলতে এবং কাগজ জমা দিতে। 

ক্যাম্পের ফর্মালিটি শেষে আবার আমাদের গাড়ি ছুটে চলে নিজস্ব গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। আলীকদমের ঢুকার মুখে আবারো থামতে হয় আর্মি ক্যাম্পে। এবার কানা মেম্বার ঘাট আর্মি ক্যাম্প। একইভাবে কাজ সেড়ে আরো ২০/৩০ মিনিট চলার পর আলীকদম বাসট্যান্ড এসে নামি। 

বাস থেকে নেমে গাইড ঠিক করতে চাইলেও দরদামে বনিবনা না হওয়ায় আমরা ছুটি পান বাজারের উদ্দেশ্যে। অটোতে করে ৫/৭ মিনিট লাগে পান বাজার আসতে। ঢাকা থেকে আসার সময় যদি কিছু কিনতে ভুলে যান তাহলে আলীকদম বাসস্ট্যান্ডের পর এইটাই শেষ বাজার যেখান থেকে আপনি কেনাকাটা করতে পারবেন। ট্রেকিংয়ের জন্য জুতা, গামছা, ক্যাপ, মুদি এবং ফার্মেসিসহ সকল ধরণের জরুরী প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পাবেন এখানে। 

আমতলী ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে যেতে হয় দুসরি বাজার। Image Source: © Wazedur Rahman Wazed

পান বাজার থেকে কেনাকাটা সেড়ে চলে যাই আমতলী ঘাট। গাইড পূর্ব নির্ধারিত না থাকায় তোয়াইন খালে নৌকা পাওয়াটা আমাদের জন্য মুশকিল হয়ে যায়। এছাড়াও, বান্দরবানের অন্যান্য সব উপজেলা বন্ধ থাকায় আলীকদমে পর্যটকদের চাপ ছিল প্রচুর। 

যে কারণে গাইড সমিতিও চালাকি করে পূর্বের নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কিছুটা বেশি দাবী করে। এই বাকবিতণ্ডাতেই কেটে যায় ঘন্টা দুয়েক। এছাড়াও, আমাদের গ্রুপের দুইজন পান বাজার ফিরে গিয়ে আগামী দুই দিনের খাবারের রসদ সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। 

কেননা, বিভিন্ন সূত্র মারফতে জানতে পারি যে, ঈদের ছুটি হওয়া সত্ত্বেও অনেক পর্যটক আসায় পাহাড়ে থাকা-খাওয়া একটু কষ্টকর বর্তমানে। যাইহোক, গাইড ঠিক হবার মিনিট বিশেকের মধ্যেই আমরা তোয়াইন খাল দিয়ে দুসরি বাজার যাওয়ার জন্য উঠে পড়ি ট্রলারে।  

তোয়াইন খালের সৌন্দর্য। Image Source: © Saeed Al Raihan

তোয়াইন খালের দুই পাশের পাহাড়ি সবুজ দেখে বিগত দিনগুলোর নাগরিক জঞ্জালের কথা মুহূর্তেই ভুলে যাই আমরা। পানি কম থাকায় অনেক জায়গাতেই আমাদের নেমে বালিতে আটকে যাওয়া ট্রলার পুনরায় খালের পানিতে ভাসাতে হয়েছে। 

পরিষ্কার নীল আকাশে ছেঁড়া তুলোর বিক্ষিপ্ত শুভ্রসাদা মেঘ ঝুলে আছে, খালের বাঁক থেকে মোড় নিলেই মাথাচাড়া দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে নাম না জানা পাহাড়, সবুজে ছেয়ে থাকা অরণ্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে কাছে টেনে নেওয়ার; আর তোয়াইন খালের বাঁক কেটে ট্রলার ছুটে চলেছে নেটওয়ার্কবিহীন পাহাড়ের গহীনে। 

সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে প্রায় ৪টার দিকে আমরা চলে আসি দুসরি বাজার। নেমে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে শুরু করি আমরা আমাদের যাত্রা। কখনো গাছগাছালির ভেতর দিয়ে, কখনো সমতলের আদিবাসীদের পাড়া গলে, কখনো শুকনো মাটি, কখনো গোড়ালি বা হাটু সমান তোয়াইন খাল পাড়ি দিয়ে ঘন্টা দুয়েক হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম থানকোয়াইন ঝর্ণার কাছে। 

থানকোয়াইন ঝর্ণার স্নিগ্ধ রূপ মুগ্ধ করবে। Image Source: © Wazedur Rahman Wazed

ঝর্ণার শীতল পানিতে নেমে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেরি হয়ে যাওয়ায় ঝর্ণার কাছেও বেশিক্ষণ দাড়াতে পারিনি। খানিক সময় কাটিয়ে শুরু করি আমাদের আসল যাত্রা। থানকোয়াইন ঝর্ণার পাশ দিয়েই খাড়া একটা পথ উঠে গেছে পাহাড়ের বুক ভেদ করে। শুরু হয় ব্যাকপ্যাক আর খাবারের রসদ নিয়ে পাহাড় চড়া।

কিছুক্ষণ একটানা উঠার পরই গ্রুপের দুজন বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ৭ জনের গ্রুপে মাত্র ৩ জন আগে পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। বাকিরা এবারই প্রথম পাহাড় ভ্রমণে এসেছে। বাকি ৪ জনের ২ জন অনেকটাই ঠিক থাকলেও বাকি ২ জন কষ্টের কাছে মনোবলকে হারতে দেওয়ায় বাঁধে বিপত্তি। 

হাজিরাম পাড়ায় উঠার রাস্তা ছিল এমনই খাঁড়া। Image Source: © Wazedur Rahman Wazed

তা সত্ত্বেও, দলের সবার অনুপ্রেরণায় আর সবার সম্মিলিত উৎসাহে অনেক ধীরলয়ে, বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে ২ ঘন্টার পর আমরা পৌঁছে যাই হাজিরাম পাড়ায়। তখন ঘড়িতে বাজে ৮টা। কিন্তু পাহাড়ে রাত নামে খুব দ্রুত। তাই, ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা সবাইই ক্লান্ত হয়ে হাজিরাম পাড়ার টং দোকানে বসে পড়ি খানিক বিশ্রামের জন্য। 

গাইড জানায় যে, হাজিরাম পাড়ায় থাকা যাবে না। কারণ, লোকজনে পূর্ণ এই পাড়া। উঠে যেতে হবে আরো উপরে। বিশ্রাম নেওয়া শেষে আমরা পুনরায় টুকটুক করে আগাতে থাকি। 

একে তো অন্ধকার, উপরন্তু রাস্তা নেই চেনা, এরমধ্যে প্রচণ্ড ক্লান্ত শরীর-তাই মাত্র ৫ মিনিটের ব্যবধানে আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেলি। হাজিরাম পাড়া থেকে উপরের দিকে উঠতে হলে ৩টা রাস্তা পড়ে। যার মধ্যে একটা সঠিক আর বাকি দুটোর শেষে সম্ভবত কানাগলি। 

পাহাড়ে যখন সন্ধ্যা নামে। Image Source: © Saeed Al Raihan

কখনো জঙ্গলে চলে যাই, তো কখনো নীচে নেমে যাই, কখনো আবার উপরে উঠে চিৎকার করে ডাকি-কিন্তু ডাকের ধ্বনি প্রতিধ্বনি হওয়ায় আরো বেশি ধন্ধে পড়ে যাই আমরা। এভাবেই কাটে ৩০/৩৫ মিনিট সময়। 

অনেকক্ষণ পর মাথায় আসে যে, হাজিরাম পাড়ায় তো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। দ্বিতীয় চিন্তা না করেই সামনে চলে যাওয়া গ্রুপের লোকজনদের দেই ফোন। অতঃপর আরো কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরাঘুরি করে মূল রাস্তাটার খোঁজ পাই এবং সেখানেও প্রায় ৩০ মিনিট হেঁটে গিয়ে গ্রুপের বাকি সদস্যদের পাই আমরা। মোটামুটি ১ ঘন্টা সময় আমাদের এখানে চলে যায়। 

ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ঘ্যানঘ্যানানি, মশার উৎপাত, ভ্যাপসা গরম, আগের সারারাত নির্ঘুম যাত্রার ক্লান্তি, কাঁধে ব্যাকপ্যাক, হাতে খাবারের ব্যাগ, অপরিচিত রাস্তা-কখনো উঁচু কখনো নিচু, মনে অজানা বিপদের আশঙ্কা, অতিরিক্ত সতর্কতার সাথে প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলা। 

পাহাড়ে দ্রুত রাত নামে অথচ তখন মোটে ৮টা বাজে। Image Source: © Wazedur Rahman Wazed

একইসঙ্গে রাতের আঁধারে চাঁদের আবছা আলোতে পাহাড়ে হাঁটার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা-সব মিলিয়ে তখন অনুভূতিটা এমন ছিল যে, এই যাত্রা অনন্তকালের। অন্ধকারকে দূরে ঠেলে, চাঁদকে সঙ্গী বানিয়ে, পাহাড়ের বুক চিড়ে, বনজঙ্গল মাড়িয়ে, পাহাড়ি বুনো লতাপাতা ছাড়িয়ে, অজানা আশঙ্কাকে হারিয়ে-হেঁটে চলেছি আকাশের পানে।    

তবে এই যাত্রাপথে সবচেয়ে কঠিন আর প্রতিবন্ধক রাস্তা ছিল রেম্বক পাড়ার সীমানা অতিক্রম করা। রাতের আঁধারে বাশ টপকিয়ে ঝুরঝুরে মাটিতে দেখেশুনে নিচে নামাটা অনেকটাই কষ্টকর মনে হয়েছে গ্রুপের কমবেশি সবার কাছেই। অতঃপর আরো ঘন্টাখানেক চাঁদের আবছা আলোয় হেঁটে আমরা পৌঁছে যাই রেম্বক পাড়াতে। এই পাড়াতে ঢুকতেই প্রথমে যে ঘর তা হচ্ছে থোয়াইন দাদার। উনার ঘরেই আমাদের রাতে থাকার ব্যবস্থা করে আমাদের গাইড রাজীব দা। 

বাড়িতে ঢুকে কোথায় হাত-পা ছেড়ে সটান হয়ে শুয়ে থাকার কথা সকলের। কিন্তু সেখানে পাহাড়ি মানুষদের সান্নিধ্য পেয়ে আড্ডা জমে উঠে আমাদের। সারাদিনের ক্লান্তি মুছে যায় পাহাড়ি ফুটফুটে শিশুদের দেখে আর পরিবারের সকলের সাথে কথাবার্তা বলে।  

রেম্বক পাড়াতে থোয়াইন দাদার ঘরে। Image Source: © Wazedur Rahman Wazed

কিছু সময়ের মধ্যেই আমাদের রাতের খাবারের আয়োজন শুরু হয়। আলুভর্তা, শুকনা মরিচ দিয়ে পেঁয়াজ মাখা, আলু দিয়ে মুরগির ঝোল এবং ঝুমের চালের ভাত। ঝিরির ঠাণ্ডা শীতল জলে গোসল সেরে এসে ধোঁয়া ওঠা ভাত খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার অনুভূতি-যে পাহাড়ি পাড়ায় থেকেছে অন্তত তার ভুলার কথা না। 

ঘরের বারান্দায় বসে আরো কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে সবাই যাই শরীরকে বিশ্রাম দিতে। কেননা, সকালে উঠে এই পাহাড়ের নিচে নেমে যেতে হবে দ্বিতীয় গন্তব্যে। সেই গল্প হবে দ্বিতীয় পর্বে। 

চলমান

 

 

 

Feature Image: © Wazedur Rahman Wazed