টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটি: শুধুই থিওরি নাকি ভবিষ্যদ্বাণী?

221
0

১৯৫৮ সাল, কালো ব্লেজার এবং সাদা শার্ট পরিহিত ৫৫ বছর বয়সের একজন ভদ্রলোক ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইন্টারভিউ এর একের পর এক প্রশ্নের জবাবের মাঝে লোকটি ‘টেকনোলোজিক্যাল সিঙ্গুলারিটি’ নামের আজব একটা শব্দ উচ্চারণ করে উঠলেন। এই রকম একটা শব্দ মানবজাতি এই ভদ্রলোকের কাছ হতেই সেদিন প্রথম শুনেছিল।

এই ভদ্রলোক আর কেউ নয়, বরং আধুনিক কম্পিউটারের জনক জন ভন নিউম্যান ছিলেন। তার আবিষ্কারের প্রতিনিয়ত উন্নতি সাধনের মাধ্যমে মানবজাতি একসময় কোথায় যেয়ে পৌঁছাতে পারে তারই একটা ধারণা ছিল এই টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটি। শব্দটা বেশ গুরুগম্ভীর মনে হলেও এটাই সত্য যে মানবজাতি প্রতিনিয়তই এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।    

টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটি কী?  

টেকনোলোজিক্যাল সিঙ্গুলারিটি মূলত একটি থিওরি, এখানে এমন এক ভবিষ্যতের কথা বলা হয় যেখানে প্রযুক্তিগুলো উন্নতির সর্বোচ্চ শিকড়ে পৌঁছে গেছে এবং এর চেয়ে বেশি উন্নতি সাধন আর সম্ভব নয়। এই বুদ্ধিমান এবং শক্তিশালী প্রযুক্তিগুলো মানবজাতির ভবিষ্যত এবং বাস্তবতার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে।  

জন ভন নিউম্যান Image Souce: Privatdozent

টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটি সম্পর্কে আরো ভালোভাবে বুঝতে হলে প্রথমে সিঙ্গুলারিটি নিয়ে জানা প্রয়োজন। সিঙ্গুলারিটি শব্দটি প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বিজ্ঞান ও গণিতে ভিন্ন দুই ধরনের অর্থ প্রকাশ করে থাকে। যেমন, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে সিঙ্গুলারিটি বলতে গতিশীল সিস্টেম এবং সামাজিক ব্যবস্থাকে বর্ণনা করা হয়ে থাকে যেখানে ক্ষুদ্র একটি পরিবর্তন বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।  

সিঙ্গুলারিটি ধারণা মূলত চলে আসে পদার্থবিদ্যা থেকে। শব্দটি ১৯১৫ সালে সর্বপ্রথম আলবার্ট আইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে ব্যবহার করেছিলেন। এই তত্ত্বে, সিঙ্গুলারিটি একটি ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রকে বর্ণনা করে। অর্থাৎ, অসীম ঘনত্ব এবং মাধ্যাকর্ষণ সম্পন্ন একটি বিন্দু যার ভেতর হতে কোন বস্তু কখনও পালাতে পারে না, এমনকি আলোও নয়।   

কিন্তু যখন ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় সিঙ্গুলারিটি কথা বলা হয়, তখন এমন এক অকল্পনীয় ভবিষ্যতকে বোঝায় যেখানে প্রযুক্তিগুলো, বিশেষ করে অ্যালগরিদম দ্বারা পরিচালিত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সগুলো অতিমানবীয় স্তরে পৌঁছে যাবে। অর্থাৎ, মানবজাতি এবং কম্পিউটারের মাঝে যে পার্থক্যগুলো রয়েছে তা মুছে যাবে। ধারণা করা হয়, এই সময়ে এআইগুলোর বুদ্ধিমত্তা মানুষের চেয়েও বেশি হবে। 

জাপানের বিজ্ঞানী এবং তার তৈরিকৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই রোবট Image Source: Synced

সিঙ্গুলারিটি মানবদেহের সাথে প্রযুক্তিগত সংযোগ বৃদ্ধির সাথে জড়িত, যেমন- মস্তিষ্ক-কম্পিউটার ইন্টারফেস, মস্তিষ্কের জৈবিক পরিবর্তন, মস্তিষ্কের ইমপ্লান্ট এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। নিউরো-ন্যানোটেকনোলজি, যেমন- ইলন মাস্কের পরীক্ষামূলক ব্রেন ইমপ্লান্ট, নিউরালিংক, একটি মূল প্রযুক্তি যা সিঙ্গুলারিটিকে অনেকাংশে বাস্তবে পরিণত করতে সহায়তা করবে। 

কয়েক বছর আগে এই থিওরি খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলেও, বর্তমানের একুশ শতাব্দীতে এসে, আর্টেফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অসাধারণ অগ্রগতি, চ্যাটজিপিটি, নিউরালিংক এর মতো বাস্তব কিছু উদাহরণ এটাই প্রমাণ করে যে ধীরে ধীরে মানবজাতি নিজের অজান্তেই এই থিওরির বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছে। 

টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটির ইতিহাস 

একজন হাঙ্গেরিয়ান-আমেরিকান গণিতবিদ, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, পদার্থবিদ এবং পলিম্যাথ, জন ভন নিউম্যান বিশ শতকের প্রথম দিকে টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটির ধারণা নিয়ে আসেন। এর আগেও সিঙ্গুলারিটির ধারণা প্রচলিত থাকলেও, প্রযুক্তির সাথে এর সম্পর্ক থাকতে পারে বলে কেউ চিন্তা করেননি। 

১৯৬৫ সালে গণিতবিদ এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানী আরভিং জন গুড তার একটি প্রবন্ধ ‘স্পেকুলেশনস কনসার্নিং দ্য ফার্স্ট আল্ট্রাইন্টিলিজেন্ট মেশিন’,  এ প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগাধ বিকাশ সাধন নিয়ে আলোচনা করেন। ১৯৮৬ সালে সায়েন্স ফিকশন লেখক ভার্নর ভিঞ্জ তার উপন্যাস, ‘মেরুনড ইন রিয়েলটাইম’ এ সিঙ্গুলারিটির ধারণা উপস্থাপন করেন। 

১৯৯০ এর দশকে এই শব্দটি আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠে কম্পিউটার বিজ্ঞানী রে কার্জউইল এর লেখা সায়েন্স ফিকশন, ‘দ্য এজ অব স্পিরিচ্যুয়াল মেশিনস’ এর মাধ্যমে। এর পরবর্তীতেও আরো অনেক লেখক সিঙ্গুলারিটির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন আঙ্গিকে এর ভবিষ্যত সম্পর্কে তুলে ধরেছেন। 

দ্য এজ অব স্পিরিচ্যুয়াল মেশিনস Image Source: TRANSCEND Longevity Supplements

সায়েন্স ফিকশনগুলোতে এমন এক ভবিষ্যতের কল্পনা করা হয় যেখানে সুপার ইন্টিলিজেন্ট মেশিনগুলো নিজেদের বিকাশকে সূচকীয় হারে ত্বরান্বিত করে থাকে। একসময় মেশিনগুলো মানুষকে স্ক্যান করেই তার চিন্তাভাবনা, অনুভূতি বুঝতে পারবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করবে। সিংগুলারিটি চলে আসার পরবর্তী ভবিষ্যত মানবজাতির জন্য বেশ অচেনা হবে। 

এখানে একজন মানুষ তার সারাজীবনের ইতিহাস, চেতনা, অনুভূতি স্ক্যান করে একটি কম্পিউটারে সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে। এভাবে ব্যক্তিটির জৈবিক দিক হতে মৃত্যু ঘটলেও, ভার্চুয়াল জগত যেমন- মেটাভার্সের জগতে ব্যক্তিটি সংবেদনশীল রোবট হিসেবে আজীবন জীবিত থাকবে। 

২০০৬ সালে, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটির উপর একটি সামিট অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী, লেখক, উদ্ভাবক এবং ভবিষ্যতবিদ কুর্জউইল এবং উদ্যোক্তা পিটার থিয়েলও উপস্থিত ছিলেন। ২০০৮ সালে সিঙ্গুলারিটি ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেখানে সিঙ্গুলারিটির চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগগুলো মোকাবেলার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়ে থাকে।

২০২৩ সালে এসে আর্টেফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দ্রুত হারে ক্রমবর্ধমান উন্নতি দেখে এআই পরীক্ষা-নিরীক্ষার নেতারা একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন যাতে এআই গবেষণায় ছয় মাসের বিরতি দেওয়া হয়। চ্যাটজিপিটির ক্রমবর্ধমান উন্নতি দেখে পুনরায় টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটিব্যাপারগুলো সামনে চলে আসে। 

এআইগুলোর কারণে সিঙ্গুলারিটির বিষয়গুলো পুনরায় প্রতীয়মান হচ্ছে। Image Source: rishihood.edu.in

টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটির ভবিষ্যৎ 

বিশ শতকে দেয়া সিংগুলারিটির এই থিওরি অদূর ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন ঘটলে বর্তমানের সমাজ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন চলে আসবে। প্রযুক্তিগুলো উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেলে অর্থাৎ, যখন মানুষ আর রোবটের মাঝের পার্থক্য ঘুচে যাবে তখন দুই ধরনের সমাজ ব্যবস্থার দেখা মিলতে পারে বলে ধারণা করা হয়। 

ইউটোপিয়ান সোসাইটি:

ইউটোপিয়ান সোসাইটি সম্পর্কে বুঝতে হলে আগে ইউটোপিয়া সম্পর্কে বুঝতে হবে। ইউটোপিয়া হলো ভালো সকল আদর্শ পরিপূর্ণতার একটি কাল্পনিক জগত। এই ধরনের সমাজের চিত্র মূলত ফুটে উঠেছিল দুই লেখক উরসুলা লে গুইন এর ‘দ্য ওয়ানস হু ওয়াক এওয়ে ফ্রম ওমেলাস’ এবং এন কে জেমিসিন এরদ্য ওয়ানস হু স্টে এন্ড ফাইট’ দ্বারা লিখিত দুই বইয়ে।

মূলত ইউটোপিয়ান সোসাইটি বলতে একটি সুরেলা সমাজের কথা বোঝানো হয়। যেখানে নাগরিকরা সুখে শান্তিতে, পরস্পরের সাথে মধুর সম্পর্ক বজায় রেখে বসবাস করবে। যেখানে নাগরিকদের সকল মানবাধিকার নিশ্চিত করা হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি সত্যিকার অর্থেই স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারবে। তাদের বহির্বিশ্বের কোনো ভয় থাকবে না।

নাগরিকরা প্রাকৃতিক জগতকে আলিঙ্গন এবং শ্রদ্ধা করবে। প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে সম্মান জানানো হবে। সকল নাগরিক সামাজিক এবং নৈতিক আদর্শ মেনে চলবে। এই সমাজে অপরাধের হার থাকবে না বললেই চলে। এখানে মানজাতি প্রযুক্তির উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম হবে। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজকে উন্নতির চূড়ায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। 

ইউটোপিয়ান সোসাইটি Image Source: Pxfuel

এরকম একটি সমাজ আদৌ তৈরি করা সম্ভব কিনা এমন একটি প্রশ্ন সকলের মনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে থাকে। মজার বিষয় হচ্ছে, ইউটোপিয়ান সোসাইটি নিয়ে যেসকল কল্পকাহিনী রয়েছে সেখানেও দেখা যায়, এই ধরনের সোসাইটি শেষ পর্যন্ত গড়ে তোলা সম্ভব হয়ে উঠে না। 

ডিসটোপিয়ান সোসাইটি: 

এই সমাজ ব্যবস্থা ইউটোপিয়ান সোসাইটির একদম বিপরীত। এই সমাজ সম্পূর্ণ অমানবিক এবং ভীতিকর। ডিসটোপিয়ান সোসাইটিতে মানবজাতির উপর রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোর বিপজ্জনক প্রভাব ঘটে থাকে। 

এই সমাজে জলবায়ুর ভয়ানক বিপর্যয় ঘটে এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এর চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। এই সমাজব্যবস্থার পিছনে থাকেন একজন অত্যাচারী শাসক, যিনি সকল নাগরিককে মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করেন, অপরাধ প্রবণতা এর চরম শিখরে পৌঁছায় এবং ব্যক্তিত্বের ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। 

এই সমাজে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধের পথ আরো সহজ হয়ে উঠবে। মানবজাতি সুপার ইন্টেলিজেন্ট প্রযুক্তিগুলোর উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাবে। এক কথায়, এই সমাজব্যবস্থা হলো সম্পূর্ণ বসবাসের অযোগ্য।  

ডিসটোপিয়ান সোসাইটি। Image Source: pxfuel.com

এই ধরনের সমাজব্যবস্থার চিত্রও খুঁজে পাওয়া গেছে সায়েন্স ফিকশনের নানারকম সাহিত্যে। বিখ্যাত উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে জর্জ অরওয়েলের ‘নাইনটিন এইটি-ফোর’ (১৯৪৯), অ্যালডাস হাক্সলির ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ (১৯৩২), এবং রে ব্র্যাডবারির ফারেনহাইট ৪৫১’ (১৯৫২)  বইয়ে।  

বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের মাধ্যমে মানবজাতি একসময় হয়তো সত্যিই টেকনোলোজিক্যাল সিঙ্গুলারিটিতে পৌঁছে যাবে। সেই ভবিষ্যতে পৌঁছাতে কত সময় লাগবে তা আজও অজানা। তবে এর চেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তবে মানবজাতি প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সুমধুর ইউটোপিয়ানের দিকে আগাচ্ছে নাকি ভয়ংকর ডিসটোপিয়ানের দিকে?     

 

 

Feature Image: kasperskydaily.com
References:

 

১। https://www.britannica.com/technology/singularity-technology

২। https://www.aiforanyone.org/glossary/technological-singularity?fbclid=IwAR3SmPhd2F6_W_je4876abv2xO87v6Hcp74LvmWvZ3Xm7xpVEGJypGgicWo