সকালের চায়ের সাথে কিংবা বিকালের আড্ডায় যে খাবারটি না থাকলে কেমন যেন অসম্পূর্ণ লাগে সেটি হলো বিস্কুট। ছোট বড় সকলের কাছে সহজলভ্য ও মুখরোচক খাবার হিসেবে বিস্কুটের জনপ্রিয়তাকে টেক্কা দেওয়া বেশ কঠিন। আপনি যদি একজন বিস্কুটপ্রেমী হয়ে থাকেন তাহলে এই বিস্কুটের উৎপত্তি কীভাবে হলো, কেন হলো তা জানতে নিশ্চয়ই আপনার খুব ইচ্ছে করে। বিস্কুটের উৎপত্তি ও অজানা ইতিহাস নিয়েই আজকের আয়োজন।
বিস্কুটের গোড়াপত্তন
বিস্কুট শব্দটি মূলত ল্যাটিন শব্দ বিস্কোকটাম (Biscoctum) থেকে এসেছে। যার অর্থ হচ্ছে দুইবার বেক করা। দেশভেদে বিস্কুটের নামেও রয়েছে ভিন্নতা। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় বিস্কুটকে কুকিজ বলা হয়। স্পেনে গ্যালেটাস কিন্তু জার্মানিতে আবার কেকস নামে পরিচিত। ঐদিকে ইতালিতে বিস্কুট হলো আমারাত্তি। রোমানদের হাত ধরেই পৃথিবীতে বিস্কুটের আগমন ঘটে।
উনআশি খ্রিস্টাব্দের দিকে যখন পম্পেই নগরী ধ্বংস হয় সেই সময়ে শহরে বেশ কিছু বিস্কুটের কারখানা ছিল। এসকল কারখানায় বিস্কুট তৈরি করতে পাথরের গামলা ব্যবহার করা হতো। সেই গামলায় রুটির মতো আটার গোলা তৈরি করা হতো এবং পরবর্তীতে তা সুতায় কেটে টুকরো করে সেঁকে নেওয়া হতো। কালের বিবর্তনে বিস্কুটের অনেক বৈচিত্র্যতা আসতে থাকে।
ব্রিটিশরাই প্রথমে বিস্কুটের স্বাদে বৈচিত্র্য আনে, এতে চিনি যুক্ত করে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইতালির তুলনায় ব্রিটেনের বিস্কুট বেশি জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করে কারণ তার পূর্বে চিনির দাম কম থাকলেও এরপর চিনির দাম বেড়ে যায়। আর ব্রিটিশরা ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং আমেরিকায় ঘাঁটি গাড়ে ও আখের চাষ শুরু করে। ফলে তাদের চিনির অভাব হয়না। স্বাদে ভিন্নতা আসায় বিস্কুট খাওয়ার আগ্রহ বাড়ে ফলে বিস্কুটের বিক্রিও বেড়ে যায়। চিনির পাশাপাশি বিস্কুটে বাদাম ও ডিমের ব্যবহার করায় বিস্কুট আরও বেশি মুখরোচক হয়ে উঠে।
বিস্কুট বিপ্লব
১৯ শতক থেকেই বিস্কুটের হরেক রকমের বৈচিত্র্য আসতে শুরু করে। এছাড়াও, শিল্পবিপ্লবের কারণে গণহারে বিস্কুটের উৎপাদন শুরু হয়। বিকেলের নাস্তায় বিস্কুট এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠে। ১৮৬১ সালে পিক ফ্রিন্স নামক একজন ব্যাক্তি গারিবাল্ডিস নামের বিস্কুট তৈরি শুরু করেন। হান্টলি ও পালমার্স ১৮৬০ সালে ডাইজেস্টিভ বিস্কুট তৈরি করেন। এই বিস্কুট এমন উপাদান দিয়ে তৈরি যাতে হজমে সুবিধা হয়।
১৮৯২ সালে ম্যাকভাইটিস রিচ টি বিস্কুট আনেন। ১৮৯৯ সালে আসে চকলেট ডাইজেস্টিভ। অনেক বিস্কুট কোম্পানি তাদের বিস্কুটের বিশেষ টিন তৈরি করেছিল। এগুলো এতো বেশি টেকসই ছিল যে অন্যান্য খাবার সংরক্ষণেও ব্যবহার করা হতো।
১৯১০ সালে আসে বৌরবন বিস্কুট। ১৯৩৭ সালে আমেরিকার ম্যাসচুয়েটসের একজন নারী তার রেস্টুরেন্টের জন্য বিস্কুটের সাথে চকোলেট চিপস মিশিয়ে একটি নতুন ফ্লেভার তৈরি করেন যা ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে এসে পড়ে।
ষোড়শ শতাব্দীতে বিস্কুটে বৈচিত্র্য আনতে মধু ও বিভিন্ন দামী মশলা ব্যবহার করা শুরু হয়। যেটি জিঞ্জারব্রেড হিসেবে বিক্রি করা হতো। তবে এটি অনেক দামী বিস্কুট বিধায় সবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্য ছিলনা। জিঞ্জারব্রেড দাঁতের জন্যেও বেশ ক্ষতিকারক ছিল। ফলে টুডোর সময়কাল শেষ হওয়ার সাথে সাথে এই ধরণের বিস্কুটও গায়েব হয়ে যাওয়া শুরু করলো।
বিংশ শতাব্দীতে এসে সারা বিশ্বে বিস্কুট ছড়িয়ে পড়ে। নানা স্বাদ ও ঘরানার বিস্কুট নিয়ে বিভিন্ন ধরণেরর নিরীক্ষা শুরু হয়। এমনকি ঘরে ঘরে বিস্কুট তৈরি করা শুরু হয়। ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডে হবনব বিস্কুট বেশ লোকপ্রিয় হয়ে উঠে। বর্তমানে বিয়ের গিফট হিসেবেও অনেক সময় বৈচিত্র্যময় বিস্কুট উপহার দিতে দেখা যায়।
উপমহাদেশে বিস্কুটের আগমন
উপমহাদেশে প্রায় ২০০ বছর পূর্বে বিস্কুটের আগমন ঘটে। মোঘল আমলের শেষের দিকে অর্থাৎ, ইংরেজ আমলের শুরুতে ভারতের বর্ধমান থেকে কিছু ব্যক্তির আগমন ঘটে। তারা চট্টগ্রামের চন্দনপুরা কলেজ রোডে গণি বেকারি নামের একটি বিস্কুট কারখানা প্রতিষ্ঠিত করেন।
এখানেই উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় বেলা বিস্কুটের জন্ম হয়। পান্তা ভাতের পরিবর্তে তৎকালীন চট্টগ্রামের মানুষ বেলা বিস্কুট খাওয়া শুরু করলো। ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেলা বিস্কুটের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
অধ্যাপক আবুল ফজল তার আত্মজীবনী রেখাচিত্র গ্রন্থে চন্দনপুরার বেলায়েত আলী বিস্কুটওয়ালার নাম অনুসারে বেলা বিস্কুটের নামকরণ হয়েছে লিখে গিয়েছেন। চট্টগ্রামের বেলা বিস্কুটের খ্যাতি এখন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত ১৭টি বেকারিতে এই বিস্কুট তৈরি হতো। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় বেলা বিস্কুট রপ্তানি করা হচ্ছে।
বিস্কুট সম্পর্কে মজার কিছু তথ্য
বিস্কুট সম্পর্কে বেশ মজার কিছু তথ্য জানা যায়। তার মধ্যে কিছু তথ্য হচ্ছে-
বিস্কুট দিয়ে বিয়ার তৈরি
পূর্বে বিস্কুট খাওয়ার জন্য তৈরি হতো না। প্রাচীন সুমেরীয়রা বার্লি রুটিকে টুকরো টুকরো করে শুকিয়ে শক্ত করে নিতো। শুকনো টুকরোগুলো গরম পানিতে ভিজিয়ে, মধু বা খেজুরের রস ছেড়ে দিয়ে গাঁজন প্রক্রিয়ায় বিয়ার তৈরি করা হতো।
ফিগ রোলকে স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে উপস্থাপন
মধ্যযুগীয় মুসলমানরাই প্রথম ময়দায় চিনি যোগ করে এবং বিস্কুটকে স্বাস্থ্যকর খাবারে রূপান্তরিত করেছিল। এই ধরণের বিস্কুট ফিগ রোল হিসেবে পরিচিত। চিনিকে তখন ওষুধ হিসাবে দেখা হতো, যা শরীরকে ফিট রাখতে সাহায্য করে। মধ্যযুগীয় আরব চিকিৎসক ইবনে বাটলান গরম ডুমুর এবং বাদাম দিয়ে ভরা বিস্কুট খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ব্রেথ ফ্রেশনার হিসেবে বিস্কুট
ব্রিটেনে একটি ইতালীয় আলকেমি-কাম-মেডিকেল হ্যান্ডবুকে প্রথম বিস্কুট রেসিপি এসেছে। কীভাবে ‘সুস্বাদু মার্সেল বিস্কুট’ তৈরি করা যায় তার নির্দেশাবলী প্লেগের প্রতিকারের পাশাপাশি পাওয়া গিয়েছিল। এই বিস্কুটগুলো ছিল আঙ্গুল আকৃতির ও শক্ত স্পঞ্জের তৈরি। কস্তুরী বা মৌরির স্বাদযুক্ত ফলে খাওয়ার শেষে মুখের শ্বাসকে মিষ্টি করতো এবং পেটের গ্যাস দমন করার জন্য খাওয়া হতো।
বিস্কুট খেয়ে পাপ মোচন
মৃতদেহের উপর একটি বিস্কুট রাখা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় বেশ সাধারণ ছিল, মৃত ব্যক্তির পাপ গ্রহণ করার জন্য দাফনের আগে একজন শোককারী সেই বিস্কুটটি খেয়ে নিতো। আয়ারল্যান্ডে, এই প্রথা চালু ছিল। সতের শতকে ইংল্যান্ডে গির্জার অতিথিদের বিস্কুট এবং ওয়াইন পরিবেশন করার প্রথাও ছিল।
রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রত্যাখান
মারি বিস্কুট রাশিয়ান ডাচেসের নামানুসারে, ফরাসি রাজকীয় বাড়ির নাম অনুসারে বৌরবন, রাণী ভিক্টোরিয়ার স্বামীর নামানুসারে আলবার্ট বিস্কুট নামকরণ করা হয়েছিল। হান্টলি এবং পামার্সের প্রস্তাব ছিল রাণী ভিক্টোরিয়ার নামে একটি বিস্কুট বের করার। ভিক্টোরিয়া প্রত্যাখ্যান করে তার নামে বিস্কুট বের করার বিষয়টি।
তিনি ভেবেছিলেন যে, বিস্কুটের টিন জুড়ে তার নামটি খোদাই করা খুব অশ্লীল হবে। পরবর্তীতে তার পরিবর্তে আইল অফ ওয়াইট-তার প্রিয় বাড়ির নাম অনুসারে একটি বিস্কুটের নামকরণ করা হয়, এবং এটি হলো যে অসবোর্ন বিস্কুট যা উনিশ শতকের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিস্কুটগুলির মধ্যে একটি। পৃথিবীতে আর কোনো খাবারের জনপ্রিয়তা কমলেও বিস্কুটের জনপ্রিয়তায় ভাটা যে পড়বে না তা নিসন্দেহে বলা যায়।
Feature Image: freepik.com Sources: 01. The History of the Biscuit From Roman Rusk to Victorian Petits Fours. 02. The history of biscuits. 03. HISTORY OF BISCUITS: FOR HOW LONG HAS IT BEEN AMONG US? 04. Crumbs! A history of biscuits in 15 fantastic facts.