প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম স্থাপনা হলো আলেকজান্দ্রিয়া বাতিঘর। আলেকজান্দ্রিয়া বাতিঘর মিশরীয় স্থাপত্যের অন্যতম নির্দশন। মিশরের পিরামিড নিয়ে এখনও মানুষের জানার যেমন কৌতূহল তেমনই এই আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর নিয়েও জানার কৌতূহল। তাই আজকের আলোচনায় থাকছে প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের এই আলেকজান্দ্রিয়া বাতিঘর।
বাতিঘরের ইতিহাস
প্রাচীন বিশ্বের এই বিস্ময়টি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের উপকূলে ফারোস দ্বীপে অবস্থিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘরটি নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সেই সময় মিশরের রাজা ছিলেন ১ম সোটা।
তবে তিনি প্রথম টলেমি নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তিনি এই বাতিঘর নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কাজ পুরোপুরিভাবে শেষ করতে পারেনি। পরবর্তীতে টলেমির পুত্র দ্বিতীয় ফিলাডেলফাসের রাজত্বকালে সুউচ্চ এই বাতিঘরটি নির্মাণ করা হয়।
সিনিডাসের স্থপতি সস্ট্রাটাস এই বাতিঘর নির্মাণ করেছিলেন। তিনি একজন শক্তিশালী মানুষ ছিলেন। তাছাড়া রাজা টলেমী এবং তাঁর পুত্রের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এই বাতিঘরটি নির্মাণ করতে প্রায় ১২ বছর সময় লাগে এবং মোট ৮০০ ট্যালেন্ট রৌপ্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর এর মূল ভিত্তির আয়তন ছিল প্রায় ১১০ বর্গফুট এবং ৩০০ ফুটের বেশি লম্বা ছিল এই বাতিঘর। অবাক করার মতো তথ্য হল যে, ১৮৮৯ সালে আইফেল টাওয়ার তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এই বাতিঘরটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু কাঠামো। এটা থেকে বোঝায় যায়, মিশরীয়রা নির্মাণশৈলীতে অসাধারণ পটু ছিল যা বর্তমানে পিরামিডের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি।
হালকা রঙের বড় বড় পাথরের ব্লক থেকে তৈরি করা হয় বাতিঘরটি। তবে এই বাতিঘরের ডিজাইন তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল। প্রথম অংশ ছিল কেন্দ্রীয় কোরসহ বর্গক্ষেত্র, মাঝের অংশ ছিল অষ্টভুজাকার, এবং উপরের অংশ ছিল বৃত্তাকার বিভাগ।
বাতিঘর নির্মাণের উদ্দেশ্য
মূলত, আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘরটি তৈরি করা হয়েছিল যাতে নাবিকরা সহজে এবং নিরাপদে বন্দরে জাহাজ ভিড়তে পারে। কারণ প্রাচীনকালে নৌপথ ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের একমাত্র মাধ্যম। তাই গভীর সমুদ্রে জাহাজের দিক ঠিকার জন্য সেই সময় মানুষ নানা ধরনের কৌশল ব্যবহার করতো।
ঠিক তেমনই নাবিকরা যাতে সহজে উপকূলীয় বন্দর চিহ্নিত করতে পারে সেজন্য এই বাতিঘর নির্মাণ করে। দিনের বেলা এই বাতিঘরের উপরের অংশে আয়নার সাহায্য সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে জাহাজগুলিকে দিকনির্দেশনা দেওয়া হতো। তবে রাতের বেলা, বাতিঘরের উপরের অংশে আগুন জ্বালানো হতো। এটা এতটাই কার্যকর ছিল যে, গভীর সমুদ্রের ১০০ মাইল দূর থেকে এটা দেখা যেত।
জ্বালানি সরবরাহের জন্য বাতিঘরের মধ্যঅংশে প্যাচানো মতো সিঁড়ি ছিল। এতে করে জ্বালানি সহজে নিচ থেকে উপরে নিয়ে যাওয়া যেতো। লোক মুখে এখন শোনা যায়, আলেকজান্দ্রিয়া বাতিঘর যত দিন পর্যন্ত টিকে ছিল ততদিন কেউ নাকি আগুন নিভে যেতে দেখেনি। কারণ তৎকালীন সময়ে বিশ্বের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর।
যেভাবে ধ্বংস হলো
প্রথমদিকে আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর মানুষের কাছে শুধুমাত্র বন্দর হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এর নির্মাণ শৈলীর জন্য এটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়। এর নির্মাণশৈলী এতটাই সুন্দর ছিল যে, দূর-দুরন্ত থেকে মানুষ এই বাতিঘর দেখতে আসতো।
তাছাড়া, এই আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর এর আদলে সে সময়ে অনেক বাতিঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনোটিই এর মত সুন্দর এবং সুবিশাল ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ৭৯৬ এবং ৯৫১ সালে দুটি ভূমিকম্পের ফলে আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর টি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরবর্তীতে ১৩০৩ এবং ১৩২৩ সালে আরো তিনটি ভূমিকম্পের ফলে বাতিঘরটি গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। উত্তর-পশ্চিম দেশ মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতার মতে, এই সময়ে নিয়ে বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষ ভিতরে প্রবেশ করতে পারেনি। এরপর ১৪৮০ সালের দিকে আবার এক শক্তিশালী ভূমিকম্পের ফলে আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
পুনঃআবিষ্কার
১৯৬৮ সালে ইউনেস্কো একটি প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান চালায় এবং এই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন অনার ফ্রস্ট। এই অভিমানের ফলে তাঁরা মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের ভূমধ্যসাগরের এলাকায় জলের নিচে আলেকজান্দ্রিয়া বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষ পুনঃআবিষ্কৃত করে।
পরবর্তী ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক জিন্স ইভেস এম্পেরিয়র ১৯৯৪ সালে আলেকজান্দ্রিয়া শহরের পূর্ব হারবার থেকে এই বাতিঘরের ভৌত অংশের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। এই দলের একজন সিনেমাটোগ্রাফার পানির নিচ থেকে কলাম এবং মূর্তিগুলোর ছবি তুলতে সক্ষম হোন।
এই ছবিগুলো অনুসন্ধান করার ফলে জানা যায় যে, গ্রানাইটের বিশাল যেসব ব্লক রয়েছে তার ওজন হবে প্রায় ৪০-৫০ টন, সাথে ৩০টি মূর্তি এবং ৫টি ওবেলিস্ক কলাম রয়েছে যা দ্বিতীয় রামসেসের রাজত্বের সময় খোদাই করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
পরবর্তীতে আরও অভিযান চালিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষের অনেক কিছু খুঁজে পাওয়া গেছে, যা থেকে নিত্য নতুন তথ্য বের হয়ে আসতে থাকে। ইউনেস্কো কনভেনশন অন দ্য প্রোটেকশন অব দ্য আন্ডারওয়াটার কালচারাল হেরিটেজ বর্তমানে মিশর সরকারের সাথে কাজ করছে আলেকজান্দ্রিয়ার উপসাগরের স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য।
২০১৬ সালে, মিশরের পুরাকীর্তি রাজ্য মন্ত্রণালয়, জলের নিচে একটি যাদুঘর হিসেবে আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘরসহ প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়া শহরের নিমজ্জিত ধ্বংসাবশেষে পরিণত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের আলেকজান্দ্রিয়া বাতিঘর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু আজও মানুষের মনে কৌতূহল রয়ে গেছে।
Feature Image: egyptianstreets.com References: 01. The Light House. 02. Lighthouse-of-Alexandria. 03. The Lighthouse_of_Alexandria. 04. The Greco-and-roman-period-lighthouse-Alexandria.