আন্দিজ হলো বিশ্বের দীর্ঘতম পর্বতমালা যেখানে রয়েছে কয়েকটি সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। বহু আগের ধবংসাবশেষ, আগ্নেয়গিরি এবং ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার উৎসের জন্যেও এটি পরিচিত। এশিয়ার মহাদেশের বাহিরে, অর্থাৎ হিমালয় পর্বতমালা ছাড়া আন্দিজ পর্তমালা হলো পৃথিবীর সব থেকে উঁচু পর্বতমালা।
এখানে রয়েছে এশিয়ার বাহিরে অবস্থানরত সর্বোচ্চ পর্বত আকোনকাগুয়া। আন্দিজ পর্বতমালা সম্পর্কে জানার এবং আগ্রহের শেষ নেই। আর সেই আগ্রহের অবসান ঘটাতেই আজকের আয়োজন। যেখানে আলোচনা আন্দিজ পর্বতমালা সম্পর্কে।
আন্দিজ পর্বতমালার নামকরণ
আন্দিজ পর্বতমালার নামকরণ নিয়ে নানা রকমের মতের ভিন্নতা এবং মতবাদ রয়েছে। অধিকাংশদের মতে, কোয়াচা ভাষার শব্দ অ্যানটি থেকে এর নামকরণ হয়েছে। যেটার দ্বারা উচ্চতম স্থান, ঝুঁকি বা পর্বতচূড়ায় অথবা তরঙ্গশীর্ষে পৌঁছানো এমন অর্থ প্রকাশ করে।
আবার অনেকেরই দাবি Anti Suyu থেকে আন্দিজ শব্দটি এসেছে। যেটি আন্দিজের চারটি অঞ্চলের মধ্যকার একটি অঞ্চল। যেখানে ইনকাদের একসময়ে বসবাস ছিল। অন্য আরেকটি মত অনুসারে আন্দিজ শব্দটি এসেছে, স্প্যানিস শব্দ আনদেন থেকে। যার অর্থ হলো চত্বর। যে চত্বরসমুহ সাধারণত ইনকারা এবং সমসাময়িক অন্যান্যরাও শস্য চাষ এবং মাড়াইয়ের জন্য ব্যবহার করতো।
তবে কিছু কিছু ইতিহাসবিদ আবার এই বিষয়গুলোতে ভিন্ন মত পোষন করেন। তাদের মতে, আন্দিজ শব্দটি Quecha ভাষার শব্দ Anti থেকেই এসেছে তবে তার অর্থ হলো পূর্ব। আরও একটি মত অনুসারে Quecha ভাষার শব্দ Anta থেকে আন্দিজ শব্দটি এসেছে। যেটার অর্থ হলো তামা। আর এই মতামতটি সবচেয়ে বেশি গ্রহনযোগ্যতা পেয়ছে।
ভৌগলিক অবস্থান এবং বৈশিষ্ট্য
আন্দিজ পর্বতমালার পর্বতশ্রেণী পর্বতের মেরুদন্ড স্বরূপ। যেটি দক্ষিণ আমেরিকাকে দুইটি অংশে উত্তর থেকে দক্ষিণে বিছিন্ন করে আর্জেন্টিনা, চিলি, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া এবং পেরু এই সাতটি দেশ অতিক্রম করেছে। ভেনিজুয়েলা থেকে শুরু করে প্যাটাগনিয়া পর্যন্ত প্রায় ৮০৪ মিটার প্রশস্ত এবং ৭৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ।
যার গড় উচ্চতা প্রায় ৩,৯৬২ মিটার বা ১৩,০০০ ফুট। ভেনিজুয়েলার উপকূলে ক্যারিবীয় সাগরে অবস্থিত বানোয়ার, আরুবাএবং কুরাসাও দ্বীপপুঞ্জগুলি আন্দিজ রেঞ্জের সাগরের দিকে নিমজ্জিত শিখরগুলোকে নির্দেশ করে। যা সর্বাধিক উত্তরের প্রান্তকে অনেক বেশি প্রতিনিধিত্ব করে।
আন্দিজ পর্বমালাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা এবং উত্তর ইকুয়েডর পুরাটা উত্তর আন্দিজ। এই তিনটি পর্বতশ্রেণী নিয়ে গঠিত যা একে অপরের সমান্তরাল: কার্ডিলেরা সেন্ট্রাল, কার্ডিলেরা ওসিডেন্টাল এবং কার্ডিএরা ওরিয়েন্টাল। সবগুলো পর্বতমালাতেই রয়েছে স্বক্রিয় আগ্নেয়গিরি। আর এই আগ্নেয়গিরিগুলোর লাভা মধ্য মাল্ভূমিটিকে বিভিন্ন প্রধান অববাহিকা থেকে পৃথক করেছে।
কর্ডিলেরা ওসিডেন্টাল উপকূলরেখার সাথে সমান্তরাল এবং এটির উচ্চতা ৩,৩৩৪ মিটার। তবে পর্বতমালাগুলোর মধ্যে সেন্ট্রাল কার্ডিলেরা পর্বতমালাটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে উচ্চতম পর্বতমালা যদিও এটির আয়তন বাকিগুলো থেকে ছোট। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ আগ্নেয়গিরির অবস্থান সেন্ট্রাল আর্ডিলেরা পর্বতের আশেপাশেই।
মধ্যে অবস্থিত আন্দিজের পর্বতমালা গুলো শুষ্ক, প্রশস্ত এবং উচ্চতম। পেরু, বলিভিয়া , চিলি এবং আর্জেন্টিনা জুরে মধ্য আন্দিজ বিস্তৃত। Altaipano নামক অংশটি উত্তরের দুটি রেঞ্জ কার্ডিলেরা ওরিয়েন্টাল ও কার্ডিলেরা ওসিডেন্টাল এর সাথে সীমান্ত রক্ষা করে চলেছে। আর এখানেই রয়েছে বিশ্বের সবথেকে উচ্চতম হৃদ টিটিকাকা যেটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩,৮১২ মিটার উপরে রয়েছে।
দক্ষিণ আন্দিজ প্যাটাগনিয়া২ আর্জেন্টিনা ও চিলি অঞ্চল জুরে বিস্তৃত। এখানের বেশিরভাগ পর্বতগুলো বরফ ক্ষেত্র, হিমবাহ, হৃদ, নদী এবং সমুদ্রের খাঁড়ি দ্বারা পরিপূর্ণ। এছাড়া এখানে রয়েছে দক্ষিণ ও পশ্চিম হেমিসফেরিয়াসের সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট অ্যাকনকাগুয়া। যেটি সমুদ্রতল থেকে ৬,৯৬১ মিটার উচ্চতা। পর্বতটি আর্জেন্টিনাতে অবস্থান করছে।
আন্দিজ পর্বতমালার জলবায়ু
আন্দিজ পর্বতমালা প্রশান্ত মহাসাগর এবং মহাদেশের মঝে দেওয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। যা এই সম্পূর্ণ অঞ্চলের জলবায়ুতে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করে। আন্দিজ অঞ্চলগুলোর জলবায়ু নির্ভর করে আন্দিজের উচ্চতা অবস্থান ও সমুদ্রের নৈকট্যের উপর। পর্বতমালার দক্ষিণ অংশ শীতল এবং অপেক্ষাকৃত বৃষ্টিপ্রবণ। পর্বতমালার মধ্যের অংশ শুষ্ক যেখানের তাপমাত্রার বিভিন্ন বৈচিত্রতা লক্ষ্য করা যায়।
আন্দিজ পর্বতমালাতে প্রাথমিক মানব বসতির বেশি প্রমাণ নেই। অনুমান করা হয় যে ১০০০০ থেকে ১২০০০ বছর পুরোনো হবে এখানে মানুষের বাস। যদিও বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে উক্ত সময়ের আগের সময়ে আন্দিজে মানুষের বসবাস থাকতে পারে। আন্দিজের রুক্ষ ভুখণ্ড অতি উচ্চতা এবং অক্সিজেনের স্বল্পতার জন্য এখানে মানুষের বসবাস করা অসম্ভব এবং কষ্টসাধ্য।
তবে এখানকার রাখালেরা ১৭,০০০ ফুট উচ্চতায় বেঁচে থাকতে পেরেছে আর এর প্রধান কারণ হলো তাদের দেহের কোষের পরিবর্তন হয়ে গেছে একইসাথে তাদের অভিযোজন ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন তথ্যমতে জানা যায়, প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বে এই অঞ্চলে ইনকাদের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, এবং ইনকারা এখানে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।
উদ্ভিদ
আন্দিজ পর্বতমালার অনেক এলাকায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক বনাঞ্চল এবং বিভিন্নরকম বৃক্ষ ও ফুলের গাছ গড়ে ওঠেছে। দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ভেনিজুয়েলা থেকে শুরু করে দক্ষিণের ঠাণ্ডা, ঝড়ো এবং ভেজা অঞ্চল কেপ হর্ন পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে; যার মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত শুষ্ক অঞ্চল এবং আটাকামা মরুভূমি।
এখানে রয়েছে ৩০,০০০ প্রজাতির ভাস্কুলার উদ্ভিদ (বিভিন্ন ফুল গাছ, কনিফার এবং ফার্ন) এবং এর অর্ধেকই এ অঞ্চলের স্থানীয় উদ্ভিদ। এখানে সিনচোনা পাবসেন্স নামক এক ধরনের ছোট ছোট গাছ পাওয়া যায় যেগুলা ম্যালেরিয়ার ঔষধ কুইননাইন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও এখানে আলু এবং তামাক পাওয়া যায়।
আন্দিজ অঞ্চলে কৃষিকাজ হয়ে আসছে প্রায় ৬০০০ বছর ধরে। তথ্যমতে, ইনকারা কৃষিকাজে যুক্ত ছিল। পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ির মতো ধাপ তৈরি করে সেচের মাধ্যমে ফসল চাষ করা করতো তারা। তাদের উৎপাদিত প্রধান ফসল ছিলো আলু। এছাড়াও সেখানে ভুট্টার চাষ হতো। বর্তমানে তুলা, টমেটো, তামাক এবং রপ্তানি পণ্য হিসেবে কফি চাষ করা হয়।
প্রাণী
জীব বৈচিত্র্যের কারণে আন্দিজ অঞ্চলে উদ্ভিদের পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর সমাহার। এখানে প্রায় ১,০০০ প্রজাতির উভচর প্রাণীর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই এখানের স্থানীয়। আন্দিজ হলো পৃথিবীর উভচর প্রাণীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এছাড়া এখানে রয়েছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, যার মধ্যে ১৩ শতাংশই হলো স্থানীয় প্রাণী।
এছাড়াও রয়েছে ১৭০০-এর থেকে বেশি প্রজাতির পাখি, ৩৩ শতাংশ স্থানীয় পাখি, এছাড়াও এখানে রয়েছে ৬০০- এর বেশি প্রজাতির সরীসৃপ যার মধ্যে ৩৩ শতাংশ স্থানীয় সরীসৃপ এবং প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ যার মধ্যে ৩৩ শতাংশ স্থানীয়। এখানে রয়েছে উট পরিবারের বিশেষ কিছু প্রাণি যেমন: ভিকুনা, গুয়ানাকো।
এই সকল প্রাণিগুলো আন্টিপ্লানো মালভূমিতে পাওয়া যায়। এছাড়া এখানের স্থানীয়রা মাংস আর উলের জন্য লামা এবং আল্পাকা করে। ইদুর গোত্রের বিপন্ন প্রানী চিনচিলাস এই অঞ্চলেই বাস করে। এছাড়াও এখানে হিউমুল, কুগার, আন্দিয়ান শেয়াল এবং বিভিন্ন পাখি যেমন: জায়ান্ট কুট, আন্দিয়ান হাঁস, ফ্ল্যামিংগো, ডারউইন বা ছোট রিয়া দেখা যায়।
মানব বসতি
আন্দিজ পর্বতমালার দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে গড়ে উঠেছে বিচিত্র সব সংস্কৃতি। ইনকা সভ্যতা থেকে শুরু করে বর্তমান সময় অবধি বিভিন্ন সংস্কৃতির উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয়েছে। মধ্য আন্দিজে এখনো ইনকাদের তৈরি অনেক রাস্তা দেখা যায়। এই আন্দিজেই গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর কিছু পুরনো সভ্যতা। আন্দিজের কোস্কো অঞ্চল ছিল এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইনকা সভ্যতা। এই কোস্কো শহরের একটি চূড়ায় আজও দাঁড়িয়ে আছে ইনকাদের স্থাপনা মাচুপিচু।
আন্দিজের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশ বিদেশ থেকে বিভিন্ন পর্যটক বেড়াতে আসে। পাহাড়ে চড়া, রাফটিং, হাইকিং, স্কিইং, সাইক্লিং এবং কিছু অবসরযাপনের অন্যতম। পৃথিবীর বুকে এক অপার সৃষ্টি হলো আন্দিজ পর্বতমালা। আন্দিজের সৌন্দর্য প্রকৃতিতে এক নতুন মাত্রার সৌন্দর্য যুক্ত করেছে। তাই নিঃসন্দেহে এটি যে কেউকে মুগ্ধ করবে।
Featured Image: Chris Stenger References: 01. Andes Mountains Facts. 02. Andes Mountains. 03. Andes Mountains. 04. About the Andes.