মাইগ্রেন ব্যথা: কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার

174
0

মাইগ্রেন হলো একটি স্নায়বিক ব্যাধি যার মূল লক্ষণ হলো গুরুতর মাথাব্যথার পুনরাবৃত্তি এবং এর সাথে অন্যান্য উপসর্গ যেমন- বমি বমি ভাব, আলো এবং শব্দের প্রতি সংবেদনশীলতা। মাইগ্রেনে বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভুগায় এবং এতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হয়। আজকের আর্টিকেলে মাইগ্রেনের কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

মাইগ্রেনের কারণ

মাইগ্রেনের সঠিক কারণ এখনও পুরোপুরি বোঝা যায়নি। গবেষণায় এসেছে যে, জেনেটিক এবং পরিবেশগত কারণগুলির সংমিশ্রণ মাইগ্রেনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। মাইগ্রেনকে ট্রিগার করে এমন কিছু সাধারণ প্রক্রিয়া হলো:

  • হরমোনের পরিবর্তন: নারীদের ক্ষেত্রে শরীরে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা ওঠানামার কারণে অনেকে মাসিক চক্রের সময় মাইগ্রেন-এর ব্যথা অনুভব করেন।
  • কিছু খাবার এবং পানীয়: অ্যালকোহল, ক্যাফেইন, চিজ এবং প্রসেসড খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়ার ফলে মাইগ্রেন হতে পারে।
  • পরিবেশগত কারণ: উজ্জ্বল আলো, উচ্চ শব্দ, তীব্র গন্ধ এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন মাইগ্রেনকে ট্রিগার করে থাকে।
  • মানসিক এবং শারীরিক কারণ: স্ট্রেস, উদ্বেগ, ঘুমের অভাব এবং অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমও মাইগ্রেনের উদ্রেক করতে পারে।
  • জেনেটিক ফ্যাক্টর: মাইগ্রেনের প্রবণতা বংশানুক্রমে স্থানান্তরিত হয়। যদি পিতামাতার মধ্যে একজন বা উভয়েরই মাইগ্রেন থাকে, তবে সন্তানের মাইগ্রেনের সম্ভাবনা বেশি।
  • সংবেদনশীল উদ্দীপনা: নির্দিষ্ট ইন্দ্রিয়ের অতিরিক্ত উদ্দীপনা মাইগ্রেনকে ট্রিগার করতে পারে। উজ্জ্বল আলো, তীব্র গন্ধ এবং উচ্চ বা তীব্র শব্দ মাইগ্রেনের সূত্রপাত ঘটাতে পারে।
  • ওষুধ: কিছু ওষুধ, যেমন হরমোনাল গর্ভনিরোধক, ভাসোডিলেটর এবং নাইট্রোগ্লিসারিন ইত্যাদির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসাবে মাইগ্রেনের উদ্রেক হতে পারে।
মাইগ্রেনের ট্রিগার পয়েন্ট। Image source: godigit.com

মাইগ্রেনের লক্ষণ

মাইগ্রেন সাধারণ মাথাব্যথা নয়। মাইগ্রেনের মাথাব্যথা পর্যায়ক্রমে ঘটে এবং কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। লক্ষণগুলো ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন হতে পারে তবে সাধারণত নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো সবার মাঝেই দেখা যায়:

  • তীব্র মাথাব্যথা: সাধারণত, মাইগ্রেনের সময় মাথার একপাশে কম্পনশীল বা স্পন্দনশীল ধরণের ব্যথা অনুভূত হয়। ব্যথার ধরণ মাঝারি থেকে তীব্র হতে পারে এবং শারীরিক পরিশ্রমের সাথে বাড়তে পারে।
  • সংবেদনশীলতায় ব্যাঘাত: অনেক ব্যক্তি মাইগ্রেনের আগে বা ঐ সময় চাক্ষুষ, সংবেদনশীল বা মোটর সেন্সে ব্যাঘাত অনুভব করেন। এ ধরণের ব্যাঘাতের উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে আলোর ঝলকানি দেখা, অস্থায়ী দৃষ্টিশক্তি হ্রাস ইত্যাদি।
  • বমি বমি ভাব এবং বমি: মাইগ্রেনের সাথে প্রায়শই গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল উপসর্গ জড়িত থাকে, যেমন- বমি বমি ভাব এবং বমি।
  • উদ্দীপনার প্রতি সংবেদনশীলতা: মাইগ্রেনের রোগীরা প্রায়ই আলো, শব্দ এবং নির্দিষ্ট গন্ধের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। এই উদ্দীপনার উপস্থিতি তাদের মাথাব্যথা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
  • আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা (ফটোফোবিয়া): মাইগ্রেনে আক্রান্ত অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় সূর্যালোক বা তীব্র যেকোনো আলো তাদের মাথাব্যথা আরও বাড়িয়ে দেয় এবং অস্বস্তি সৃষ্টি করে।
  • শব্দের প্রতি সংবেদনশীলতা (ফোনোফোবিয়া): সাধারণত সহনীয় শব্দগুলি মাইগ্রেনের আক্রমণের সময় অত্যধিক বিরক্তিকর মনে হতে পারে, যা অস্বস্তি সৃষ্টি করে বা আরো মাথাব্যথার উদ্রেক ঘটে।
  • মাথা ঘোরা: কিছু ব্যক্তি মাইগ্রেনের আক্রমণের সময় মাথা ঘোরা বা ভার্টিগো অনুভব করেন, যা ভারসাম্য সমস্যা এবং সমন্বয়ে অসুবিধা সৃষ্টি করে।
  • ক্লান্তি এবং দুর্বলতা: মাইগ্রেন মাথাব্যথার পর্যায়ে এবং পরে উভয় ক্ষেত্রেই ক্লান্তি এবং দুর্বলতা সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিরা দুর্বল অনুভব করেন এবং তাদের দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন করতে অসুবিধা হয়ে থাকে।
  • ব্রেন ফগ: প্রায়শই ব্রেন ফগ বা মস্তিষ্কের কুয়াশা হিসাবে পরিচিত একটি সমস্যা মাইগ্রেনের কারণে দেখা দিতে পারে, যার ফলে  কোনো কিছু মনে রাখতে এবং সমস্যা সমাধানে অসুবিধা হয়। এসময় পরিষ্কারভাবে চিন্তা করা বা তথ্য কার্যকরভাবে প্রক্রিয়া করা চ্যালেঞ্জিং মনে হতে পারে।
  • ঘাড় ব্যথা এবং শক্ত হওয়া: মাইগ্রেনে আক্রান্ত অনেক ব্যক্তি তাদের মাথাব্যথার পাশাপাশি ঘাড় ব্যথা বা শক্ত হয়ে যাওয়া অনুভব করেন। এই ব্যথা মাথার পেছন থেকে ঘাড় এবং কাঁধ পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে।

মাইগ্রেনে আক্রান্ত সমস্ত ব্যক্তি একই উপসর্গ অনুভব করেন না এবং লক্ষণগুলির তীব্রতা এবং সময়কাল ব্যক্তি ভেদে পরিবর্তিত হতে পারে। যদি আপনার সন্দেহ হয় যে, আপনার মাইগ্রেন আছে বা আপনি এই উপসর্গগুলির কোনটি অনুভব করছেন, তাহলে সঠিক রোগ নির্ণয় এবং উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার জন্য একজন স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

মাইগ্রেন ব্যাথার জায়গা। Image source: dallastmjdr.com

মাইগ্রেন নিয়ন্ত্রণ

যদিও মাইগ্রেনের কোনো নির্দিষ্ট প্রতিকার নেই, বেশ কিছু ব্যবস্থাপনা কৌশল মেনে চাপ; এই উপসর্গ উপশম করতে এবং ভবিষ্যতের মাইগ্রেনের পিরিয়ড প্রতিরোধ করতে সাহায্য করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • লাইফস্টাইল পরিবর্তন: মাইগ্রেনকে ট্রিগার করে এমন ব্যাপারগুলি সনাক্ত করা এবং এড়িয়ে চলা, নিয়মিত ঘুম, শিথিলকরণ কৌশলগুলির মাধ্যমে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং স্বাস্থ্যকর ডায়েট অবলম্বন করা মাইগ্রেনের ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতা হ্রাস করতে পারে।
  • ওষুধ: ওভার-দ্য-কাউন্টার ব্যথা উপশমকারী ওষুধ, যেমন- আইবুপ্রোফেন বা অ্যাসপিরিন, হালকা মাইগ্রেনে উপশম দিতে পারে। গুরুতর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুসারে ওষুধ যেমন ট্রিপটান ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • বিকল্প থেরাপি: আকুপাংচার, বায়োফিডব্যাক এবং কগনিটিভ বেহেভিওরাল থেরাপির মতো কৌশলগুলি মাইগ্রেন নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে।
  • মাইগ্রেন ট্রিগার করা ব্যাপারগুলো সনাক্ত করুন: নির্দিষ্ট খাবার, চাপ, ঘুমের অভাব বা হরমোনের পরিবর্তন-মাইগ্রেনকে ট্রিগার করতে পারে এমন ব্যাপারগুলোতে নজর দিন। একটি মাইগ্রেন ডায়েরি রাখা প্যাটার্ন এবং ট্রিগারগুলো সনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে।
  • নিয়মিত ঘুম: নিয়মিত সামঞ্জস্যপূর্ণ ঘুম মাইগ্রেনের ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতা কমাতে সাহায্য করতে পারে। প্রতি রাতে অন্তত সাত থেকে আট ঘণ্টা ভালোমতো ঘুমান।
  • মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন: স্ট্রেস মাইগ্রেনকে ট্রিগার করে থাকে। গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, ধ্যান, যোগব্যায়াম এর মতো ক্রিয়াকলাপে জড়িত থাকার মাধ্যমে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কৌশলগুলি আয়ত্ত করুন।
  • হাইড্রেটেড থাকুন: ডিহাইড্রেশন মাইগ্রেনে অবদান রাখতে পারে, তাই সারাদিন প্রচুর পানি পান করা গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহলের অত্যধিক ব্যবহার এড়িয়ে চলুন কারণ এগুলো শরীরকে তাড়াতাড়ি ডিহাইড্রেট করতে পারে।
  • একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ রুটিন তৈরী করুন: একটি নিয়মিত দৈনিক রুটিন বজায় রাখা শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়িকে স্থিতিশীল করতে এবং মাইগ্রেনের সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করতে পারে। নিয়মিত সময়ে খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন, পর্যাপ্ত সময় ঘুম এবং জেগে ওঠার অভ্যাস করুন এবং নিয়মিত ব্যায়ামকে আপনার রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করুন।
  • নিয়মিত ব্যায়াম করুন: নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপে নিযুক্ত থাকা মাইগ্রেনের ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতা কমাতে সাহায্য করতে পারে। হাঁটা, সাঁতার বা সাইকেল চালানোর মতো ব্যায়াম বেছে নিন, কারণ উচ্চ-পরিশ্রম জনিত ব্যায়াম মাইগ্রেনকে ট্রিগার করতে পারে।
  • গরম বা ঠাণ্ডা প্যাক লাগান: কপালে বা ঘাড়ে ঠান্ডা প্যাক লাগিয়ে জায়গাটি অসাড় করে এবং রক্তনালীকে সংকুচিত করা মাইগ্রেনের উপশম করতে সাহায্য করে। বিকল্পভাবে, কিছু ব্যক্তি উষ্ণ প্যাক বা উষ্ণ পানিতে স্নানের মাধ্যমে স্বস্তি পান।

মনে রাখবেন, আপনার মাইগ্রেন কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং ব্যক্তিগত দিকনির্দেশনা  পাওয়ার জন্য একজন স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞের  সাথে পরামর্শ করা গুরুত্বপূর্ণ।

মাইগ্রেন থেকে মুক্তির কিছু ঘরোয়া উপাদান। Image source: verywellhealth.com

মাইগ্রেন একটি জটিল স্নায়বিক ব্যাধি যা বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করে। এটি বিভিন্ন উপসর্গের সাথে বারবার হওয়া, হালকা থেকে তীব্র মাথাব্যথা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সঠিক কারণটি অস্পষ্ট থাকলেও, একে ট্রিগার করে এমন ঘটনাগুলো চিহ্নিত করা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারার অভ্যাস গ্রহণ করা মাইগ্রেন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে চলা, ওষুধ ব্যবহার করা এবং থেরাপির মাধ্যমে মাইগ্রেনের ভোগা ব্যক্তিরা সাময়িক স্বস্তি লাভ এবং সামগ্রিক জীবনের মান উন্নত করতে পারে। চলমান গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যতে মাইগ্রেনের আরও কার্যকর চিকিৎসা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

 

 

Feature Image: West Houston Internal Medicine 
Sources: 

01. Migraine. 
02. Migraines Headaches. 
03. Migraine.