সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা, যাকে নিউ সেইন্ট পিটারস ব্যাসিলিকাও বলা হয়, ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত এই সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা হলো ক্যাথলিক চার্চের অন্যতম পবিত্র স্থান। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান হিসেবেও বিবেচিত হয়। সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা খ্রিস্টধর্মের অন্যতম পবিত্র বিশ্বের বৃহত্তম গির্জা৷
এটি রেনেসাঁ স্থাপত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজগুলির মধ্যে একটি। এটি প্রায়শই তার যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ভবন হিসাবে বিবেচিত হয়। এছাড়া, এখানেই পোপ সারা বছর ধরে অনেক লিটার্জির সভাপতিত্ব করেন।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সেইন্ট পিটার নামে পরিচিত যিশুর ১২ জন শিষ্যের একজনের নামানুসারে ব্যাসিলিকাকে সেইন্ট পিটারস বলা হয়। সেইন্ট পিটার ক্যাথলিক চার্চের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হয়েছিলেন এবং রোমে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। যেখানে ব্যাসিলিকা এখন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল বলে জনশ্রুতি আছে।
প্রাচীনকালে, ইতালির রাজধানী রোম নগরীর তিবের নামক নদীর পাড় ঘিরে বর্তমান ভ্যাটিকান সিটির জায়গায় একটি পাহাড় ছিল। পাহারটিকে মাউন্ট ভ্যাটিকান নামে ডাকা হতো এবং স্থানীয় ভাষায় পাহাড়টির নাম ছিল মন্তেস ভ্যাটিকানি। মূলত এই পাহাড়ের নাম থেকেই পরবর্তীতে এই স্থানের নাম তথা দেশের নাম ভ্যাটিকানে রূপান্তরিত হয়।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে, আগ্রাপিনা দ্য এল্ডার নিজের আরাম-আয়েশ আর বাগান বিলাসের কথা চিন্তা করে রোমের তিবের নদীর পাড় ঘেরা পাহাড় অঞ্চল কেটে এক সুবিশাল উদ্যান তৈরি করেন। তার কয়েক বছর পর থেকে সেই উদ্যানের পাশের প্রধান সড়ক জুড়ে বেশ কিছু জনবসতি গড়ে উঠেছিল। তারপর, ধীরে ধীরে এই জনমানবহীন জায়গাটি ঘনবসতিতে পূর্ণ হয়।
চল্লিশ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে, আগ্রাপিনা দ্য এল্ডারের ছেলে সম্রাট ক্যালিগুলা এই উদ্যানের স্থলে সার্কাস তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি তার জীবদ্দশায় সেটা সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। ক্যালিগুলার পরবর্তী সম্রাট ছিলেন সম্রাট নিরো, যিনি পূর্ববর্তী সম্রাটের এই অসমাপ্ত কাজটি সম্পন্ন করেন।
সার্কাস প্রাঙ্গনটি ছিল ৫০০ মিটার লম্বা এবং ১০০ মিটার চওড়া। সার্কাসের নামকরণ করেন ‘গাই সার্কাস দ্য নিরোনেস’, যা ‘নিরোর সার্কাস’ নামেই বেশি পরিচিতি লাভ করেছিল। জানা যায়, সার্কাসটি বর্তমান সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকার অনুরূপ পূর্ব-পশ্চিম দিকেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল এবং এর মূল মঞ্চটা ছিল দক্ষিণ দিকে।
প্রাচীনকালের সেই ভ্যাটিকান আর আজকের দিনের এই ভ্যাটিকানের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। তবে সেই প্রাচীন ভ্যাটিকানের একমাত্র দৃশ্যমান ভগ্নাবশেষ হচ্ছে ভ্যাটিকান অবেলিস্ক, যা সার্কাসের স্পিনা সাজানোর কাজে সম্রাট ক্যালিগুলা হেলিওপেলিস থেকে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন।
৬৪ খ্রিস্টাব্দে সমস্ত রোম জুড়ে এক বৃহৎ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে যা বিশ্বের ইতিহাসে ‘দ্য গ্রেট ফায়ার অব রোম’ নামে পরিচিত। তখন এই স্থানটিকে খ্রিস্টানদের সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। প্রাচীনকালের নেক্রপলিস অথবা গণকবরের মতো।
প্রাচীন প্রথাগত বিশ্বাস অনুযায়ী, এখানেই সেইন্ট পিটারের শরীরকে উল্টো করে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল এবং তার সহচারীগণ সকলকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। মতান্তরে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ৩২৪ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিক থেকেই সম্রাট কন্সট্যান্টাইনের হাত ধরে ভ্যাটিকানের পরিবর্তন আসা শুরু করে। ক্ষমতা অর্জন করার পরপরই তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং পুরো ভ্যাটিকানজুড়ে ঐতিহ্যবাহী প্যাগান স্থাপনাসমূহ ভেঙে ফেলেন।
নিরোর বানানো সেই সার্কাস প্রাঙ্গনেই তিনি সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা নির্মাণ করেন। ধারণা করা হয়, এই ব্যাসিলিকার নীচেই রয়েছে পবিত্র সেইন্ট পিটারের সমাধি। সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় খনন কাজ সম্পূর্ণ করতে এক মিলিয়ন ঘনমিটার মাটি অপসারণ করতে হয়েছিল।
এটিকে একটি তিন-আইলযুক্ত ল্যাটিন ক্রস হিসেবে ডিজাইন করা হয়েছে যার ক্রসিং-এ একটি গম্বুজ রয়েছে, সরাসরি উচ্চ বেদির উপরে, যা সেইন্ট পিটার দ্য এপোস্টেলের মন্দিরকে আচ্ছাদিত করে। এটি ১৮ই নভেম্বর ১৬২৬ সালে পবিত্র করা হয়েছিল।
ব্রামান্তে, মাইকেলএঞ্জেলো এবং কার্লো মাদেরনোর কাজগুলিকে অনুসরণ করে বেশ কিছু বিখ্যাত স্থপতি গির্জাটির নকশা করেছিলেন। এই সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা কেবল ভ্যাটিকানবাসীদের কাছেই নয়, বরং সারা বিশ্বের সমস্ত ক্যাথলিক খ্রিস্টানের কাছেই পবিত্র এক স্থান। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পোপ এই ব্যাসিলিকার সংস্কার এবং সংরক্ষণ করেছিলেন।
সম্রাট কন্সট্যান্টাইন নির্মিত এই ব্যাসিলিকা তখন থেকে এখন অবধি ভ্যাটিকান তথা পুরো বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিস্টানধর্মী মানুষদের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা নির্মাণের মধ্য দিয়েই মূলত ভ্যাটিকান ও এর আশেপাশে ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের যাতায়াত বহুগুণে বৃদ্ধি পায় এবং অত্র এলাকায় ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপদের হাতে ক্ষমতা চলে যায়। তখন পোপেরাই মূলত রাষ্ট্রনেতার মতো সে সকল অঞ্চল শাসন করতো।
অন্যান্য আকর্ষণসমূহ
সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকার অন্যান্য আকর্ষণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিস্টিন চ্যাপেল (৯৫ মিটার), ভ্যাটিকান সিটি (২০১ মিটার), সেইন্ট পিটারস স্কয়ার (২০৫ মিটার), ভ্যাটিকান মিউজিয়াম (৫২১ মিটার) এবং ক্যাস্টেল সান্ট’অ্যাঞ্জেলো (৯৭০ মিটার)। সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকার হাঁটার দূরত্বের মধ্যে রয়েছে ভ্যাটিকান মিউজিয়াম, যা রোমের অন্যতম প্রধান পর্যটক আকর্ষণ। ভিতরে পাঁচ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা বছরের পর বছর ধরে সংগৃহীত হাজার হাজার শিল্পকর্ম রয়েছে।
সেইন্টের ব্যাসিলিকাকে পেছনে রেখে পিটার এবং কনসিলিয়েশন অ্যাভিনিউ (ভায়া ডেলা কনসিলিয়াজিওন) বরাবর হাঁটতে গিয়ে, সম্রাট হ্যাড্রিয়ানের সময়ে নির্মিত ক্যাস্টেল সান্ট’অ্যাঞ্জেলোকে এবং তার পরিবারবর্গের ব্যক্তিগত সমাধি ক্ষেত্রের দেখা মিলবে। পরে, এই ভবনটি একটি সামরিক ভবনে পরিণত করা হয়েছিল এবং ৪০৩ খ্রিষ্টাব্দে অরেলিয়ান প্রাচীরের সাথে একীভূত হয়। ১১ শতক থেকে এটি পোপদের সম্পত্তিতে পরিণত হয়। কারণ এটি ভ্যাটিকান সিটির সাথে ‘পাসেটো’ নামক একটি সুরক্ষিত করিডোর দ্বারা সংযুক্ত ছিল।
এছাড়া রয়েছে ভ্যাটিকানের গ্রোটোসে অবস্থিত পোপদের সমাধি এবং সেইন্ট পিটার এবং তার উত্তরসূরিদের সমাধি। ব্যাসিলিকার ভিতরে, দর্শনার্থীরা বিভিন্ন শিল্পের অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক জিনিসগুলি খুঁজে পাবে। তার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য হলো ‘পিটারস বাল্ডাচিন’- এটি বার্নিনি দ্বারা ডিজাইন করা একটি বড় ব্রোঞ্জ বাল্ডাচিন। ‘দ্য পিয়েটা’ নামের মাইকেলএঞ্জেলোর তৈরি করা একটি ভাস্কর্য এবং তার সিংহাসনে সেইন্ট পিটারের মূর্তি। ভক্তদের স্পর্শে সেইন্ট পিটারের মূর্তির ডান পা জীর্ণ হয়ে গেছে।
ব্যাসিলিকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশগুলির মধ্যে একটি হলো এর অবিশ্বাস্য সুন্দর গম্বুজ। গম্বুজের ডিজাইন করার কাজটি করা শুরু করেছিলেন মাইকেলএঞ্জেলো এবং পরবর্তীতে গিয়াকোমো ডেলা পোর্টা ডিজাইনের কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। কার্লো মাদেরনো ১৬১৪ সালে গম্বুজটির ডিজাইনের কাজ শেষ করেছিলেন।
এই গম্বুজটি অন্যান্য অনেক ক্যাথিড্রাল এবং ভবনের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল এবং লন্ডনের সেইন্ট পলস ক্যাথেড্রাল। দর্শনার্থীদের অবশ্যই গম্বুজের শীর্ষে আরোহণ করার সুযোগটি মিস করা উচিত নয়, যেখানে সেইন্ট পিটার্স স্কয়ারের একটি অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখা যায়। চূড়ায় আরোহণ করা কারো কারো জন্য একটু কষ্টসাধ্য হতে পারে, যেহেতু আরোহণের শেষ অংশটি একটি সরু এবং খাড়া সর্পিল সিঁড়ি।
সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকার বর্তমান অবস্থা
সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা বিশ্বের বৃহত্তম ভবনগুলির মধ্যে একটি এবং বর্তমানে পোপ ব্যাসিলিকাগুলির মধ্যে বৃহত্তম। সেইন্ট পিটারস ব্যাসিলিকার দৈর্ঘ্য ২১৮ মিটার এবং এর গম্বুজসহ উচ্চতা ১৩৬ মিটার। এর আয়তন ২৩,০০০ বর্গমিটার। সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা একসাথে প্রায় ২০,০০০ মানুষকে ধারণ করার সক্ষমতা রাখে।
ব্যাসিলিকাটিকে এর সম্মুখভাগের বিশালতা এবং কাজের গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে এটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নির্মাণ করা একটি স্থাপত্য কর্ম হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এখানে প্রায়শই হাজার হাজার ক্যাথলিকদের ভিড় লেগে থাকে। ব্যাসিলিকা এবং এর পার্শ্ববর্তী সেইন্ট পিটারস স্কয়ার সারা বছর ধরে পোপের সভাপতিত্বে বেশ কয়েকটি লিটার্জির জন্য ব্যবহৃত হয়।
সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা হল বিশ্বের অন্যতম চারটি চার্চের মধ্যে একটি, যা প্রধান ব্যাসিলিকার পদে রয়েছে। বাকী তিনটি ব্যাসিলিকা হল সেইন্ট জন ল্যাটেরানের ব্যাসিলিকা (ল্যাটেরানোতে সান জিওভানি), সান্তা মারিয়া ম্যাগিওরের ব্যাসিলিকা এবং সেইন্ট পলের ব্যাসিলিকা (তিনটিই রোমে অবস্থিত)। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকাই খ্রিস্টীয় জগতের বৃহত্তম গির্জা ছিল। সেই বছরই আইভরি কোট ডিভোয়ারের ইয়ামাউসুক্রোতে নবনির্মিত ব্যাসিলিকা দ্বারা এটি আকারের দিক থেকে প্রথম অবস্থান হারিয়েছে।
Feature Image: Nimrod Oren/Pixabay References: 01. St. Peter's Basilica | History, Architects, Relics, Art, & Facts. 02. St. Peter's Basilica - Opening hours, price and location. 03. St. Peter's Basilica of Vatican City - Useful Information.