শৈশবের প্রারম্ভিককালে সাধারণত একটি শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ খুব দ্রুতগতিতে হয়। প্রথম পাঁচ বছরেই শিশুর মস্তিষ্কের প্রাপ্তবয়স্ক আকারের প্রায় ৯০ ভাগ গঠন হয়ে যায়। শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বলতে আমরা মূলত বুঝি তার চিন্তাগত দক্ষতা, বস্তু ও ব্যক্তি সম্পর্কে ধারণা তৈরির ক্ষমতা, একাধিক বিষয়াবলির ভিতর তুলনা ও বিচার করার দক্ষতার পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধিকে।
০-৫ বছরে ভাষা শেখা ও বোঝার দক্ষতা, সংখ্যাগত ধারণা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় যা পরবর্তী জীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রারম্ভিক জীবনের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সাথে পরবর্তী সময়ের সফলতার তীব্র সংযোগ রয়েছে যেজন্য প্রতিটি অভিভাবকেরই এখানে নজর দেয়াটা প্রয়োজন। এতে স্বল্প ও দীর্ঘসূত্রে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব।
এই সময়টায় অভিভাবকেরা নানারকম সৃজনশীল ও শৈল্পিক কার্যকলাপে ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করতে পারে যা তাদের শেখাকে উপভোগ্য করে তুলবে। সেই সব নিয়েই আজকের বিস্তারিত আলোচনা।
গুপ্তধনের ঝুড়ি
গুপ্তধনের ঝুড়ি নিয়ে খেলা ছোট বাচ্চাদের জন্য শুধু উপভোগ্যই হবে না, এটি থেকে তারা অনেক উপকৃতও হবে। এটি খেলার সময় বিভিন্ন সংজ্ঞাবহ স্নায়ুতন্ত্রের কাজ হয় যা বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে সাহায্য করবে। বড় কারো তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন ধরণের জিনিস একসাথে একটা ঝুড়ির ভেতরে রেখে শিশুকে সেগুলো খুঁজে বের করতে দেয়াই এই খেলাটির মূল বিষয়।
ভিন্ন ভিন্ন রকম বস্তু দিয়ে সাজানো যায়, আবার নির্দিষ্ট কোন থিমভিত্তিক ঝুড়িও হতে পারে সেটা। অনেক সময় বাচ্চারা জিনিসপত্র নিজেদের মুখে নিতে পারে, তাই তাদের দিকে ভালোভাবে নজর রাখতে হবে।
বোর্ড গেমস
মার্কেটে বিশেষভাবে শুধু শিশুদের জন্যই কিছু বোর্ড গেমস পাওয়া যায়। এসব খেলায় সময় দিলে সমস্যা সমাধান এর দক্ষতার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক দক্ষতা (যেমন পালাক্রমের ধারণা) তৈরি হয়।
ডিজিটাল গেমস
যদিও অতিরিক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার/স্ক্রিন টাইম শিশুর স্বাস্থ্যহানির কারণ হতে পারে, একটি নির্দিষ্ট সময় রুটিন করে বিভিন্ন রকম গেম খেলায় তাদের উৎসাহিত করা যায় যেগুলো তাদের স্মৃতিশক্তি/গানিতিক/যৌক্তিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। এই ধরণের একটি অ্যাপ এর নাম হলো ব্রেইন গেমস। এছাড়াও, প্লেস্টোরে খুঁজলে এরকম অসংখ্য অ্যাপস পাওয়া যাবে।
অন্যদিকে বয়ঃসন্ধিকালে শৈশবের প্রারম্ভিক সময়ের মতোই মস্তিষ্ক প্রচুর পরিবর্তন এর ভেতর দিয়ে যায়। মস্তিষ্কে নতুন ব্রেইন সেল গঠন ও অন্য আরো নানা পরিবর্তন কিশোর কিশোরীদের সাহায্য করে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে যেগুলো তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করে। অভিভাবক এবং শিক্ষাক্ষেত্র ও স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করে এই ধরণের প্রাপ্তবয়স্করা নিম্নোক্ত কিছু উপায়ে এই বয়সের ছেলেমেয়েদের সহায়তা করতে পারেন।
বিভিন্ন জটিল বিষয়ে প্রশ্ন করা
কিশোর কিশোরীদের বিভিন্ন ঘটনাবলী নিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন করা যায় যাতে তাদের চিন্তা করার অভ্যাস ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। ‘তোমার ঘটনা নিয়ে মতামত কী?’, ‘এই জায়গায় তুমি থাকলে ভিন্ন কী করতে?’ এই ধরণের নানা প্রশ্ন তাদের করা যায় যেগুলোতে মাথা খাটাতে হয়। এসব যুক্তি তর্ক তাদের ভালো বিতার্কিক হতেও সহায়তা করবে।
ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্তের পরিণতি সম্পর্কে অবগত করা
বয়ঃসন্ধিকালে অনেকেই তাদের কোন একটা সিদ্ধান্তের কারণে তাৎক্ষণিক স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করলেও ভবিষ্যতের কোন একটা কাজে যে ব্যঘ্ন ঘটতে পারে সেটা অনেক সময় বুঝতে পারে না। কিশোর কিশোরীদের এরকম অবস্থায় তাদের কোন সিদ্ধান্তের সুবিধা অসুবিধা স্বল্প ও দীর্ঘসূত্রে চিন্তা করতে বলার মাধ্যমে তাদের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করা যায়। যেমন-সকালে স্কুল থাকলে বন্ধুদের সাথে রাত জেগে থাকা আর তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাবার ক্ষেত্রে কী কী উপকার ও অসুবিধা হতে পারে সেটা সম্পর্কে ভাবতে বলা।
বিভিন্ন দক্ষতা অর্জনে উৎসাহিত করা
ইতিবাচক ঝুঁকি নেয়ার অভ্যাস কিশোর কিশোরীদের সামগ্রিক বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করবে। এজন্য নতুন নানা ধরণের দক্ষতা অর্জনে তাদের উৎসাহিত করা যায়। যেমন-কোন খেলাধুলার সাথে যুক্ত হওয়া, বিতর্ক কিংবা কুইজে অংশগ্রহণ, কোন আর্ট প্রজেক্টে অংশ নিতে বলা বা নতুন কোন কমিউনিটীর সাথে যুক্ত হতে সহায়তা করা ইত্যাদি।
স্বাস্থ্যকর ঘুমের রুটিন তৈরিতে সহায়তা করা
বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী বয়ঃসন্ধিকালে প্রতিটা মানুষের অন্তত ৮-১০ ঘন্টা ঘুম হওয়া দরকার। মোবাইল আসক্তি বা অন্যান্য কারণে বেশিরভাগ কিশোর কিশোরীর জন্য রাত এগারোটার আগে ঘুমানো কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সাধারণত বেশিরভাগ স্কুল শুরু হয়ে থাকে সকাল সাড়ে সাতটা থেকে আটটার ভেতর।
রাতে জেগে থাকা এবং সকালে আগে আগে উঠবার কারণে এ বয়সী ছেলেমেয়েরা সাধারণত পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায়না। অভিভাবকেরা রাতে সঠিক সময়ে ঘুমের অভ্যাস তৈরি করতে তাদের জন্য রুটিন তৈরি করে দিতে পারে এবং এধরণের নিয়ম তৈরি করতে পারে যে বেডরুমে কোনরকম ইলেকট্রনিক ডিভাইস রাখা যাবেনা।
কোন ধরণের মানসিক সমস্যা/প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে পেশাগত সাহায্য গ্রহণ করা
অনেক সময় এ বয়সের ছেলেমেয়েরা অ্যানজাইটি, ট্রমা, ডিপ্রেশনের মতো নানা ধরণের মানসিক সমস্যায় ভুগে যেগুলো তাদের পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের অবশ্যই উচিত কোন ভালো থেরাপিস্টের কাছে তাদের নিয়ে যাওয়া। অন্যদিকে যদি এটি নজরে আসে যে তারা পড়াশোনার ক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে মনোযোগ দিতে বা রুটিন মেনে চলতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাহলে অবশ্যই কোন পেশাগত সাহায্য নিয়ে দেখতে হবে যে এডিএইচডি বা অন্য কোন মানসিক রোগে তারা ভুগছে কিনা। যত তাড়াতাড়ি সমস্যা নির্ণয় করা হবে তত তাড়াতাড়ি সেটার চিকিৎসাও সম্ভব হবে।
একজন সচেতন ও যত্নবান অভিভাবক হিসেবে সন্তানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের দিকে খেয়াল রাখাটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সাথে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যেরও রয়েছে গভীর সংযোগ। এজন্য সন্তানের পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য, বিশ্রাম নিশ্চিত করা,তাদের সাথে আন্তরিক সময় কাটানোরও রয়েছে বিশেষ প্রয়োজন।
লাইব্রেরী ও মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া, নতুন মানুষের সাথে মিশবার সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমে একজন অভিভাবক সন্তানের সাথে এককভাবে শুধু ভালো সময়ই কাটাতে সক্ষম হবেনা বরং এসব অভ্যাস একটি শিশুর সামগ্রিক বিকাশে উপযুক্ত ভূমিকা রাখবে।
Feature Image: theswaddle.com References: 01. Maturation of the adolescent brain. 02. Youth Risk Behavior Surveillance. 03. A Guide to Intellectual Development in Early Childhood.