বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি যখন আমাদের ঘরে বন্দি থাকতে বাধ্য করেছিল; তখন কাজ থেকে শুরু করে পড়াশোনা, খবর, বিনোদন সবকিছুর জন্য আমরা নির্ভরশীল ছিলাম অনলাইনের উপর। আর এই যোগাযোগে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওয়াই-ফাই সুবিধা। মজার ব্যাপার হলো, এই ওয়াই-ফাইয়ের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রী হেডি লামারের হাতে।
সেই সময় একজন নারীর উদ্ভাবনী ক্ষমতার থেকে তার সৌন্দর্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। বিশেষ করে, হলিউডের মতো জায়গায় নারী শিল্পীদের যোগ্যতার যথাযথ সম্মান নিয়ে প্রশ্ন এখনও থেকেই যায়। কিন্তু এর মধ্যেও, নিজের দৃঢ়তা আর মেধা দিয়ে হেডি লামার তার তথাকথিত পরিচয়ের বাইরে নিজের ভিন্ন সত্ত্বা তৈরি করেছিলেন।
পরিচয় ও শৈশব
হেডি লামার একজন অস্ট্রিয়ান-আমেরিকান অভিনেত্রী এবং উদ্ভাবক। তিনি সেই প্রযুক্তির পথপ্রদর্শক ছিলেন, যা আজকের ওয়াই-ফাই, জিপিএস এবং ব্লুটুথ-এর ভিত্তি তৈরি করেছে। ‘স্যামসান ও ডেলিলাহ’ এবং ‘হোয়াইট কার্গোর’ মতো চলচ্চিত্রে তার প্রতিভা এবং সৌন্দর্যের জন্য সমাজ তার উদ্ভাবনী প্রতিভাকে দীর্ঘদিন উপেক্ষা করেছে।
লামারের আসল নাম হেডউইগ ইভা কিসলার। ১৯১৪ সালের ৯ নভেম্বর, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার একটি সচ্ছল ইহুদি পরিবারে তার জন্ম। লামারের মা ছিলেন একজন কনসার্ট পিয়ানোবাদক এবং ছোটবেলা থেকেই তাকে ব্যালে এবং পিয়ানোর মাধ্যমে শিল্পকলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
একমাত্র সন্তান হিসাবে লামার তার ব্যাংক পরিচালক এবং কৌতূহলী বাবার কাছ থেকে প্রচুর মনোযোগ পেয়েছিলেন। তিনি তাকে ভিন্নভাবে উদার মনে বিশ্ব দেখতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি প্রায়ই লামারকে বাইরে হাঁটার জন্য নিয়ে যেতেন।
সেখানে তিনি ছাপাখানা, গাড়ির ইত্যাদি বিভিন্ন মেশিনের ভেতরের কাজ নিয়ে আলোচনা করতেন। এই আলোচনাগুলোই লামারের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল। মাত্র ৫ বছর বয়সে, মেশিনটি কীভাবে কাজ করে তা বোঝার জন্য তিনি তার মিউজিক বক্স আলাদা করে পুনরায় একত্রিত করেন।
অভিনয় জগতের শুরু
লামারের মেধার জায়গা নিয়ে নিয়েছিল তার সৌন্দর্য। মাত্র ১৬ বছর বয়সে পরিচালক ম্যাক্স রিইনহাটের সাথে লামারের পরিচয় হয় বার্লিনে অভিনয় শেখার সময়। ১৯৩০ সালে একটি জার্মান চলচ্চিত্রে (Geld auf der Straβe বা Money on the Street) তিনি প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৩২ সালে বিতর্কিত চলচ্চিত্র এক্সট্যাসি (Ecstasy)-তে তার ভূমিকার জন্য একজন অভিনেত্রী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন।
বৈবাহিক জীবন
তার অভিনীত ‘সিসি’ (Sissy) নাটক দেখে অস্ট্রিয়ান যুদ্ধাস্ত্র ডিলার, ফ্রিটজ ম্যান্ডল তার প্রিয় ভক্তদের একজন হয়ে ওঠেন। লামার এবং ম্যান্ডল ১৯৩৩ সালে বিয়ে করেন। কিন্তু এটি স্বল্পস্থায়ী ছিল। তিনি এই বিয়েতে অসুখী ছিলেন। কারণ তার কোনো ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিল না।
ম্যান্ডলের বন্ধুদের এবং ব্যবসায়িক অংশীদারদের জন্য রাখা পার্টিতে তাকে থাকতে বাধ্য করা হতো। তাদের মধ্যে কিছু নাৎসি পার্টির সাথে যুক্ত ছিল। ১৯৩৭ সালে তিনি লন্ডনে পালিয়ে আসেন। কিন্তু যুদ্ধ নিয়ে ডিনার-টেবিল থেকে অর্জিত জ্ঞান তার পরবর্তী জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
লন্ডনে থাকাকালীন, লামারের ভাগ্য পরিবর্তন হয় বিখ্যাত এমজিএম স্টুডিওর লুই বি মায়ারের সাথে পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে। এই সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে তার হলিউডে যাত্রা শুরু হয়। তিনি তার অভিনয়, সৌন্দর্য এবং উচ্চারণভঙ্গি দিয়ে আমেরিকান দর্শকদেরকে মোহিত করে তুলেছিলেন।
উদ্ভাবনী যাত্রা
হলিউডে অভিনয়ের সময় লামারের অনেক ধরনের মানুষের সাথে পরিচয় হয়। এর মধ্যে পাইলট হাওয়ার্ড হিউজের উদ্ভাবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষার জন্য লামার তার প্রতি বিশেষভাবে আগ্রহী হন। তার বৈজ্ঞানিক মন হলিউডের মাঝে বাধা পড়েছিল। কিন্তু হিউজের অনুপ্রেরণা ও সাহায্য সেই বাধা দূর করতে শুরু করে।
লামারের সেটে তার ট্রেলারে ব্যবহার করার জন্য হিউজ বিভিন্ন সরঞ্জামের একটি ছোট সেট দেন। এর মাধ্যমে লামার বিভিন্ন কাজ ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের জন্য কাজ করতেন। একবার হিউজ তাকে উড়োজাহাজ কারখানায় নিয়ে কীভাবে বিমান তৈরি হয় এবং প্রক্রিয়াটির পেছনে থাকা বিজ্ঞানীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
হিউজ দ্রুততর বিমান তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা মার্কিন সেনাবাহিনীর কাছে বিক্রি করা যেতে পারে। লামার তাকে সাহায্য করতে মাছ এবং পাখির একটি বই কিনেন। বইয়ের মধ্য থেকে তিনি মাছ ও পাখির দ্রুততম প্রজাতি নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি দ্রুততম মাছের পাখনা এবং দ্রুততম পাখির ডানা একত্রিত করে হিউজের বিমানের জন্য একটি নতুন ডানার নকশা তৈরি করেন। হিউজকে নকশাটি দেখানোর পরে, তিনি লামারকে বলেছিলেন,
তুমি একজন জিনিয়াস।
লামার প্রকৃতপক্ষেই প্রতিভাবান ছিলেন কারণ তার উদ্ভাবক মনে সবসময়ই বিভিন্ন আইডিয়া ঘুরতে থাকতো। তিনি একবার বলেছিলেন,
যেকোনো কিছুর অবস্থার উন্নতি করার চিন্তা আমার কাছে
স্বাভাবিকভাবেই আসে।
তিনি একটি আপগ্রেডেড স্টপলাইট এবং একটি ট্যাবলেট তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা কোকাকোলার মতো সোডা তৈরি করতে পানিতে দ্রবীভূত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সাথে সাথে তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের কাজ শুরু হয়।
২য় বিশ্বযুদ্ধে লামারের আবিষ্কার
১৯৪০ সালে লামার একটি ডিনার পার্টিতে জর্জ অ্যানথিলের সাথে দেখা করেছিলেন। অ্যানথিল তার লেখা, ফিল্ম স্কোর এবং এক্সপেরিমেন্টাল মিউজিক কম্পোজিশনের জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি লামারের মতোই উদ্ভাবনে আগ্রহী ছিলেন।
তাদের দুইজনের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল যুদ্ধ। লামারের যুদ্ধাস্ত্র এবং বিভিন্ন অস্ত্রের জ্ঞান ছিল। তাই, লামার এবং অ্যানথিল একসাথে কাজ করতে শুরু করেন। লামার যখন শুনলেন যে, আটলান্টিক অতিক্রমকারী একটি যাত্রীবাহী জাহাজ জার্মান ইউ-বোট ডুবে ৮০ জন শিশু মারা গেছে, তখন তিনি মিত্রবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন।
যুদ্ধে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে টর্পেডোকে গাইড করার জন্য একটি অসাধারণ নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে আসেন লামার আর অ্যানথিল। সিস্টেমটি রেডিও তরঙ্গে ‘ফ্রিকোয়েন্সি হপিং’ এর ব্যবহার যুক্ত করে যাতে ট্রান্সমিটার এবং রিসিভার একসাথে নতুন ফ্রিকোয়েন্সিতে হপিং করে।
এটি রেডিও তরঙ্গের বাধা রোধ করে, ফলে টর্পেডো সহজেই তার লক্ষ্য খুঁজে পায়। একটি পিয়ানো রোল ব্যবহার করে ৮৮টি ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির মধ্যে পরিবর্তন করা হতো। মূলত জার্মান নাৎসিদের পরাজিত করার জন্য ডিজাইন করা সিস্টেমটি, সামরিক যোগাযোগ এবং সেলুলার ফোন উভয়ের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
লামার ওয়াশিংটনে জাতীয় উদ্ভাবক কাউন্সিলে যোগদানের চেষ্টা করেছিলেন। এটি একটি সরকারী সংস্থা যা ১৯৪০ সালে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর জন্য সম্ভাব্য সামরিক উদ্ভাবন আনতে সাহায্য করতে তৈরি হয়েছিল। তাকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে, তিনি যদি সত্যিই কিছু করতে চান, তার উচিত তার সৌন্দর্য ব্যবহার করে যুদ্ধের বন্ড বিক্রি করা এবং সৈন্যদের বিনোদন দেওয়া।
কিন্তু সাহায্যে মরিয়া লামার যুদ্ধের বন্ড বিক্রি করে যুদ্ধে সাহায্যের চেষ্টা করেন। তার সৌন্দর্য তার অভিশাপে পরিণত হয়েছিল। তিনি পরে বলেছিলেন যে,
আমার চেহারা আমার দুর্ভাগ্য। এটি পাঁচ দশক ধরে আমাকে ট্র্যাজেডি এবং কষ্ট দিয়ে এসেছে। এটি আসলে একটি মুখোশ যা আমি সরাতে পারি না, আমাকে সবসময় এর সাথেই থাকতে হবে। আমি অভিশাপ দেই আমার সৌন্দর্যকে।
লামার এবং অ্যানথিল তাদের উদ্ভাবনের জন্য একটি পেটেন্ট এবং সামরিক সহায়তা চেয়েছিলেন। ১৯৪২ সালের আগস্টে মার্কিন পেটেন্ট নং ২,২৯২,৩৮৭ পুরস্কৃত করার সময়, নৌবাহিনী নতুন সিস্টেম বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়।
শেষ জীবন
১৯৫৩ সালের এপ্রিলে তিনি আমেরিকান নাগরিক হন। জীবনের শেষ পর্যায়ে, লামার ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর উত্তরে ক্যাসেলবেরিতে একান্ত জীবনযাপন করেন। যেখানে তিনি ২০০০ সালের ১৯ জানুয়ারি, ৮৫ বছর বয়সে মারা যান।
স্বীকৃতি
লামারের পেটেন্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এর থেকে অর্থ উপার্জনের আগেই। তার উদ্ভাবনী প্রতিভা তখনও জনসাধারণের স্বীকৃত পায়নি। লামার পরবর্তী বছর পর্যন্ত তার আবিষ্কারের জন্য কোনো পুরস্কার পাননি। ১৯৫৮ সালে ‘দ্য ফিমেল অ্যানিমেলে’ লামার তার শেষ দৃশ্যের শুটিংয়ের সময়, তার পেটেন্ট করা আবিষ্কার অন্যান্য উদ্ভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
সিক্রেট কমিউনিকেশন সিস্টেমটি ৫০-এর দশকে বেসরকারি খাতে সিডিএমএ নেটওয়ার্কের বিকাশের সময় ব্যবহার করা হয়। নৌবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে ৬০-এর দশকে কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সময় প্রযুক্তিটি গ্রহণ করে।
ইলেক্ট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশন ১৯৯৭ সালে যৌথভাবে লামার এবং অ্যানথিলকে তাদের ‘পাইওনিয়ার অ্যাওয়ার্ড’ দিয়ে ভূষিত করে। লামার প্রথম নারী যিনি ইনভেনশন কনভেনশনের ‘বুলবি গনাস স্পিরিট অফ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন।
২০১৪ সালে তার ফ্রিকোয়েন্সি হপিং প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য ‘ন্যাশনাল ইনভেনটরস হল অব ফেমে’ অন্তর্ভুক্ত হন। এই কৃতিত্ব লামারকে ওয়াই-ফাই, জিপিএস, ব্লুটুথ এবং অন্যান্য ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনের উদ্ভাবনে নিজের ভূমিকা প্রকাশে ব্যাপক সহায়তা করে।
তথ্যচিত্র এবং পপ সংস্কৃতি
২০১৭ সালে, পরিচালক আলেকজান্দ্রা ডিন একটি ডকুমেন্টারি, ‘বম্বশেল: দ্য হেডি লামার স্টোরি’ (Bombshell: The Hedy Lamarr Story)-এর মাধ্যমে তার জীবনের উপর আলোকপাত করেন। লামারের জীবনের একটি নাটকীয় সংস্করণ ২০১৮ সালের মার্চ মাসে টিভি সিরিজ ‘টাইমলেস’-এর একটি পর্বে প্রদর্শিত হয়।
কর্মক্ষেত্রে বিশেষ করে বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনের জগতে নারীর অবস্থান ও মূল্যায়ন সবসময়ই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতিকূলতার মধ্যে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের পরও নারীকে শুধু তার বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে বিচারের অন্যতম উদাহরণ হেডি লামার।
আজও তার অভিনয়ের পেছনে তার মেধা ঢাকা পড়ে আছে। তার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে যথেষ্ট সময়ক্ষেপণ হয়েছে। কিন্তু, তার গল্পই আমাদের মনে করিয়ে দেয় মানুষের মেধা আর দৃঢ়তার শক্তি যা অনুপ্রেরণা দিবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
Featured Image: roadandtrack.com References: 01. Hedy Lamarr. 02. The World War II Era Actress That Invented Wi-Fi Hedy Lamarr. 03. Hedy Lamarr. 04. The Life of Hedy Lamarr History Forgotten Hollywood Genius.