আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন লাইব্রেরি: উত্থান, পতন ও ধ্বংসের কারণ

203
0
Source: https://short-history.com/library-of-alexandria-13c1e5c98a18

প্রাচীনকালের সবচেয়ে বিখ্যাত লাইব্রেরি হলো আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি। বর্তমানে এটি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি অংশ গঠন করে যেটি আলেকজান্দ্রিয়ান মিউজিয়াম নামে পরিচিত। মিশরের বিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিটি ছয় শতাব্দী ধরে বিকাশ লাভ করেছিল এবং ধবংসের মুখে পড়ার আগ অবধি এটি ছিল প্রাচীন হেলেনিস্টিক বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের একটি কেন্দ্রবৃন্দ।  

আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন লাইব্রেরি ছিল সেই সময়ের মিশরের ঐশ্বর্য এবং ক্ষমতার প্রতীক। সারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বই এনে সেখানে তার অনুলিপি তৈরি করে সংগ্রহ করা হতো। আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির কাজ ছিল বিশ্বের জ্ঞান সংগ্রহ করে রাখা। এই প্রাচীন লাইব্রেরিতে কত সংখ্যক বই ছিল তার সঠিক হিসেব না যায় না।

তবে অনুমান করা হয় যে, লাইব্রেরিতে প্রায় ৭ থেকে ৮ লক্ষ বই সংগ্রহ করা ছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে বইগুলো সংগ্রহ করা হতো প্যাপিরাসের আকারে। ৩০০ খ্রিস্টপূর্বের পরে থেকে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে কোডেক্স ব্যবহার শুরু করা হয়। 

আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির ইতিহাস অনেক বড় এবং অনেক সময় যাবত বিস্তৃত। আজকের আলোচনায় আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন লাইব্রেরি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা হবে। ঘুরে বেড়ানো হবে ইতিহাসের সেই সময়ে, যখন আলেকজান্দ্রিয়া ছিল জ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখরে।  

Image Source: https://www.bibalex.org/SCIplanet/en/Article/Details.aspx?id=13521

আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন লাইব্রেরির ইতিহাস

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মিশরের টলেমিক রাজবংশের মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল মিশরের প্রধান একটা  লাইব্রেরি আলেকজান্দ্রিয়া । যেটার অবস্থান মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে হবার কারণে এটার নামকরণ করা হয় লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া। 

মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যত লাইব্রেরিটি ছিলো বিশ্বের প্রাচীন জ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভান্ডারগুলির মধ্যে একটি অন্যতম ভান্ডার। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দিতে এটি নির্মিত হয়ে ছয়শ শতাব্দি ধরে বিকাশ লাভ করেছিল, বিশ্বের পান্ডুলিপির বৃহত্তম সংগ্রহ এবং এতে অর্ধ মিলিয়ন প্যাপিরস স্ক্রোল ছিলো এই প্রাচীন লাইব্রেরিতে। 

লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আফ্রিকান সাংস্কৃতিক প্রত্নতত্ত্বের চেয়ার উইলকে ওয়েনড্রিচ, মিশরীয় প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক এবং জোয়ান সিলসবি চেয়ারে বলেন, আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন লাইব্রেরিটি সম্ভাবত  খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ সালে আলেকজান্দ্রিয়ার শহরের পরপরই তৈরি করা হয়েছিল। তবে লাইব্রেরিটি আলেকজান্ডার টলেমি বা তার ছেলে টলেমি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো কিনা এই বিষয়টা স্পষ্ট হয় তবে সম্ভাবনা করা হয় ২৮৪ থেকে ২৪৬ খ্রিস্টপূর্ব শাসনকারীর অধীনে লাইব্রেরির ফলপ্রসূ হয় বলে ধারণা করা হয়।   

পঞ্চম শতাব্দীর মধ্য আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন লাইব্রেরিটি মূলত বিলুপ্ত হয়ে যায়। যদি এর পরে এটি অপ্রচলিত হওয়ার অনুমুতি প্রদান করা হয় কিন্তু তবুও এটি আগের মতো প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হয়। 

আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেবির গুরুত্বপূর্ণ দলিল 

Image Source: https://talesoftimesforgotten.com/2020/04/04/what-was-really-in-the-library-of-alexandria/

আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির অসংখ্য দলিল রয়েছে। তারমধ্যে নিন্মে কয়েকটি দলিল উল্লেখ করা হলোঃ 

  • টলেমি ৭২ জন র‍্যাবিস কে হিব্রু থেকে গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করার জন্য আহবান জানান।যেটিকে “Septuagint” বলা হয়। যা বাইবেলের একটি ভার্সন হিসেবে খ্রিষ্টপূর্ব ২য় বা ৩য় শতাব্দিতে হেলেনীয় ইহুদি ও পূর্ববর্তী খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক এর দ্বারা ব্যবহৃত হত। 
  • অ্যারিস্টার্কাসই প্রথম ব্যক্তি যিনি কোপার্নিকাসের ও ১৮০০ বছর পূর্বে বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। 
  • এয়াটোস্থেন্স, কলম্বাসের ১৭০০ বছর পূর্বে  প্রমাণ করেন যে পৃথিবী পোলাকার এবং তিনিই সর্বপ্রথম নির্ভুল ভাবে পৃথিবীর পরিধি পরিমাপ করেন। 
  • হিপার্কাস সবার প্রথমে তারকাদের গতিপথ নির্ণয় করেন এবং সাড়ে ছয় মিনিটের মধ্যে সৌরবছরের হিসাবটি গণণা করেন। 
  • কবি ক্যালিমাকাসকে বলা হতো লাইব্রেরীবিদ্যের জনক, তিনি আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেবীর পুস্তক সমহের বিষয় এবং লেখক অনুসারে লাইব্রেরীকে সজ্জিত করেছিলেন।
  • হিরোফিলাস সর্বপ্রথম মস্তিষ্ক-কে নিয়ন্ত্রক অঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং তিনিই প্রথম চিকিৎসাবিদ্যার একটা নতুন ধারণার সূচনা করেন। 
  • ইউক্লিড রচিয়িত “Elements” গ্রন্থটি, যেটি এখনো সারা পৃথিবীর স্কুলগুলোতে মূল পাঠ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটিও আলেকজেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়। 

আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন লাইব্রেরি ধবংসের কারণ    

জ্ঞানবিজ্ঞানের সমৃদ্ধ প্রচীন লাইব্রেরি ধবংসের অনেকগুলো কারণ থাকলেও মুলত চারটি কারণকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নিন্মে কারণ গুলো উল্লেখ করা হলোঃ 

কারণ -১ 

গ্যালিয়াস, মারসেলিনাস, প্লুটার্ক এবং আরোসিয়াস এর তথ্য অনুসারে, জুলিয়াস সিজার যখন ৪৮ খ্রিস্টপূর্বে টলেমির সাথে যুদ্ধে ছিলেন ঠিক সেই সময়ে আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণের সময় তার সেনারা দূর্ঘটাবশত লাইব্রেরিটিতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং এর ফলে লাইব্রেরি টি পুরিয়ে যায়। 

কারণ- ২ 

ধারণা করা হয় আগুন লেগে পুরে যাওয়ার পরেও লাইব্রেরি টির অস্তিত্ব ছিলো। কিন্তু সম্রাট অরেলিয়ান ২৭৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পাল্মিরার রাণী জেনোবিয়ার বিদ্রোহ প্রতিরোধ করতে গিয়ে যুদ্ধের সময়ে লাইব্রেরির প্রধান অংশ টি যে অঞ্চলে অবস্থিত সেটি একেবারেই ধবংস করে ফেলেন। তবে সাহায্যকারী অংশ যেটির অবস্থান সেরাপিয়ামে অবস্থিত সেটা এখনো অক্ষত  আছে। 

কারণ-৩

 ৩৯১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সম্রাট থিয়োডোসিয়াস একটি অধ্যাদেশ জারি করেন একই সেই সাথে  প্যাগান মতবাদকে নিষিদ্ধ করেন। আর এটার ফলে আলকজান্দ্রিয়ার প্রট্রিয়ার্ক থিয়োফেলাস প্যাগান উপাসনালয়গুলো বন্ধ হয়ে যায়। আর এই কারণে প্যাগানদের হাতের নির্মিত সেরাপিয়ামে অবস্থিত লাইব্রেরির বাকী অংশটিও ধবংস হয়ে যায়। 

কারণ-৪ 

সর্বশেষে সেই ব্যক্তিকে দায়ী করা হয় লাইব্রেরিটি ধবংসের জন্য তিনি হলেন খলিফা হযরত ওমর রাঃ। ৬৪০ সালে মুসলমানেরা আলেকয়ান্দ্রিয়া জয়ে করে শাসন প্রতিষ্ঠা করে।সিরিয়ার খ্রিষ্টান লেখকের একটি গ্রন্থ থেকে জানতে পারা যায় যে, ওমর তার  সেনাপতি কে বলেন যে, যদি এই লাইব্রেরির গ্রন্থগুলো কুরআন এর পরিপন্থি এবং কুরআন এর সাথে গ্রন্থগুলোর মতবাদ মিলে যায় তাহলে এগুলা থাক আর যদি কুরআনের বিরোধি হয় তাহলে এগুলা ধবংস করো। আর এর ফলে সকল পুস্তকসমূহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে এই লেখার ভিত্তি তেমন জোড়ালো না।  

আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির বইয়ের শ্রেণীবিভাগ

আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে ছিলো বিশ্বের অসংখ্য বই আর এই কারণে বই খুজে পেতে বইগুলো তে লেখক এবং বইয়ের ক্যাটাগরিতে আলাদা আলাদা করে রাখা হতো। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে দায়িত্বরত বইয়ের শ্রেনীবিভাগ করী গ্যালেন লাইব্রেরীর প্রতিটি বইয়ের জন্য রেকর্ড করতেন এবং সেটার তথ্য সংগ্রহ করে রাখতেন। 

তিনি তার রেকর্ডে কাজের শিরোনাম, লেখক এবং সম্পাদের পাশাপাশি এর উৎসের লাইন , স্থান সমূহ ও অন্তর্ভুক্ত করে রাখতেন। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে একজন লেখকের বেতন নির্ভর করতো লেখার মান ও লাইন সংখ্যার উপর ভিত্তি করে। সেই সময়ে একজন লেখকের বেতনকে নির্ধারণ করা হতো, 

সেরা মানের লেখার জন্য লেখকে প্রতি ১০০ লাইনে ২৫ দিনারি এবং দ্বিতীম মানের লেখার জন্য ১০০ লাইনে ২০ দিনারি এবং আইনি নথি লেখার জন্য প্রতি ১০০ লাইনে ১০ দিনারি প্রদান করা হতো। এছাড়াও “শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে” লাইব্রেরির বিষয়বস্তুগুলির একটি গ্রন্থপঞ্জীমূলক জরিপ করার একটি অসাধারণ উদ্যোগ নেওয়া ছিলো, যেটার দায়িত্ব দেওয়া ছিলো সেই সময়ের বিশ্বকোষ পান্ডিত্যখ্যাত গ্রীক কবি ক্যালিমাকাস। তিনি সম্পূর্ণ লাইব্রেরিটিকে কয়েকটি খন্ডে বিভক্ত করেছিলেন, এদের মধ্যে ছিলো অলঙ্কার শাস্ত্র, আইন , মহাকাব্য, ট্র্যাজেডি, কমেডি, গীতকবিতা, ইতিহাস, চিকিৎসা, গণিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং বিধিধ। 

গ্রীক এবং মিশরীয় নথির পাশাপাশি আরও অন্যান্য জাতির লিখিত রচনাগুলিও অন্তুর্ভুক্ত ছিলো আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন প্রন্থাগারে। লাইব্রেরিটি বই এবং নথি সংগ্রহের পাশাপাশি , আন্তজার্তিক পন্ডিত কবি, গবেষকদের আবাস স্থল হিসেবেও কাজ করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব গ্রীক ভূগলবিদ স্ট্র্যাবোর মতে সেই সময়ে লাইব্রেরিতে অবস্থানরত আন্তজার্তিক কবি, পন্ডিত, গবেষকদের একটি বড় বেতন, বিনামূল্যে খারব এবং বাসস্থানের পাশাপাশি তাদের কর থেকেও অব্যহতি প্রদান করা হতো। 

 

 

 

Feature Image: faena.com 
References

01. Library of Alexandria. 
02. Rise and Fall of the Great Alexandria Library. 
03. Library of Alexandria. 
04. The Royal Library of Alexandria.