স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। এই প্রবাদটি সবারই জানা। এর সাথে আমরা এটিও জানি, শারীরিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহনের গুরুত্ব অপরিসীম। সঠিক পরিমানে সুষম খাবার গ্রহন, পুষ্টিগুণ অনুসারে খাদ্য বন্টন করা যেমন প্রয়োজনীয় তেমনই শরীরে জমে থাকা টক্সিন কিংবা বিষাক্ত পদার্থকে বের করে দেওয়াও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রতিদিনকার বর্জ্য পদার্থ পরিপাকতন্ত্র এবং রেচনতন্ত্রের মাধ্যমে শরীর থেকে নিষ্কাশিত হয়।
কিন্তু তারপরেও শরীরে কিছু দূষিত পদার্থ ক্ষতিকর চর্বি তথা লো-ডেন্সিটি কোলেস্টেরল হিসেবে জমা থাকে যা সাধারনভাবে শরীর থেকে বের হতে চায় না। খাবার গ্রহনের পরিমান কমানোর মাধ্যমে কিংবা নির্দিষ্ট সময়ে খাবার গ্রহনের অভ্যাস গড়ে তুললে এই ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থগুলোকে শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলা সম্ভব। আর এই অভ্যাস গড়ে তোলার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে উপবাস কিংবা ফাস্টিং। কিন্তু ফাস্টিং বা উপবাস কী এটি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী? আজকের আলোচনা শুরু করা যাক।
উপবাস কী?
উপবাস হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খাবার, পানীয় বা উভয়ই গ্রহন থেকে বিরত থাকা বা গ্রহনের পরিমান হ্রাস করা। সম্প্রতি অনেক গবেষনায় স্বল্প বা দীর্ঘ সময়ের উপবাসের উপকারিতা পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই উপবাস হতে হবে স্বাস্থ্যকর উপায়ে। শুধু দীর্ঘক্ষন আহার গ্রহন না করলেই উপবাসের বৈজ্ঞানিক ফলাফল লাভ করা যাবে তা ভুল। স্বাস্থ্য ক্ষেত্র নিয়ে গবেষনা থেকে জানা গেছে উপবাস হতে হবে সঠিক নিয়মে, তবেই এটিকে ওজন নিয়ন্ত্রণ ও রোগ প্রতিরোধের একটি উপায় হিসেবে গ্রহন করা যাবে।
যে উপায়ে উপবাস শরীরের টক্সিন দূর করে তাকে বলা হয় অটোফেজি। যখন আমরা দীর্ঘক্ষন না খেয়ে থাকি, তখন শরীর প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ পায় না, ফলে শরীরের কোষগুলো শক্তি উৎপাদনের জন্য অন্যান্য উপায় অবলম্বন করে। তার একটি হলো গ্লুকোনিওজেনেসিস। এর মাধ্যমে শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত চর্বি থেকে শক্তি উৎপাদিত হয়। ফলে টক্সিন জাতীয় পদার্থের পরিমান রক্তে বাহিত হয়ে বৃক্কের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এরই সাথে স্থুলতা কমাতে, রক্তে ইনসুলিনের পরিমান কমিয়ে রক্তের গ্লুকোজ লেভেল কমাতে সাহায্য করে। যা পরবর্তীতে রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
খাদ্য গ্রহনের পরিমান, সময়, পুষ্টি চাহিদা অনুযায়ী উপবাসের কয়েকটি ধরন রয়েছে। শরীরের চাহিদা ও ধরন অনুযায়ী যেকোনো একটি অনুসরন করলেই উপবাসের উপকারিতা পাওয়া সম্ভব।
সময় অনুযায়ী খাদ্য গ্রহন
খাদ্য গ্রহনের জন্য সঠিক সময় নির্বাচনের মাধ্যমে এই উপবাস করা হয়। আর সময় নির্বাচন করা হয় দেহঘড়ি কিংবা বায়োলজিকাল ক্লক অনুযায়ী। যেমন সকালে ৮টার মধ্যে সকালের নাস্তা করা এবং রাতের ৮টার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করা। যেহেতু দিনের বেলায় সাধারণত আমরা কাজে ব্যস্ত থাকি, সেই সময়টাতে শরীর সহজেই খাদ্যকে শক্তিতে রূপান্তর করে।
পরবর্তী সময়ে রাতে শরীর যখন বিশ্রামে থাকে তখন বাকি জমে থাকা শক্তির আধার তথা চর্বিকে গ্লুকোজে পরিণত করে শরীর শক্তিতে পরিণত করে বেসাল মেটাবলিক রেইটে (বিশ্রামের সময় আমাদের শরীর যে পরিমাণ শক্তি ক্ষয় করে) খরচ করে। এভাবেই শরীর থেকে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমে যায়।
বিরতিহীন উপবাস কিংবা ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং
বর্তমানে এটি বহুল প্রচলিত একটি ডায়েট প্ল্যান। গবেষনায় এর বিভিন্ন উপকারিতা দেখা গেছে। এই ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি খাদ্য গ্রহনের সময়কে নির্দিষ্ট গন্ডিতে রাখবে। যেমন দিনের যেকোনো ৮ ঘন্টার মধ্যে সারাদিনের ক্যালোরি গ্রহন করবে, আর বাকি ১৬ ঘন্টায় কোনো ক্যালোরি গ্রহন করবে না।
ক্যালোরি গ্রহন মানে এমন খাদ্য গ্রহন যা শরীরে শক্তি জোগায়। এর সবচেয়ে সুবিধা হলো দিনের বা রাতের যেকোনো ১৬ ঘন্টা উপবাসের জন্য বাছাই করা যাবে। এতে সেই ১৬ ঘন্টাতে শরীর জমানো কোলেস্টেরল ভেঙে গ্লুকোজ তৈরি করবে, এতে রক্তনালী থেকে খারাপ কোলেস্টেরল দূর হবে। এটি হৃদরোগ ও ডায়বেটিসের ঝুঁকি কমাতে বিশেষ উপকারী।
ইসলাম ধর্মানুসারিরা রমজান মাসে এক মাসব্যাপী সিয়াম পালনের মাধ্যমে অটোফেজি প্রক্রিয়ার শরীরের অতিরিক্ত চর্বি ও টক্সিন দূর করে। গবেষনায় দেখা গেছে, এক মাসব্যাপী সিয়াম পালন করা টাইপ-২ ডায়বেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার এসব রোধ করতে সহায়তা করে।
পর্যায়ক্রমিক উপবাস:
এই উপবাসকে পর্যায়ক্রমিক বলা হয়ে থাকে কারণ এইক্ষেত্রে মূলত সারাদিনে অল্প অল্প খাবার গ্রহন করে ক্যালোরি নিয়ন্ত্রন করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার, যেমন: সাদা ভাত, রুটি, পরোটা, সাদা পাউরুটি, সাদা চিনি এসব খাবার থেকে বিরত থাকা হয়।
এরই সাথে সারাদিনের খাবারকে ১০০০-১২০০ ক্যালোরির মধ্যে বেঁধে ফেলা হয়। যেহেতু একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের সারাদিনে সাধারণত ১৪০০-১৫০০ ক্যালোরি প্রয়োজন হয়, বাকি ক্যালোরি শরীর জমে থাকা চর্বি থেকে প্রস্তুত করে। ফলে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল বা লিপোপ্রোটিন হ্রাস পায়।
শরীরের প্রয়োজন ও নিজের সুবিধা অনুযায়ী উক্ত উপবাসের যেকোনো একটি গ্রহন করলেই উপবাসের উপকারিতা পাওয়া সম্ভব। এবারে জেনে নেই উপবাসের উপকারিতাগুলো কী কী:
১. শরীরের অতিরিক্ত ওজন ও মেদ কমাতে সাহায্য করে।
২. স্থুলতা থেকে সৃষ্ট রোগ থেকে মুক্তি দেয়।
৩. শরীরের কর্মক্ষমতা ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা বাড়ায়।
৪. শরীরের অতিরিক্ত ও ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
৫. রক্তে গ্লুকোজের পরিমান কমিয়ে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে।
৬. এটি লিভারে জমে থাকা চর্বি কমিয়ে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি কমায়।
৭. কোষ মেরামত ও দেহে হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে৷
৮. এটি উচ্চ রক্তচাপ কিংবা হাইপারটেনশনের ঝুঁকি কমায়।
৯. এটি ক্যান্সার রোধ করতে সহায়তা করে।
১০. উপবাসের ফলে স্নায়বিক বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
উপবাস কিংবা ফাস্টিং এর উপকার পাওয়ার জন্য শুধু খাদ্য গ্রহন নিয়ন্ত্রণ করলেই চলবে না, এর সাথে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্য গ্রহনের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। যেমন:
১. শরীরের ওজন অনুযায়ী প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহন করা। যেমন: যদি একজন ব্যক্তির ওজন হয় ৭০ কেজি, তাহলে তার প্রতিদিন ৭০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহন করতে হবে।
২. সরল শর্করার পরিবর্তে জটিল শর্করা শরীরের জন্য বেশি উপকারী৷ যেমন: সাদা আটার পরিবর্তে লাল আটার রুটি খাওয়া।
৩. প্রচুর পানি পান করতে হবে৷ প্রতিদিন অন্তত ৩-৪ লিটার পানি পান করা উচিত৷
৪. ফল, সবুজ শাক সবজি গ্রহনের প্রবন্তা বাড়াতে হবে৷ প্রতিদিন অন্তত একটি মৌসুমী ফল খাওয়া উচিত৷
৫. রান্নায় তেল ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির মাসে ৫০০ মি.লি. এর বেশি তেল খাওয়া উচিত না।
৬. সাদা চিনি পরিহার করা উচিত।
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য সুন্দর জীবনব্যবস্থার বিকল্প নেই। আর এর প্রথম ধাপ হলো পরিমিত খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা। উপবাসের মাধ্যমে যেমন অতিরিক্ত মেদ, কোলেস্টেরল ঝেরে ফেলা সম্ভব তেমনি শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টিগুনসম্পন্ন খাবার গ্রহন করে শরীর গঠন করাও সহজতর। এতে বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন তথা বিএমআই বজায় রেখে জীবনধারণ করা যায়।
যেকোনো উপবাস শুরু করার আগে অবশ্যই শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করা উচিত। যদি কোনো ব্যক্তি দীর্ঘমেয়াদি কোনো রোগ যেমন ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ কিংবা হৃদরোগে ভোগে তাহলে উপবায়া শুরু করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
Feature Image: cleavelandheartlab.com Sources: 01. 10 Evidence-Based Health Benefits of Intermittent Fasting. 02. The Science, Methods, and Benefits of Fasting. 03. Intermittent fasting: Nutritionist on tips to make fasting easier and healthier. 04. Intermittent fasting: Fasting to lose weight.