শিক্ষা

4274
0

#লাশটা ছয় দিন আগের,পচতে আরম্ভ করেছে।মুখটা তো বোঝাই যাচ্ছে না। আজই আমার কাছে এসেছে। কে বা কারা যেন ছেলেটিকে মেরে রাস্তার পাশে পচাঁ ডোবার কচুরিপানার মধ্যে খুব যত্ন করে চাপা দিয়ে রেখে গিয়েছিল । আজ ছয় দিন পরে লাশের গন্ধে ডোবার আশেপাশের লোকজন অতিষ্ঠ হলে, তারা পুলিশকে খবর দেয়।পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে সোজা আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।

আমাকে চিনেছেন তো?……আরে হ্যা, আমি ডোম-লাশ কাটি। এই পেশায় গত নয় বছর ধরে আছি। প্রথম প্রথম লাশ আর রক্ত দেখলেই মায়া লাগতো। তখন মার্ডারের কেসগুলো দেখে মনে হত- আচ্ছা,মৃত্যুতেই কি সব শেষ হয়ে যাবে?…একজনকে মারলেই কি খুনি তার হারানো সময় বা সুযোগ ফিরে পাবে? যে ছেলেটি বা মেয়েটিকে আজ হত্যা করা হল,তাকে কি সময় নিয়ে বোঝালে, বুঝতো না? ..হত্যার বিকল্প কী কিছু নেই?… আরো অনেক প্রশ্ন ভিড় জমতো, কিন্তু এখন পচাঁ-গলা,দেহাঙ্গ বিহীন লাশ দেখতে দেখতে অভ্যাস হয়ে গেছে-যেন পান্তা ইলিশ । কথায় আছে না..” মানুষ অভ্যাসের দাস”।

লাশটাকে কাছ থেকেই দেখছি। দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটির বয়স একুশ কি বাইশ। উচ্চতা মাঝামাঝি। পরনে একটা কালো রঙের প্যান্ট আর ফুল হাতা গেঞ্জি। গেঞ্জিটার বিভিন্ন জায়গায় ছেঁড়া- দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটার সাথে অনেক ধস্তাধস্তি হয়েছে;খুনিকে মারতে বেগ পেতে হয়েছে।
আজকে আমার সহকর্মী ইমরুলের আসতে দেরী হচ্ছে,ওর স্ত্রী নাকি খুব অসুস্থ। তাই আমার একার ঘাড়েই কাঁটা-ছেঁড়া করার দায়িত্ব পরেছে।

হাতের সিগারেট ফেলে দিয়েছি,এখুনি আমার কাজ শুরু না করলে, পরে সমস্যা হবে-এমনিতেই লাশ পচতে শুরু করেছে। হঠাৎ কেন জানি মনে হল-লাশটা আমার দিকেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এবং সে আমায় কিছু বলতে চাচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল এর আগেও অনেকবার এরকম হয়েছে এবং আমি প্রত্যেকবার ভয় পেয়েছি।কিন্তু আজ ভয় জাতীয় কোন কিছু মনে কাজ করছে না।
হঠাৎ বেডে শুয়ে থাকা লাশটি বলে উঠলো…

-আপনার নাম নুরুল বণিক ?

আমি হকচকিয়ে গেলাম। কেউকে হিপনোটাইটিস করলে যেমন সে অন্যের বাধ্যগত হয়ে যায়, আমার অবস্থাও তেমন হল এবং কোনকিছু না ভেবেই উত্তর করে গেলাম।

-হ্যা। আমি নুরুল বনিক।

-আমায় চেনেন?

-না।আজকেই প্রথম দেখলাম। তাছাড়া আপনার মুখ তো বোঝা যাচ্ছে না।

-বুঝবেন কি ভাবে? ওরা তো আমার মুখ ইট দিয়ে থেঁতলে দিয়েছে।যাতে কেউ আমার লাশ দেখে চিনতে না পারে। আচ্ছা,আমাকে দেখে আপনার ভয় করছে না?

-না।

-আমার কিন্তু ভয় করেছিল। যখন ওরা আমার হাত পা বেধে রেখেছিল এবং আমার সামনেই সমস্ত প্লান সাজিয়েছিল, তখন বারবার মা আর ছোট বোনের কথা মনে পড়ছিল। একটা মজার ব্যাপার কি জানেন?….আমি জানতাম এই পৃথিবীতে আমাকে আর বেশি দিন রাখা হবে না।

-কিভাবে জানতেন?

-আমাকে থ্রেড করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল…,” আমি যদি অর্ণার জীবন থেকে সরে না যাই, আমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে।”

-অর্ণা কে?

-আমার গার্লফ্রেন্ড। বলা যায় জীবিত অবস্থায় সে ছিল আমার ভালো থাকার অন্যতম কারন। অনেক ভালোবাসতাম তাকে এবং এখনো বাসি।

– এখন সে কোথায়?

– ওদের কবলে। ওরা ওকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে।

– ওরা কে? কি হয়েছিল?

– অনেক দিন ধরেই এলাকার একজন নামকরা বড় ভাইয়ের নজর পড়ে অর্ণার দিকে, সে প্রায়শই অর্ণাকে বিরক্ত করতো।অর্ণা আমাকে বিষয়টি বলেছে এবং বিষয়টি থানায় জানিয়েছিলাম। পুলিশ সোহেলকে থানায় ইভটিজিং এর মামলায় ধরে নিয়ে যায়। তবে কোন বিশেষ কারনে তাকে বেশি সময় আটকে রাখতে পারে না,সে ছাড়া পেয়ে যায়। এতে সোহেলের মাথায় রক্ত উঠে যায় তবে তৎক্ষণাৎ কিছু বলে না। কথায় আছে না…,” ঝড় শুরুর পূর্ব মুহূর্তে পরিবেশ নিরব থাকে।” …… আপনি কি আমার কথা শুনছেন?

– হ্যা, শুনছি।তারপর কি হল?

– সেইদিন কলেজ থেকে দুইজনে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরছিলাম। অর্ণা গান গাচ্ছিল আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। হঠৎ আমাদের সামনে একটা কালো রঙের জীপগাড়ি থামে।
আমার মাথায় ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করে এবং আমি জ্ঞান হারাই। জানেন, ওইটাই ছিল অর্ণার সাথে আমার শেষ দেখা।

– তারপর?

– তারপর আর কি? ওরা আমার এই অবস্থা করে।

– অর্ণাকে কি ওরা মেরে ফেলেছে?

– না এখনো তা করে নি;ওদের লালসা মেটে নি যে!

– আপনি যে বড় ভাইয়ের কথা বলেছিলেন,তার নাম কি?

– সোহেল বণিক। কলেজ রোডে গ্যারাজ আছে। আর শুনুন আমার না অনেক কষ্ট হচ্ছে অর্ণার কথা ভেবে। ওরা জেন অর্ণাকে প্রাণে না মারে। মেয়েটার চোখে অনেক স্বপ্ন। আপনি কি শুনছেন আমার কথা?

আমি আর ছেলেটির কথা শুনতে পারছিলাম না। কারণ, সোহেল আমার একমাত্র ছেলে। তবে তার সাথে আমার যোগাযোগ বিছিন্ন। আমার চোখ রাগে আর ঘৃর্ণায় টলটল করছিল। আমি আর দেরি করলাম না। অন্য এক সহকর্মীকে ডেকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আমি দ্রুত ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলাম।

::::

পরদিন সকালে দেশের প্রায় প্রত্যেক খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠার – খবরের শিরোনাম ছিল অনেকটা এইরকম… ” পিতার সহযোগিতায় খুনি ও ধর্ষক পুত্র প্রেপ্তার। ঘটনার সাথে জড়িত অন্যদের অতিদ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।”
****

লেখকঃ অভ্রনীল_অভি