আশাপূর্ণা দেবী: বাঙালি নারীদের উজ্জীবিত করেছে যার সাহিত্য

553
0

চোখকে যদি মনের দর্পন বলা হয়, তো চিঠিকে বলা যেতে পারে মনের ফটোগ্রাফ। মনের এক একটি মেজাজ, এক একটি অনুভবের মুহূর্ত, এক একটি অবস্থা ধরা পড়ে বন্দী হয়ে থাকে চিঠিপত্রের পৃষ্ঠায়। আর এই টুকরো মুহূর্তগুলিই তো মানুষের প্রকৃত রুপকে ফুটিয়ে তোলে।

—আশাপূর্ণা দেবী।

আটপৌরে বাঙালি নারীকে এই উপমহাদেশে অবলা আর দুর্বল ভাবা হয়। কিন্তু নিজের সামাজিক অবস্থান বা পারিবারিক কঠোরতা কোনো কিছুই যাকে সাহিত্য চর্চা থেকে দূরে রাখতে পারেনি তিনি এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবী। আধুনিক সমাজে নারীদের গুরুত্ব, তাদের অধিকার, দুঃখ-বেদনার কথা তিনি অকপটে তুলে ধরতেন তার লেখায়।

শিশুসাহিত্যসহ সাহিত্যের নানা দিকে অবদান রেখে লিখেছিলেন দুইশোটিরও বেশি গ্রন্থ। এসব বই আবার অনুবাদ হতো ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষাসহ অন্যান্য নানা দেশের ভাষায়। তিনি নিজে অবশ্য বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানতেন না।  তবে তার লেখা পৌঁছে গেছে বিশ্ব দরবারের কোণায় কোণায়। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’, ‘বকুলকথা’ এর মতো লেখা তাকে নিয়ে গেছে কথাসাহিত্যিক হিসেবে অন্য এক উচ্চতায়। 

আশাপূর্ণা দেবী জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি (বাংলা ২৪ পৌষ, ১৩১৫) কলকাতায় মাতুলালয়ে। তবে তার আদি নিবাস ছিল হুগলির বেগমপুরে। বাবার নাম হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত এবং মায়ের নাম সরলাসুন্দরী দেবী। বাবা-মা দুজনেই ছিলেন শিল্প-সাহিত্যে অনুরাগী। এমনকি তার বাবা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত কমর্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে বেশ নাম করেছিলেন। 

আশাপূর্ণা দেবীর দুর্লভ একটি চিত্র। Image Source: getbengal.com

মা সরলাসুন্দরী দেবী সাহিত্যপাঠকে নিয়ে মেতে থাকতেন দারুণভাবে। বাবা-মা’র এই গুণগুলোই হয়তো পেয়েছিলেন আশাপূর্ণা দেবী, নয়তো অমন রক্ষণশীল পরিবেশেও তার লেখায় প্রতিবাদ তুলতে পারতেন না, নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারতেন না। 

পারিবারিকভাবেও অনেকভাবে বৈষম্যের শিকার হতেন আশাপূর্ণা দেবী। তার মা অনেকগুলো কন্যা সন্তানের পর আবারো আশাপূর্ণা জন্মগ্রহণ করেছেন বলে তাদের ঠাকুরমা উপহাস করেছিলেন। 

তবে শত বৈষ্যমের পরেও থেমে থাকেনি দুরন্ত আশাপূর্ণা। ছোটবয়স থেকেই তার ভাইদের সাথে খেলা করা, ঘুড়ি উড়ানো, ক্যারাম খেলা ছাড়াও মাটি ও কাঠ দিয়ে পুতুল বানাতেন। নিজের দুরন্তপনার কথা নিজেই উল্লেখ করে আশাপূর্ণা বলেছেন,

খেলার দাপটে, আইডিনের শিশি দু-চার দিনে খতম, হাত-পায়ের কোনাে স্থানে না কোনাে থানে ছেড়া ন্যাকড়ার ব্যান্ডেজ বাঁধাই আছে। চলতি নাম দস্যি! পাহাড়ে’ ডাকাত।

তবে যতই দস্যিপনা থাকুক, পড়াশোনার প্রতি আশাপূর্ণার ছিল তীব্র আগ্রহ। তবে মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়াটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো। আবারো ঠাকুরদমার কঠোর নিষেধ এবং পারিবারিক নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে পড়ে স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করা ছিল মানা। 

নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে এভাবেই রচনা করেছেন অমর সব সাহিত্যকর্ম। Image Source: exoticindiaart.com

ঠাকুরমার কড়া শাষণের কথা মনে করে আশাপূর্ণা বলেছিলেন, “ইস্কুলে পড়লেই যে মেয়েরা…বাঁচাল হয়ে উঠবে, এই তথ্য আর কেউ না জানুক আমাদের ঠাকুমা ভালোভাবেই জানতেন। এবং তার মাতৃভক্ত পুত্রদের পক্ষে ওই জানার বিরুদ্ধে কিছু করার শক্তি ছিল না।”  

তিনি কোনোদিন স্কুলেও যাননি। তবে তার মায়ের প্রয়াসে ঘরেই পড়াশোনা করতেন আশাপূর্ণা। তার বয়স যখন সাড়ে পাঁচ বছর, তখন তার বাবা আপার সার্কুলার রোডের (বর্তমান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোড) নিজস্ব বাসভবনে চলে আসেন। অল্প বয়স হলেও সেইসব স্মৃতি আশাপূর্ণার জীবন ও সাহিত্যে নানাভাবে ছাপ পড়েছিল। 

শিল্প-সাহিত্যে অনুরাগী বাবা-মা নানাভাবে ছেলেমেয়ের মনন বিকাশের চেষ্টা করতেন। তাই তো সাধনা, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, সবুজপত্র, বঙ্গদর্শন, বসুমতী, সাহিত্য, বালক, শিশুসাথী, সন্দেশসহ প্রায় ১৬-১৭টি নানা ধরনের পত্রিকা নানা সময়ে বাড়িতে আসতো, আর দৈনিক পত্রিকা তো ছিলই।

আশাপূর্ণার মা ছিলেন বিভিন্ন সাহিত্য পরিষদ এবং লাইব্রেরির সদস্য। এমনকি বাড়িতেও ছিল নানা ধরনের বইয়ের সম্ভার। এসবই আশাপূর্ণাকে পরিপূর্ণ সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। বই পড়ার আনন্দ সম্পর্কে তিনি বলেছেন,

হিসেব মতো আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে, সংসার ঊর্ধ্বের একটি স্বর্গীয় জগতে। বই পড়াই ছিল দৈনিক জীবনের আসল কাজ।

আশাপূর্ণা দেবীর তিনটি বিখ্যাত গ্রন্থ। Image Source: getbengal.com

লেখালেখিতে তার হাতেখড়ি হয় কবিতার মাধ্যমে। ১৯২২ সালে ‘বাইরের ডাক’ নামে একটি কবিতা শিশুসাথী পত্রিকায় পাঠানো এবং তা প্রকাশিত হওয়ায় বেশ আনন্দিতই হয়েছিলেন। সেবছরই তার ‘পাশাপাশি’ নামের একটি গল্পও পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তবে এরপর কয়েকটি বছর তেমন আর লেখেননি আশাপূর্ণা দেবী। 

তবে ‘পত্নী ও প্রেয়সী’ গল্পটি লেখার মাধ্যমে আবারো শুরু হলো সাহিত্য রচনা। এরপর তার পুরোটা জীবন সমান তালে লিখে গেছেন। ছোটদের জন্য লেখার পাশাপাশি ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় বড়াদের জন্য ছােটগল্পের সংকলন ‘জল আর আগুন’। তার লেখা প্রথম উপন্যাস ‘প্রেমও প্রয়োজন।’ 

তিনি বেশ অল্প বয়সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি লিখেছিলেন, আর একটি উত্তরের আবদারও করেছিলেন। রবীন্দনাথও হয়তো চিঠি পড়ে বুঝেছিলেন আশাপূর্ণার সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার কথা। তাইতো তিনি উত্তরে লিখে দিলেন,

আশাপূর্ণা, তুমি সম্পূর্ণা।

স্বামীর সঙ্গে আশাপূর্ণা দেবী। Image Source: Devi Prasad Singha/Anadabazar Potrika

সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসা নিয়েও সমান তালে সংসার চালিয়ে নেয়া সম্ভব, তাও প্রমাণ করেছিলেন তিনি। ১৯২৪ সালে, মাত্র ১৫ বছর ৮ মাস বয়সে কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা কালিদাস গুপ্তের সাথে বিয়ে হয় আশাপূর্ণা দেবী। তাদের ঘরে জন্ম নিয়েছিল দুই পুত্র আর এক কন্যা। 

সংসারের নানা ব্যস্ততার মাঝেও ভালো লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আশাপূর্না দেবী। এর ফলস্বরূপ লিখেছেন অসংখ্য নামকরা সাহিত্যকর্ম। পেয়েছেন বিভিন্ন সম্মানজনক পুরস্কার এবং উপাধি।   

প্রথম প্রতিশ্রুতি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদের প্রচ্ছদ, Image source: Wikipedia

‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’ এবং ‘বকুলকথা’ এই তিনটি উপন্যাস আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনার মর্যাদা পেয়েছে এবং তার সর্বাধিক পরিচতি উপন্যাস। 

এছাড়া, তার অন্যতম প্রধান এবং উল্লেখযোগ‍্য কয়েকটি ছোটগল্প হলো পাতাচাঁপা, সর্ষে ও ভূত, ডেইলি প‍্যাসেজ্ঞার, কামধেনু, শুনে পুন‍্যবান প্রভৃতি। তার লেখা কিছু অনুবাদগ্রন্থও বেশ জনপ্রিয়। 

এমনকি তার লেখা উপন্যাস এবং গল্পকে কেন্দ্র করে নির্মাণ হয়েছে ২৪টি চলচ্চিত্র। তার লেখার সরলতা মানুষের মন ছুঁয়ে যেতো, বিপর্যয় থেকে উঠে দাঁড়াবার অদম্য সাহস যোগাতো, নারীদের প্রয়াস দিতো সামনে এগিয়ে যাওয়ার। 

তাইতো তিনি বলেছেন, এতো আলো পৃথিবীতে, তবু পৃথিবীর মানুষগুলো এতো অন্ধকারে কেন?’ তার এই অসামান্য কৃতিত্তের জন্য তাকে মানুষ মনে রাখবে আজীবন।

সাহিত্য অবদানের জন্য আশাপূর্ণা দেবী ১৯৬৬ সালে রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার পান। এছাড়া, ভূষিত হোন পদ্মশ্রী (১৯৭৬), জ্ঞানপীঠ (১৯৭৭), মতিলাল ঘোষ পুরষ্কার (১৯৫১), কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ‘লীলাবতী পুরস্কার (১৯৫৪) ও ‘ভুবনমােহিনী স্বর্ণপদক’ (১৯৬৩) ইত্যাদি পুরস্কারে।  

আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্যকে স্বীকৃতি দিতে ১৯৮৮ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘হরনাথ ঘােষ পদক’, ১৯৮৯ সালে শরৎ সমিতি থেকে ‘শরৎ পুরস্কার’, বিশ্বভারতী থেকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিসহ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’-ও লাভ করেন। তাছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করেন। 

১৯৭৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সঞ্জীবা রেড্ডির কাছ থেকে জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার গ্রহণ করছে আশাপূর্ণা দেবী। Image Source: exoticartindia.com

সাহিত্যজগতে অমর এই সাহিত্যিক ১৯৯৫ সালের ১৩ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর দুয়েক মাস আগেও তিনি লিখে গেছেন অপার গতিতে। তবে কথাসাহিত্য আর সৃষ্টির মাধ্যমে আশাপূর্ণা দেবী বেঁচে আছেন তার অসংখ্য ভক্ত আর শুভানুধ্যায়ীর কাছে। কথাসাহিত্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন, 

কথা’ই তো ‘জীব’ জগৎ থেকে মানুষ জাতটাকে পৃথক করেছে, তাকে উত্তরণের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে, উন্মত্ত নিয়ে চলেছে। কথাই সভ্যতার বাহন, সংস্কৃতির বাহন। কথা আর তখন ‘কথা’ মাত্র না থেকে হয়ে উঠেছে ‘কথা শিল্প।’

 

 

Feature Image: 
References: 

01. আশাপূর্ণা দেবীর কিছু অসাধারণ উক্তি। 
02. সাহিত্যাকাশে নারী জ্যোতিষ্ক-আশাপূর্না দেবী। 
03. Ashapurna Devi Feminist Writer Bengali. 
04. Aashapurna Devi Brief Life Sketch. 
05. Ashapurna Devi.