এডওয়ার্ড স্নোডেন হলেন একজন প্রাক্তন গোয়েন্দা ঠিকাদার যিনি ২০১৩ সালে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির (NSA) বিশ্বব্যাপী নজরদারির পরিকল্পনা সম্পর্কে গোপন তথ্য ফাঁস করেছিলেন এবং এই কারণে তিনি আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
স্নোডেনের ফাঁস করা তথ্যগুলি সরকারী নজরদারি এবং গোপনীয়তা সম্পর্কে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যা তাকে আধুনিক ইতিহাসের একটি আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। এই বিতর্কিত এবং আলোচিত ব্যক্তিত্ব নিয়েই আজকের আলোচনা।
ব্যক্তিগত জীবন
স্নোডেন উত্তর ক্যারোলিনায় ১৯৮৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং একটি সামরিক পরিবারে তার বেড়ে ওঠা। বাবা ছিলেন কোস্ট গার্ড আর মা কাজ করতেন ফেডারেল কোর্ট সিস্টেমের জন্য। স্নোডেন ২০০৪ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়।
সেনাবাহিনীতে যোগদানের আগে কমিউনিটি কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন। সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে এক দুর্ঘটনায় তার পা ভেঙে যাওয়ার পর তাকে সেনাবাহিনী ছাড়তে হয়েছিল।
আর্মি ছাড়ার পর স্নোডেন সিআইএ-তে কারিগরি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি ডেল এবং বুজ অ্যালেন হ্যামিল্টনসহ বিভিন্ন রকম প্রাইভেট ইন্টেলিজেন্সের ঠিকাদারদের জন্য কাজ করতে যান।
এই সমস্ত প্রাইভেট এজেন্সি NSA এর হয়েও কাজ করতো। এনএসএ-তে থাকাকালীন, স্নোডেন এজেন্সির বিশ্বব্যাপী নজরদারি কর্মসূচি সম্পর্কে প্রচুর পরিমাণে তথ্যের মুখোমুখি হোন যা ছিল বহির্বিশ্বের কাছে গোপনীয়।
সরকারি নজদারির তথ্য ফাঁস করার ঘটনা
এডওয়ার্ড স্নোডেনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির (এনএসএ) নজরদারির গোপন তথ্য ফাঁস করার সিদ্ধান্ত ছিল সরকারি নজরদারি এবং জাতীয় নিরাপত্তার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। ২০১৩ সালে স্নোডেন NSA-এর একজন ঠিকাদার হিসাবে কাজ করছিলেন এবং এই সময়েই সাংবাদিকদের কাছে গোপন নথি ফাঁস করেছিলেন।
স্নোডেন যা প্রকাশ করেছিল তা হলো NSA দ্বারা লক্ষ লক্ষ আমেরিকানের টেলফোনে আড়ি পেতে সংগ্রহ করা হয় মেটাডাটা। স্নোডেনের প্রকাশ করা গোপন তথ্য এই ব্যাপারে আরো ধারণা দেয় যে, মার্কিন সরকার বিদেশী সরকার, নেতা এবং নাগরিকদের সম্মতি ছাড়া, তাদের অজান্তেই তাদের উপর নজরদারি চালাচ্ছিল।
স্নোডেনের এই তথ্য ফাঁস করার ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হয়নি। তার কাজের জন্য তাকে গুরুতর পরিণতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শত বাঁধা-বিপত্তি সত্ত্বেও স্নোডেন বিশ্বাস করতেন যে, জনগণের অধিকার রয়েছে সরকারের গোপন নজরদারির কর্মকান্ড সম্পর্কে জানা এবং জনগণের অধিকার রক্ষায় স্নোডেন এই তথ্যগুলো প্রকাশ করার দায়িত্ব নিজ হাতে নিয়ে নেয়।
দ্য গার্ডিয়ানের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে স্নোডেন বলেছেন,
আমি মার্কিন সরকারকে গোপনে তৈরি করা এই বিশাল নজরদারি মেশিনের মাধ্যমে সারবিশ্বের মানুষের গোপনীয়তা, ইন্টারনেট স্বাধীনতা এবং মৌলিক স্বাধীনতা নষ্ট করার অনুমতি দিতে পারি না।
স্নোডেনের প্রকাশ করা তথ্য সরকারী নজরদারি, গোপনীয়তা এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অনেকে তার সাহসিকতার জন্য তার প্রশংসা করেছেন এবং তাকে একজন বীর বলেছেন। তবে সমালোচনাও আছে ঢের। অনেকেই তাকে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলার জন্য এবং আইন ভঙ্গ করার জন্যও সমালোচনা করেছেন।
তার করা কাজকে ঘিরে বিতর্ক আছে সত্যি হলেও স্নোডেনের প্রকাশ করা তথ্য জনমত এবং সরকারী নীতিতে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। সরকারী নজরদারি কার্যক্রমের তদারকি বাড়ানো এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যেভাবে কাজ করে তা আরো স্বচ্ছতার দিকে পরিচালিত হয়েছে এই ঘটনার পরিণতিতে। যার ফলে জনগণ সরকারের এই কর্মসূচি সম্পর্কে কিছুটা হলেও অবহিত থাকে।
২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফেডারেল আপিল আদালত রায় দেয় যে, NSA-এর টেলিফোন মেটাডেটা সংগ্রহ করা অবৈধ ছিল এবং ২০১৮ সালে, কংগ্রেস বিদেশী গোয়েন্দা নজরদারি আইনের ধারা ৭০২ পুনঃঅনুমোদিত করার জন্য আইন পাস করে, যা বিদেশী সংস্থার উপর নজরদারির ব্যাপার পরিচালনা ও তদারকির কাজ করে।
স্নোডেনের এই তথ্য ফাঁস করার কারণে প্রযুক্তি নির্ভর কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের ডেটা সুরক্ষিত করার কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে। ফলে অ্যাপল, ফেসবুক এবং গুগলের মতো বড় কোম্পানিগুলো এনক্রিপশনের ব্যবহার বাড়িয়ে দেয়। স্নোডেনের কাজের ফলেই ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে এতটা সতর্ক হয় কোম্পানিগুলো।
আইনের চোখে স্নোডেনের বর্তমান অবস্থা
এডওয়ার্ড স্নোডেনের আইনি অবস্থা জটিল এবং বিতর্কিত। তার মধ্যে কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা যাক:
মার্কিন অভিযোগ: স্নোডেনের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি আইনের বেশ কিছু অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অনুমতি ছাড়াই গোপন তথ্য ফাঁস করা এবং সরকারি সম্পত্তি চুরি। যদি স্নোডেন এই দোষে দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে তার ৩০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
রাশিয়ায় নির্বাসন: ২০১৩ সালে গোপন তথ্য ফাঁস করার পরে, স্নোডেন হংকং এবং তারপরে রাশিয়ায় পালিয়ে যান। রাশিয়ায় তাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। তিনি ওই সময় থেকেই রাশিয়ায় রয়েছেন এবং ২০২০ সালে তার রাশিয়াতে অবস্থান করার সময়সীমা ২০২১ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।
আশ্রয় প্রত্যাখ্যান: স্নোডেন জার্মানি, ফ্রান্স এবং নরওয়েসহ আরও কয়েকটি দেশে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছে, কিন্তু তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এই দেশগুলোর পক্ষ থেকে। কিছু দেশ ইঙ্গিত দিয়েছে যে, স্নোডেন যদি তাদের দেশের মাটিতে উপস্থিত হয় তাহলে তারা আবেদন বিবেচনা করতে রাজি। কিন্তু স্নোডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ধরা পড়বে এই ঝুঁকি নিতে নারাজ।
ক্ষমার জন্য আহ্বান: স্নোডেনের ক্ষমাপ্রার্থনা করে সমর্থকরা সরকারের কাছে আহ্বান জানায়। ক্ষমাপ্রার্থনার যুক্তি এই যে, স্নোডেনের কাজগুলো ছিল জনস্বার্থে এবং সরকারের অন্যায় কাজ প্রকাশ করে দেওয়ার জন্য শাস্তি দেওয়াটা নৈতিক নয়। এত জোরালো আবেদনের পরেও মার্কিন সরকার স্নোডেনকে ক্ষমা না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে।
স্নোডেন আইনি অচলাবস্থার মধ্যে রয়ে গেছে। বিচারের মুখোমুখি না হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে দেওয়া হবে না তাকে এবং অন্য দেশে স্থায়ী আশ্রয় খুঁজে পাওয়ার রাস্তাও বন্ধ।
স্নোডেনকে নিয়ে মতামত
স্নোডেন সম্পর্কে করা মন্তব্যে পক্ষ এবং বিপক্ষ দুই ধরনের মানুষেরই দেখা পাওয়া যায়। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ২০১৬ সালে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, স্নোডেনের পদক্ষেপগুলি জাতীয় নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং আমেরিকানদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
এছাড়াও, তিনি স্বীকার করেছেন যে, স্নোডেনের কারণে গোপনীয়তা এবং সরকারী নজরদারি সম্পর্কে একটি কথোপকথনের জন্ম নিয়েছে যার গুরুত্ব অনেক বেশি।
সেক্রেটারি অফ স্টেট হিলারি ক্লিনটন ২০১৪ সালে মন্তব্য করেছিলেন যে, স্নোডেনের উচিত ছিল আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে গোপন নজরদারির ঘটনা সামলানো। তার মতে, এই গোপন তথ্য সন্ত্রাসীদের সহায়তা করতে পারে। গ্রীনওয়াল্ড হচ্ছেন সেই সাংবাদিকদের মধ্যে একজন যিনি স্নোডেনের সাথে কাজ করেছিলেন গোপন তথ্য ফাঁস করার ঘটনায়।
তিনি স্নোডেনের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন এবং এই ব্যাপারে যুক্তিও দেখিয়েছেন যে, সরকারের বাড়াবাড়ি উন্মোচন এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ক্ষতি করার সরকারি উদ্যোগকে থামানোর জন্য স্নোডেনের অবদান প্রশংসনীয়। সামগ্রিকভাবে, এডওয়ার্ড স্নোডেন সম্পর্কে মতামতগুলি দুইটি ভিন্ন মেরু তৈরি করে দেয়।
এর কারণ কেউ কেউ তাকে নায়ক হিসাবে দেখেন এবং অন্যরা তাকে স্রেফ অপরাধি হিসাবে দেখেন। তবে স্নোডেনের পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক আগামী বহু বছর ধরে চলতে পারে এই কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
Feature Image: npr.org References: 01. About Edward Snowden. 02. Mass Surveillance. 03. Russian Asylum Granted. 04. Politicians Who Supported Snowden. 05. Opinion on Edward Snowden.