প্রাচীন বিশ্বের এক বিষ্ময় নগরীর নাম দামেস্ক। আফ্রিকা, এশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমের সংযোগ স্থলে অবস্থিত এই প্রাচীন শহরটিকে ঘিরে রয়েছে নানা ইতিহাস ও কিংবদন্তি। খিস্ট্রপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দে নির্মিত এই দামেস্ক শহর, নিজের সূচনালগ্ন থেকেই বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল।
সরু রাস্তা, মোজাইক করা প্রাচীন ভবন এবং জমজমাট বাজারের জন্য এই শহরটি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র। সহস্রাব্দী বিস্তৃত ইতিহাসের সাথে সর্বদা বিদ্যমান আভিজাত্য, দামেস্ক শহরটিতে এক বিচিত্র অনুভূতির জন্ম দেয়। যা শতাব্দী থেকে শতাব্দী কবি সাহিত্যিকদের বিমোহিত করে আসছে।
নগর পরিচিতি
দামেস্ক শহরটি বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ার রাজধানী। এটি দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, দামেস্ক বিশ্বের প্রাচীনতম অবিচ্ছিন্ন জনবসতির শহর। অর্থাৎ, একটানা সর্বাধিক সময় ধরে এই শহরটিতে মানবজাতি বসবাস করে আসছে। এছাড়াও, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী রাজধানী শহর হিসাবেও দামেস্ককে ধরা হয়।
এই শহরের বাসিন্দারা মূলত আরবি ভাষায় কথা বলে থাকেন। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই শহরটির আয়তন ১০৫ বর্গকিলোমিটার যার মধ্যে ৭৭ বর্গকিলোমিটার শহুরে অঞ্চল এবং বাকি ২৮ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জাবাল কাসিউন নামক পর্বতটির দখলে। অপরদিকে শহরের জনসংখ্যা প্রায় ২৫লক্ষ। পুরাতন দামেস্ক শহরটি বারাদা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত এবং প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য
পুরাতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে প্রমাণিত যে, এই অঞ্চলে ৮ থেকে ১০ হাজার খিষ্ট্রপূর্বাব্দেও জনবসতি ছিল। তবে আরামিয়ানদের আগমণের আগ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে দামেস্কের নাম ইতিহাসের কোথাও নথিভুক্ত ছিল না। মধ্যযুগে শহরটি ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতি এবং বিশেষত কারুশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল।
বিভিন্ন সাম্রাজ্য এবং রাজবংশ দ্বারা দামেস্ক বহুবার বিজিত ও শাসিত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- অ্যাসিরিয়ান, ব্যাবিলনীয়, পার্সিয়ান, গ্রিক, রোমান এবং আরবরা অন্যতম। প্রতিটি বিজয়ী তার অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং স্থাপত্যে অবদান রেখে শহরে তার চিহ্ন রেখে গেছেন।
তাই, এই শহরটিতে বিভিন্ন সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়। উমাইয়া খেলাফতের সময় ‘দামেস্ক‘ সর্বপ্রথম রাজধানী শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে দামেস্ক তার সমৃদ্ধির চূড়ায় পৌছাতে থাকে।
জুঁই ফুলের শহর
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক, ‘সিটি অফ জেসমিন’ বা ‘জুঁই ফুলের শহর’ নামে সারাবিশ্বে খ্যাত। শহরটি আশেপাশে জন্মানো জুঁই ফুলের প্রাচুর্যের কারণে বিশ্বব্যাপি শহরটির এমন খ্যাতি। শহরের ইতিহাসেও ফুলটির একটি উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে।
জুঁই ফুলের এই সুগন্ধটিকে শহরের চেতনার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, ফরাসি লেখক এবং কবি, আন্দ্রে গিড, দামেস্কতে এসেছিলেন। সেই সময় শহর জুড়ে জুঁই ফুলের প্রাচুর্য দেখে তিনি অবাক হন।
পরে তিনি তাঁর একটি বইতে শহরের সংস্কৃতিতে ফুলটির ভূমিকা সম্পর্কে লিখেছিলেন। তাঁর লেখনির জোরে ‘সিটি অফ জেসমিন’ এই নামটি সারা বিশ্বের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সৌন্দর্য বর্ধন ছাড়াও সুগন্ধি তৈরিতে কয়েক শতাব্দী ধরে দামেস্কেতে জুঁই ফুলের চাষ করা হয়ে আসছে। জুঁই তেল ঐতিহ্যগতভাবে মধ্যপ্রাচ্যের সুগন্ধি তৈরির অন্যতম মূল্যবান উপাদান। অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছাড়াও, জুঁই দামেস্কের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ফুলটি প্রেম, সৌন্দর্য এবং বিশুদ্ধতার প্রতীক। এটি শহরের ইতিহাস জুড়ে কবিতা, সাহিত্য এবং শিল্পে ব্যবহৃত হয়েছে। জুঁই ইসলামি সংস্কৃতিতেও একটি উল্লেখযোগ্য প্রতীক, যা জীবনের ভঙ্গুরতা এবং সৌন্দর্য উভয়েরই প্রতিনিধিত্ব করে।
দামেস্ক গ্রেট মসজিদ
১১৮৪ খিস্ট্রাব্দে, বিখ্যাত আন্দালুসিয়ান (স্প্যানিস) পর্যটক, ভূগোলবিদ এবং কবি আবুল হুসেন মুহাম্মদ ইবনে আহম্দ ইবনে জুবায়ের দামেস্ক সফর করেন। শহরে প্রবেশ করার পর তিনি বলেছিলেন, ’স্বর্গ যদি পৃথিবীতে থাকে তবে তা নিঃস্বন্দেহে দামেস্কের মধ্যেই রয়েছে’। সৌদি আরব থেকে যাত্রা শুরু করে ক্রমান্বয়ে মিশর, লেভান্ট অঞ্চল, ইটালি এবং অন্যান্য দেশ ঘুরে তিনি দামেস্কেতে আসেন।
অপরিচিত এই নগরে এসে তিনি উমাইয়া মসজিদ যা ‘দামেস্ক গ্রেট মসজিদ’ নামে পরিচিত সেটির নিকটে ‘দার আল-হাদিস’ নামক এক স্থানে এক মাস অবস্থান করেন। সেখানে অবস্থান করার সময় এই মসজিদের সৌন্দর্য তাঁকে অভিভূত করেছিল। দামেস্ক গ্রেট মসজিদটিকে ইসলামে চতুর্থ পবিত্রতম স্থান হিসেবে গণ্য করা হয়।
৭১৫ খিষ্টাব্দে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। ৬ষ্ঠ উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদ মসজিদটি নির্মাণ করেন। এই মসজিদটি এমন একটি স্থানে নির্মিত যেখানে কয়েক সহস্রাব্দ ধরে উপাসনার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিংবদন্তি অনুসারে, সর্বপ্রথম এই স্থানে আরামিয়ানরা এবং পরে রোমানরা মন্দির নির্মাণ করেছিল।
মধ্যযুগে সিরিয়া যখন খিস্ট্রধর্মাবলম্বী বাইজেন্টাইন শাসনের অধীনে চলে যায় তখন তারা মন্দিরটিকে গীর্জা রুপান্তরিত করে। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে দামেস্ক, প্রথম বাইজেন্টাইন শহর হিসেবে ইসলামের পতাকা তলে আসে। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রঃ) এবং তার সেনাপতি আবু উবাইদাহ এবং খালিদ ইবন-আল ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুসলমানরা নগরটি জয় করে।
এরপর ৭০৬খিস্ট্রাব্দে ৬ষ্ঠ উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদ মসজিদটি নির্মাণকাজ শুরু করেন। যখন খলিফা নতুন মসজিদ নির্মাণ শুরু করেছিলেন, পুরানো গীর্জাটিতে শহরের খ্রিস্টান এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা-আলাদা প্রার্থনার স্থান বরাদ্দ ছিল।
মদিনা, মক্কা এবং কুফায় বিদ্যমান মসজিদগুলি ছিল ছোট, এবং খলিফা আল-ওয়ালিদের মনের মতো উচ্চাভিলাষী ছিল না। তিনি এমন কিছু নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন যা দুনিয়াতে জান্নাতের স্বাদ দিতে পারে। এজন্য মসজিদটির নকশা পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বানানো হয়েছে। যেখানে জান্নাতের উচ্চ কক্ষ এবং তলদেশে প্রবাহিত নদীর বর্ণনা রয়েছে।
দামেস্কের ক্যাফে সংস্কৃতি
জুঁই ফুলের নগর দামেস্ক তার ক্যাফে সংস্কৃতির জন্য সারাবিশ্বে জনপ্রিয়। বহু বছর ঘরে এই ক্যাফেগুলো ঐতিহ্যবাহী তুর্কি কফি, চা এবং আরগিলেহ (হুক্কা) পরিবেশন করে আসছে। অতীতে, এই ক্যাফেগুলি বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক একটি মিলনস্থল ছিল।
ঐতিহাসিক সূত্রগুলি থেকে জানা যায়, ঊনবিংশ শতকের শেষ ২৫ বছরে দামেস্কেতে ক্যাফেগুলির সংখ্যা ১১০ থেকে ১২০ এর মধ্যে ছিল। সেই সময় ভিন্ন পেশার মানুষদের জন্য ভিন্ন ক্যাফে বরাদ্দ থাকতো। যেমনঃ ব্যবসায়ী, সওদাগর, রাজকর্মচারী, সৈনিক,লেখক এবং চিত্রশিল্পীসহ প্রত্যেক পেশার মানুষের জন্য ভিন্ন-ভিন্ন ক্যাফে বরাদ্দ থাকতো।
ক্যাফেগুলি তখন রাজপথের শোভা বর্ধন করতো। সবচেয়ে বিখ্যাত ক্যাফেগুলি ছিল বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, লেখক এবং রাজনীতিবিদদের জন্য বরাদ্দ। এক সময়, এই ক্যাফেগুলি বুদ্ধিজীবী এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করতো। অপরদিকে, দামেস্কের ক্যাফেগুলি আজ কেবল তরুণদেরই মদ্যপানে আকৃষ্ট করে।
সেখানে এখন থাকেনা কোনো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা শিল্পের আলাপ। এজন্য দেশের প্রগতিতে বর্তমানে কোনো ভূমিকাই রাখেনা এই ক্যাফেগুলি। তবে, দামেস্কের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু ঐতিহ্যবাহী ক্যাফেগুলো এখনো শহরের শোভা বর্ধন করে যাচ্ছে।
পৃথিবীর সেরা ইস্পাত পণ্যের সূতিকাগার
ঐতিহাসিক কাল থেকেই দামেস্ক পৃথিবীকে সেরা ইস্পাতের পণ্য উপহার দিয়ে আসছে। দামেস্ক ইস্পাতের একটি সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্য আছে। এই ইস্পাতের ব্যতিক্রমী গুণমান ও অনন্য প্যাটার্নের জন্য দামেস্কের ইস্পাতের অস্ত্রের জনপ্রিয়তা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে ছিল। দামেস্কের ইস্পাতের সম্পর্কে ইতিহাসের পাতায় নির্ভরযোগ্য কোনো নথি খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবে, ধারণা করা হয়, সর্বপ্রথম প্রথম ভারতবর্ষে এই উন্নত মানের ইস্পাতের উৎপাদন শুরু হয়েছিল। ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি, মধ্যপ্রাচ্যে এবং বিশেষ করে দামেস্কে এই ইস্পাত উৎপাদনের কৌশল পরিমার্জিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
ইস্পাতটি তার শক্তি, নমনীয়তা এবং একটি ধারালো প্রান্ত ধরে রাখার ক্ষমতার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান ছিল, যা এটিকে তরোয়াল এবং ছুরির মতো অস্ত্রের জন্য আদর্শ করে তুলেছিল।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এবং তার দামেস্কের ইস্পাতের তলোয়ার ব্যবহার সম্পর্কে অনেক গল্প এবং কিংবদন্তি রয়েছে। এরকম একটি গল্প হলো, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে ৩৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইসুসের যুদ্ধের পর পারস্য রাজা তৃতীয় দারিয়ুস দামেস্কতে তৈরি একটি ইস্পাতের তলোয়ার উপহার দিয়েছিলেন। তলোয়ারটি এতটাই ধারালো এবং শক্তিশালী ছিল যে, আলেকজান্ডার এটি দিয়ে একটা বড় পাথরকে ভেঙ্গে দুই টুকরো করে ফেলেন।
গৃহযুদ্ধে বিধস্ত দামেস্ক
এক সময় দুর্দান্ত প্রতাপের সাথে বিশ্বকে শাসন করা দামেস্ক এখন গৃহযুদ্ধের কারণে বিধস্ত। গৃহযুদ্ধের প্রাদুর্ভাবের আগে, দামেস্ক একটি প্রাণবন্ত শহর ছিল। যেখানে, একটি মননশীল সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং একটি শক্তিশালী অর্থনীতি ছিল। ২০০০ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল-আসাদের উত্তরসূরি হিসেবে ক্ষমতায় আসেন তাঁরই পুত্র বাশার আল-আসাদ।
প্রেসিডেন্ট আসাদের আমলের শুরু থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের তরঙ্গ একের পর চলতেই থাকে। তবে ২০১১ সালের মার্চ মাসে সংঘাত চরম পর্যায়ে পৌঁছায়ে এবং তা গৃহযুদ্ধের রূপ নেয়। যার ফলে দেশটির রাজধানী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই চলমান সংঘাত ঐতিহ্যবাহী এই নগরের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করেছে।
এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, দামেস্কের জনগণ শহরের ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনঃনির্মাণ ও পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা চলছে। যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি আগামী বহু বছর ধরে বহন করে বেড়াতে হবে জুঁই ফলের শহর দামেস্ককে।
দামেস্ক নগরী নিজেই একটি জীবন্ত ইতিহাস, যা ১০ হাজার বছরেরও বেশি পুরানো। যার অতীত জুড়ে রয়েছে সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। যদিও বিগত কয়েক বছর ধরে শহরটি অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তবুও, এই বিস্ময় নগরীটি সিরিয়ার জনগণের জন্য এখনো আশার প্রতীক হিসেবে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে।
Feature Image: istockphoto.com References: 01. Damascus. 02. Ancient City of Damascus. 03. Ancient City of Damascus.