পোলার বিয়ার বা মেরু ভাল্লুক বিশ্বের বৃহত্তম প্রজাতির ভাল্লুক। যেটা কিনা আর্কটিকের শীর্ষ শিকারী, আর্কটিকের শক্তি এবং সহনশীলতার একটি প্রতীক। এর ল্যাটিন নাম ‘উরসাস মারিটিমাস’ যার অর্থ ‘সমুদ্র ভাল্লুক’। এই প্রজাতির জন্য এটি একটি উপযুক্ত নাম কারণ জীবনের বেশিরভাগ সময় এরা সমুদ্রে কাটায়-বিশেষ করে বরফের সমুদ্রে।
অতীত ইতিহাস
মেরু ভাল্লুকের জেনেটিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ১১১ থেকে ১৬৬ হাজার বছর আগে সম্ভবত আয়ারল্যান্ড থেকে বাদামী ভাল্লুকের একটি দল তাদের স্বজাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ভূতাত্ত্বিক সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তারা আর্কটিকের ঠান্ডার সাথে খাপ খাইয়ে নেয় এবং মেরু শ্বেত ভাল্লুক হয়ে ওঠে। প্রাচীন একটি মেরু ভাল্লুকের পাওয়া হাড় পরীক্ষা করে দেখা যায় এর বয়স ১১০ থেকে ১৩০ হাজার বছরের মধ্যে।
আধুনিক যুগে কনস্টানটাইন জন ফিপস সর্বপ্রথম ১৭৭৪ সালে উত্তর মেরুতে তার অভিযান সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মেরু ভাল্লুককে পৃথিবীর সাথে পরিচিত করান। তিনি এই প্রানিটিকে একটি স্বতন্ত্র প্রজাতি হিসেবে বর্ণনা করেন। তখন তিনিই এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘Ursus maritimus’ নির্বাচন করেন।
মেরু ভাল্লুক দেখতে কেমন?
- উচ্চতা ও ওজন
স্থলের সবচেয়ে বৃহত্তম মাংসাশী ও স্তন্যপায়ী প্রাণি হলো মেরু ভাল্লুক। পুরুষ ও স্ত্রী মেরু ভাল্লুকের মধ্যে আকার ও গঠনে পার্থক্য রয়েছে। একটি পুরুষ মেরু ভাল্লুক, স্ত্রী মেরু ভাল্লুক থেকে আকারে দুই তিনগুণ বড় হয়ে থাকে। পুরুষ মেরু ভাল্লুকের ওজন প্রায় ৩৫০ থেকে ৬৫০ কেজি হয়ে থাকে। এরা প্রায় ৮ থেকে ৯.৮ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।
আর স্ত্রী ভাল্লুকের ওজন প্রায় ১৫৯ থেকে ২৫০ কেজি এবং প্রায় ৬ থেকে ৮ ফুট লম্বা হয়। তবে সন্তানসম্ভবা মেরু ভাল্লুকের ওজন ৫০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
- অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ
মেরু ভাল্লুকের পেছনের অঙ্গগুলি সামনের অঙ্গগুলির চেয়ে দীর্ঘ হয়। এরা এদের পেশীবহুল পেছনের প্রান্তটি কাঁধের চেয়ে উঁচু করে তুলতে পারে। একটি মেরু ভাল্লুকের মাথা আয়তাকার এবং শরীরের আকারের তুলনায় ছোট। এদের চোখ গাঢ় বাদামী। নাক চওড়া ও কালো। আর ৪২টি দাঁত আছে, যেগুলো তারা খাবার ধরতে এবং আক্রমণের জন্য ব্যবহার করে। তবে অন্যান্য প্রজাতির ভাল্লুকের তুলনায় কান ছোট।
এদের দেহের আকারের তুলনায় পাঞ্জা বা থাবা বড় থাকে, প্রায় ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত ব্যাসের। ২.৮ থেকে ৪.৭ ইঞ্চি লম্বা একটি ছোট লেজ আছে। প্রতিটি পায়ের আঙ্গুলে পুরু, বাঁকা নখ রয়েছে। নাক এবং পায়ের পাতা ব্যতীত সম্পূর্ণ শরীর লোমে আবৃত। এই লোম ১-২ ইঞ্চি পুরু হয়।
- অন্যান্য শারীরিক বৈশিষ্ট্য
মেরু ভাল্লুক চাবানোর চেয়ে বেশির ভাগ খাবার বড় খণ্ডে গিলে ফেলে। নখগুলিকে শিকার ধরা এবং বরফের উপর দৌড়ানোর সময় বরফ আঁকড়ে ধরতে ব্যবহার করে। এদের পায়ের তলা পুরু, নরম ও অমসৃণ মাংস দিয়ে আবৃত থাকে। বরফের উপর দিয়ে চলাচলের সময় এটি পিছলে যাওয়া রোধ করে। এছাড়া, পায়ের আঙ্গুলের মধ্যে বেড়ে ওঠা লম্বা চুলও ভাল্লুককে পিছলে যাওয়া রোধ করতে সাহায্য করে।
এদের কান শরীরের তাপ সংরক্ষণ করতে সক্ষম করে। পাঞ্জা বা থাবা দিয়ে এরা বরফের মধ্যে জুতোর কাজ করে। লোমগুলো তৈলাক্ত এবং পানিরোধী। মে বা জুন মাসে মেরু ভাল্লুক সম্পূর্ণরূপে তাদের পশম প্রতিস্থাপন করে, অনেকটা সাপের খোলস পাল্টানোর মতো। এদের এই অবস্থা কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে। ঋতু এবং আলোর কোণের উপর নির্ভর করে এদের পশমের রঙ শুভ্র সাদা থেকে হলুদ বা হালকা বাদামী বর্ণের হতে পারে।
মেরু ভাল্লুকের চামড়া, নাক এবং পায়ের নিচের পাঞ্জা কালো রঙের হয়। এই কালো রঙ ভাল্লুককে তার শরীর উষ্ণ করতে, সূর্যালোক থেকে শক্তি শোষণ করতে সক্ষম করে তোলে।
খাদ্য
মেরু ভাল্লুক আর্কটিকের ঠাণ্ডা পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য সীল, সামুদ্রিক প্রাণির মৃতদেহ এবং বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণি খেয়ে থাকে। এছাড়াও, বেলুগা তিমি, বলগা হরিণ, ছোট ইঁদুর, ঝিনুক, মাছ, মানুষের আবর্জনাও খেয়ে থাকে। এরা প্রধানত মাংসাশী তবে খাদ্য সরবরাহ কম হলে বেরি এবং সামুদ্রিক শৈবালও খায়।
রিংযুক্ত এবং গোফওয়ালা সীল এদের প্রধান খাবার। কিন্তু এটা না থাকলে অন্য জাতের সীলও খায়। সীল একটি উচ্চ শক্তিসম্পন্ন খাদ্য উৎস। এই কারণে ১২০ পাউন্ড বা তার বেশি ওজনের সীল খেয়ে মেরু ভাল্লুক ৮ দিনের মতো না খেয়ে শক্তি সরবরাহ করতে পারে।
আবাসস্থল
বেশিরভাগ মেরু ভাল্লুক আর্কটিক অঞ্চলে বাস করে। বিশেষ করে আর্কটিক অঞ্চলের উত্তর মেরুতে বাস করে। তবে কানাডার হাডসন বে, জেমস বে, আলাস্কা, রাশিয়া, গ্রিনল্যান্ড, সাইবেরিয়া, আর্কটিক অঞ্চলের দক্ষিণেও তাদের দেখা যায়। এছাড়া নরওয়ের মালিকানাধীন উত্তর দ্বীপ স্বালবার্ডেও এদের বসবাস রয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের (WWF) রিপোর্ট অনুযায়ী মেরু ভাল্লুকের মোট সংখ্যার ৬০% কানাডায় বাস করে। পৃথিবীর এসব জায়গায় মেরু ভাল্লুক থাকার মূল কারণ সমুদ্রের বরফে এদের প্রিয় খাবার সীল পাওয়া যায়। তবে গ্রীষ্মকালে সমুদ্রে বরফ না থাকলে স্থলভাগেও মেরু ভাল্লুককে বাস করতে দেখা যায়।
প্রজনন প্রক্রিয়া ও আয়ুষ্কাল
স্ত্রী ও পুরুষ মেরু ভাল্লুক সাধারণত বসন্তের সময়ে যৌনমিলন করে। স্ত্রী ভাল্লুক গর্ভবতী হলে ১৯৫-২৬৫ দিন পর প্রসব করে। এরা একবারে এক থেকে চারটি বাচ্চা জন্ম দিতে পারে। শীতকালে বরফ বা তুষারের গর্তে বাচ্চা জন্ম নেয়। জন্মের সময় বাচ্চাদের ওজন ১ কেজির কম হয় এবং দুই বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত দুধ পান করে।
যৌন পরিপক্কতা অর্জন করার আগে পর্যন্ত বাচ্চা ভাল্লুক তাদের মায়ের সাথে থাকে। স্ত্রী ভাল্লুক প্রথমে চার থেকে আট বছর বয়সে প্রজনন করে এবং তারপরে প্রতি দুই থেকে চার বছর পর বংশবৃদ্ধি করে। পুরুষ ভাল্লুকও স্ত্রী ভাল্লুকের মতো প্রায় একই বয়সে যৌন পরিপক্কতা লাভ করে। কিন্তু এরা বংশবৃদ্ধি করতে আরও কিছু সময় নেয়।
প্রাপ্তবয়স্ক মেরু ভাল্লুকের ওয়ালরাস এবং নেকড়ে ছাড়া তেমন কোন শত্রু বা শিকারী নেই। একটি মেরু ভাল্লুক বন্য অঞ্চলে ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচে, তবে বন্দী অবস্থায় ৩৫ বছরেরও বেশি বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
বর্তমানে সংখ্যায়
সারাবিশ্বে মেরু ভাল্লুকের সংখ্যা ২০,০০০ থেকে ৩১,০০০ পর্যন্ত অনুমান করা হয়। পুরুষ ও স্ত্রী ভাল্লুকের অনুপাত প্রায় ১:১। ১৯৭২ সালে মেরু ভাল্লুকের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫,০০০ থেকে ২০,০০০। সেই হিসেবে এদের সংখ্যা বর্তমানে তেমন বৃদ্ধি পায়নি। তবে বর্তমানে অধিক হারে সামুদ্রিক বরফের আবাসস্থল হারানোর কারণে কিছু মেরু ভাল্লুকের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
মেরু ভাল্লুক কি বিপন্ন?
মেরু ভালুক কি বিপন্ন? এখনো না। কিন্তু তারা বিলুপ্তির সর্বোচ্চ ঝুঁকির সম্মুখীন। ন্যাচার ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, মেরু ভাল্লুকের সংখ্যা ২১০০ সাল নাগাদ হ্রাস পাবে এমনকি অদৃশ্যও হয়ে যেতে পারে৷ এর প্রধান কারণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (WWF) অনুসারে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে আর্কটিক সাগরের বরফ গলে যাচ্ছে। তাই প্রতি দশকে ১৪% হারে মেরু ভাল্লুক ক্রমাগতভাবে তাদের আবাস হারাচ্ছে। এছাড়াও, যখন বরফ গলে যায় তখন মেরু ভাল্লুকের আবাসস্থলই শুধু হারিয়ে যায় না এরাও বাস্তুচ্যুত বা মূল জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে।
কারণ যখন আবাসস্থল হারিয়ে যায় তখন এরা নতুন বাসস্থান খুঁজতে বাধ্য হয়। ফলে এরা উপকূলীয় এলাকাগুলোতে প্রবেশ করে এবং সেখানকার বাসিন্দাদের সাথে সংঘাতের ঝুঁকিতে পড়ে।
পর্যটন, শিল্পায়ন, জাহাজ থেকে বর্জ্য ফেলা ইত্যাদি দূষণ মেরু ভাল্লুকের সংখ্যা হ্রাসের একটি কারণ। আর্কটিক অঞ্চলে তেল ও গ্যাস ড্রিলিং বিভিন্ন উপায়ে মেরু ভাল্লুকের ক্ষতি করছে। এরকম দূষণে সমুদ্রের অনেক প্রাণি যেমন সীল ও অন্যান্য মাছ মারা যাচ্ছে। এতে করে মেরু ভাল্লুক খাদ্য সংকটে পড়ছে। যা খাদ্য শৃঙ্খলকে ব্যহত করে।
এভাবে মেরু ভাল্লুকের খাবারের সংগ্রহ কমে যাওয়ায় স্ত্রী মেরু ভাল্লুকের ওজন কমছে, প্রজনন হার কমছে, বাচ্চা ভাল্লুকেরও বেঁচে থাকার হার কমছে। আর এভাবেই মেরু ভাল্লুকের নাম বিপন্ন প্রাণির তালিকায় উঠে এসেছে।
মেরু ভাল্লুক সামুদ্রিক খাদ্য শৃঙ্খলের শীর্ষে রয়েছে। এজন্য সামুদ্রিক পরিবেশের উপর এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে মেরু ভাল্লুক আর্কটিক জনগণের সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশও বটে।
তাই, মেরু ভাল্লুকের বিলুপ্তি রক্ষার্থে প্রথমেই এদের আবাসস্থল রক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। আর্কটিক ও অন্যান্য বরফাচ্ছাদিত এলাকার বরফ যেন আর না গলে সেজন্য সবার এগিয়ে আসতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই মেরু ভাল্লুক রক্ষা পাবে।
Feature Image: References: 01. Polar Bear. 02. Polar Bear. 03. Polar Bear.