হেরাক্লিয়ন: সাগরতলে হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন শহর

344
0

মিশরের ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যঘেরা পৌরাণিক শহর হচ্ছে হেরাক্লিয়ন। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের বর্ণনায় এই শহর সম্পর্কে প্রথম ধারণা পাওয়া যায়। প্রাচীন মিশরের হারিয়ে যাওয়া শহর হেরাক্লিয়ন এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় নিমজ্জিত আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি। 

হাজার হাজার বছর ধরে এই শহর পানির নিচে নিমজ্জিত ছিল। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জানা যায়, এর অস্তিত্ব শুধুমাত্র কয়েকটি বিরল শিলালিপি এবং প্রাচীন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিল এই প্রাণচঞ্চল শহরটি? পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া এই শহর নিয়েই আজকের আয়োজন। 

ইতিহাস

হেরাক্লিয়ন শহরটি নীল নদীর ক্যানোপিক অংশে চার শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে রাজত্ব করেছিল। সিসিলির গ্রিক ঐতিহাসিক ডিওডোরাস, ৬০-৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে থনিস-হেরাক্লিয়ন সম্পর্কে বিবলিওথেকা হিস্টোরিকাতে লিখেছেন। যেটি তার অন্যতম বিখ্যাত একটি গ্রন্থ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে হেরোডোটাস লিখেছিলেন যে, গ্রিক দেবতা এবং নায়ক হেরাক্লিস আসলে এই বন্দর নগরীতে মিশরে প্রথম পা রেখেছিলেন।

এইভাবে, গ্রিকরা থনিসকে হেরাক্লিয়ন নাম দিয়েছিল এবং এই অঞ্চলকে উৎসর্গ করে একটি বিশাল মন্দির তৈরি করেছিল। হেরোডোটাসের কাছ থেকে আরো জানা যায়, প্যারিস এবং হেলেন অফ ট্রয় এই বন্দর শহর পরিদর্শন করেছিলেন। প্রাচীন গ্রিক ঐতিহাসিকদের দ্বারা কিছু জায়গায় এটি উল্লেখ করা হয়েছিল এবং বিশেষ করে ফারাওদের শেষ দিনে এর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।

হেরাক্লিয়নের অবস্থান; Image Source: hiddenincatours.com

খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে মিশরীয় শহর হেরাক্লিয়ন ছিল ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের প্রধান বন্দর। এটি থনিস নামেও পরিচিত ছিল। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ৩২ কিলোমিটার বা ২০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে এই শহরের অবস্থান।

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে একটি মারাত্মক বন্যা হয়। এই ঘটনার কারণ হলো ভূমিকম্প এবং সমুদ্রের স্তরের উচ্চতার পরিবর্তন। তখন হেরাক্লিয়নের কেন্দ্রীয় দ্বীপটি যে জমিতে নির্মিত হয়েছিল তার মাটি ডুবে যায়। কঠিন কাদামাটি দ্রুত তরলে পরিণত হয় এবং ভবনগুলি পানিতে ধ্বসে পড়ে। রোমান যুগে এবং আরব বিজয়ের শুরুতে অল্প সংখ্যক বাসিন্দা রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে, থনিসের যা অবশিষ্ট ছিল তা পানির নিচে তলিয়ে যায়।

হারিয়ে যাওয়া শহর আটলান্টিসের মতোই এটাও হয়তো কোনো এক রূপকথার শহর, যার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে বিখ্যাত গ্রিক ইতিহাসবিদ হোরাডোটাস, ডায়োডোরাসসহ আরো কয়েকজন ইতিহাসবিদ তাদের লেখায় এই শহরের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এই শহরের ধ্বংসাবশেষ ২১ শতক পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে ছিল বলে ধারণা করা হয়।  

যেভাবে পাওয়া গেল সন্ধান 

২০০০ সালে, বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্রাঙ্ক গোডিওর নেতৃত্বে ইউরোপীয় ইন্সটিটিউট অফ মেরিটাইম আর্কিওলজি অবশেষে আবু কির উপসাগরের গভীরে শহরটি আবিষ্কার করে। মূলত তিনি এবং তার দল ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের একটি যুদ্ধ জাহাজের খোঁজ করতেই সেখানে গিয়েছিলেন। 

সমুদ্রের তলদেশে প্রায় ১,২০০ বছরের জমে থাকা বালি ও তলানি সরিয়ে তিনি এক অমূল্য গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছিলেন। মিশরীয় দেবতা হাপির মূর্তির কিছু অংশ, যা মিশরীয় বন্দরনগরী থনিস বা হেরাক্লিয়নের অংশ, এগুলো শুরতেই নজরে আসে। ডুবে যাওয়া শহরটি সমুদ্রের তীর থেকে ৬.৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। 

দেবতা হাপির মূর্তি উদ্ধার করা হচ্ছে ; Image Source: dsx.weather.com

এছাড়াও, মিশরীয় দেবতা আমন ও তার ছেলে খনসৌর মন্দিরের কিছু অংশ, ২০০ এর বেশি বিভিন্ন ধরনের মূর্তি, হায়ারোগ্লিফিক শিলালিপি, ধাতব জিনিসপত্র, ফারাওদের ব্যবহৃত স্বর্ণালংকার, প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা, পাথরের বাটখারা, সোনার তৈরি অনেক তৈজসপত্র পাওয়া যায়। 

প্রায় ৬৪টিরও বেশি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ও ৭০০টি নোঙরও পাওয়া গিয়েছিল। প্রায় তের বছর ধরে গোডিও ও তার দল এই ডুবে যাওয়া শহরের খনন কাজ করেন এবং এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো উদ্ধার করেন।  

শহরটি দেখতে আসলে যেমন ছিল 

খননকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীর পরিমাণ এবং গুণমান নির্ণয় করে দেখা যায় যে, এই শহর খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৬ষ্ঠ থেকে ৪র্থ শতক পর্যন্ত বেশ প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল। এই শহরের স্বর্ণ শিখর চলছিল তখন। এই সময়কালের প্রচুর পরিমাণে মুদ্রা এবং সিরামিক পাওয়া যায়। হেরাক্লিয়ন বন্দরে অসংখ্য বড় অববাহিকা ছিল এবং এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতো।  

থ্রিডি মডেলিংয়ের মাধ্যমে তৈরি হেরাক্লিয়নের একটি কাল্পনিক চিত্র; Image Source: hiddenincatours.com

বন্দরে তীব্র কার্যকলাপ শহরের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করেছে। খ্রিস্টপূর্ব ৬ থেকে ২ শতকের মধ্যে সাত শতাধিক আবিষ্কৃত প্রাচীন নোঙর এবং ৭৯টি ধ্বংসাবশেষ এখানের সামুদ্রিক কার্যকলাপের তীব্রতার একটি স্পষ্ট প্রমাণ। এছাড়াও, আরও ৪০টি ধ্বংসাবশেষ সনাক্ত করা যেতে পারে। তবে এখনও যাচাইকরণের প্রয়োজন। 

শহরটি মন্দিরের চারপাশে বিস্তৃত ছিল। শহরের চারপাশে খালের মতো একটি নেটওয়ার্ক এটিকে একটি হ্রদের মতো রূপ দিয়েছিল। দ্বীপগুলিতে বাসস্থান এবং অনেক অভয়ারণ্য অবস্থিত ছিল। এখানে খননকালে ব্রোঞ্জের মূর্তিগুলির মতো সুন্দর প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পাওয়া গেছে। 

মন্দিরের উত্তর দিকে হেরাক্লেস পর্যন্ত, একটি বিশাল খাল শহরের মধ্য দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছিল এবং বন্দর অববাহিকাগুলিকে পশ্চিমে একটি হ্রদের সাথে সংযুক্ত করেছিল।

ব্রোঞ্জ নির্মিত ওসাইরিস এর মূর্তি; Image Source: canyouactually.com

দেবতা ওসিরিসের পুনর্জন্মের সম্মানে প্রতি বছর এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানটি করা হতো যা ‘ওসাইরিস এর রহস্যাদি’ নামে পরিচিত ছিল। ডেন্ডেরার মন্দিরের ওসিরিয়ান চ্যাপেলে এবং ক্যানোপাসের রাজকীয় ডিক্রির স্টিলে পাঠ্য এবং চিত্রগুলি এই জাগ্রত উদযাপন এবং দেবতার পুনঃজাগরণের বিবরণ বর্ণনা করে। তার আনুষ্ঠানিক নৌকায় ওসিরিসকে শহরের মহান মন্দির আমুন-গেরেব থেকে মিছিল করে ক্যানোপাসে তার মন্দিরে আনা হয়েছিল।  

ধর্মীয় উপাসনা কেন্দ্র

পুরানো ঐতিহাসিকদের বিবরণের মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো যে, শহরটি বীর দেবতা হেরাক্লিসকে সম্মান জানাতে হেরাক্লিয়ন নামে বিশাল এক মন্দির তৈরি করে। এই শহর একটি ব্যস্ত বাণিজ্য বন্দর এবং উপাসনার ধর্মীয় কেন্দ্র উভয়ই ছিল। 

ষোল ফুট পাথরের ভাস্কর্য এবং সারকোফ্যাগি মমিকৃত প্রাণি ধারণ করে বলে বিশ্বাস করা হয়েছিল। এই ঐশ্বরিক শহর একটি বিশিষ্ট ধর্মীয় স্থান ছিল তা এর মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া যায়। 

উদ্ধারকৃত তিনটি বিশাল গ্রানাইটের মূর্তি; Image Source: franckgoddio.org

উপরন্তু, ওসিরিসের বার্ষিক উদযাপন এই মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তিনটি বড় মূর্তি আছে এই মন্দিরে। যার একজন ফারাও, তার রানী এবং দেবতা হ্যাপি। এই মূর্তিগুলো মন্দিরের প্রবেশপথেই অবস্থিত। 

ফ্রাঙ্ক গোডিও অনুমান করেছেন যে, শহরের মাত্র ৫ শতাংশ এখনও আবিষ্কৃত হয়েছে। পানির নিচের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা আজ অবধি চলছে। 

 

Feature Image: atlasobscura.com 
Sources:

01. Egypt’s Lost city “Thonis-Heracleion”. 
02. Heracleion- Frank Goddio. 
03. Thonis-Heracleion: An ancient Egyptian city that sank under water. 
04. The Lost City of Heracleion. 
05. Heracleion – Discovery of the Ancient Sunken Egyptian City.