ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থণার জন্য নির্ধারিত স্থান হচ্ছে মসজিদ। মহানবী (সাঃ) এর ইসলাম প্রচার শুরু হওয়ার সময় থেকেই মসজিদ মুসলমানদের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে। তাই, নির্দিষ্ট ইবাদতের বাইরেও মুসলিম সমাজে মসজিদের প্রভাব অনেক বিস্তৃত এবং সুদূরপ্রসারী।
যুগ যুগ ধরে পৃথিবীব্যাপী স্থাপিত মসজিদগুলো বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন হিসেবে দন্ডায়মান। বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের বড় বড় মসজিদগুলো সেদেশের মুসলমানদের সমৃদ্ধশালী এতিহ্য এবং স্থাপত্যকলার প্রদর্শনী। বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের ইসলামী সংস্কৃতি ধারণ ও লালন করার জন্য এবং তাদের সমৃদ্ধির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে বিশাল আকৃতির সৌন্দর্যমন্ডিত এই মসজিদগুলো স্থাপন করে। আজকের আয়োজনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ৫টি মসজিদের বিস্তারিত আলোচনা থাকছে।
একটি মসজিদ কতটুকু বড় হতে পারে? বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদগুলোতে কতজন মুসলমান একসাথে নামাজ পড়তে পারে? সংখ্যাগুলো সত্যিকার অর্থেই চমকপ্রদ! একই সাথে বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি এ মসজিদগুলোতে নামাজ পড়ার স্থান ছাড়াও অনেক জায়গা থাকে বিভিন্ন কাজ অথবা সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য।
তাই, মসজিদগুলোর পরিমাপ একইসাথে আয়তন দিয়ে বোঝা যায় এবং একসাথে কতজন নামাজ আদায় করতে পারে-সেই সংখ্যা থেকেও মসজিদের বিশালত্বের পরিমাপ করা যায়। মসজিদগুলো তাদের বিশালত্ব এবং সৌন্দর্যের জন্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে আসছে বহুদিন ধরে। মুসলমানদের সমৃদ্ধির ইতিহাসের সাক্ষী এই মসজিদগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে ছড়িয়ে আছে। এই মসজিদগুলো নিয়ে কৌতুহলের অবসান ঘটাতেই আজকের আয়োজন!
১. মসজিদুল হারাম, মক্কা
অনেকটা অনুমিতভাবেই মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান মক্কায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মসজিদ অবস্থিত। এটিকে বলা হয় ‘মসজিদুল হারাম’। সৌদি আরবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর মক্কার প্রাণকেন্দ্রে এই মসজিদটি অবস্থিত। এই মসজিদটির কেন্দ্রে কাবাঘর অবস্থিত। যা মুসলমানদের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র স্থান। স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মসজিদও এটি।
ইসলামের মূল ৫টি স্তম্ভের একটি হচ্ছে ‘হজ্জ’। হজ্জের মূল কার্যক্রম এই মসজিদটিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। প্রতি বছর লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মক্কায় হজ্জ করতে আসে। হজ্জের সময়টায় এই মসজিদে সবার নামাজ পড়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই অনেক মানুষ ধারণ করার উপযোগী হিসেবেই তৈরি করা হয়েছে মসজিদটিকে।
এই মসজিদটি তৈরি করা হয়েছে ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু হওয়ার সময়ে। এর আয়তন প্রায় ৩,৫৬,০০০ বর্গমিটার। এটিতে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ একসাথে নামাজ আদায় করতে পারে। তবে, শুরু থেকেই এটি এতবড় ছিল না। সময়ের সাথে সাথে এটির ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্ধমান হাজীদের জায়গা দেবার নিমিত্তে এটি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মসজিদ।
পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক মসজিদগুলোর মধ্যেও এটি একটি। হজ্জ্বে আগত মুসলমানদের স্বস্তিতে নামাজ আদায়ের স্বার্থে সব ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হয়। শুধু বিশালতাই নয়, এর স্থাপত্যশৈলীও চমক জাগানোর মতো। সৌদি আরবের সরকার এটির রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।
২. মসজিদে নববী, মদিনা
ইসলামের অন্যতম একটি পবিত্র স্থান হচ্ছে মদিনা। মহানবী(সাঃ) এখান থেকেই ইসলাম বিস্তারে কাজ করেন। তাই মদিনার ‘মসজিদে নববী’ মুসলমানদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ। মহানবী (সাঃ) এর স্মৃতি বিজড়িত এই মসজিদটিতে নামাজ আদায় করা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নিকট খুবই আরাধ্য।
হজ্জ করতে এসে সবাই এখানে নামাজ পড়ার চেষ্টা করে। এটিও আয়তনে অনেক বড়। মসজিদটি স্থাপন করা হয় মহানবী (সাঃ) এর হিজরতের পর। মহানবী (সাঃ) নিজে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। মদিনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন সামজিক কার্যক্রম মসজিদে নববী থেকেই পরিচালিত হতো।
এর আয়তন প্রায় ৩,৮৪,০০০ বর্গমিটার। এখানে প্রায় ১৫ লক্ষ মুসলমান একসাথে নামাজ আদায় করতে পারে। এটিরও সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে সৌদি আরব সরকার। নিয়মিত বিরতিতে মসজিদটির সংস্কার কার্যক্রম চলে। একই সাথে চলে এর ধারণক্ষমতা বাড়ানোর প্রক্রিয়া।
৩. বাদশাহ ফয়সাল মসজিদ, পাকিস্তান
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত বাদশাহ্ ফয়সাল মসজিদটি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মসজিদ। ১৯৮৬ সালে সৌদি আরবের সরকারের অর্থায়নে মসজিদটি স্থাপন করা হয়। এজন্য মসজিদটির নামকরণ করা হয় তৎকালীন সৌদি আরবের সরকার প্রধান বাদশাহ ফয়সালের নামানুসারে।
মসজিদটি যেমন বড়, দেখতেও তেমনই সুন্দর। সাধারণ মসজিদগুলো থেকে এর নকশা ভিন্নরকম করা হয়েছে। সাধারণ মসজিদগুলোর গম্বুজ ব্যবহার না করে এর নকশা করা হয়েছে বেদুইনদের তাবুর মতো। ইসলামাবাদ শহরের সৌন্দর্যকে অনেকাংশেই বর্ধিত করেছে এই মসজিদটি।
মসজিদের ভেতরের আয়তন প্রায় ১,৩০,০০০ বর্গমিটার। এতে ৩ লক্ষ মানুষ একসাথে নামাজ আদায় করতে পারে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এটিই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মসজিদ। পরবর্তীতে ‘মসজিদুল হারাম’ সংস্কার করে বড় করা হলে ‘বাদশাহ ফয়সাল মসজিদ’ তার মুকুট হারায়।
৪. ইসতিকলাল মসজিদ, ইন্দোনেশিয়া
বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদগুলোর কথা হচ্ছে, আর এখানে সবচেয়ে বেশি মুসলমানের দেশ ইন্দোনেশিয়া না থাকে কিভাবে? ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় অবস্থিত পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম মসজিদ, ‘মসজিদ ইসতিকলাল’ বা ‘স্বাধীনতার মসজিদ’। ‘ইসতিকলাল’ শব্দটির অর্থ ‘স্বাধীনতা’।
ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীন হবার পরপরই এi মসজিদ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। একটি স্বাধীন মুসলিমপ্রধান দেশের প্রেক্ষাপটে যা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নিজেদের স্বাধীনতার স্মৃতিকে ধরে রাখতেই মসজিদটি স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। এর নির্মাণ কাজ শুরু করা হয় ১৯৬১ সালের দিকে৷
অবশেষে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এই মসজিদটি স্থাপন কার্যক্রম শেষ হয় ১৯৭৮ সালে। এর প্রবেশদ্বার টি। যার নামকরণ করা হয় ‘আসমাউল হুসনা’ এর নামানুসারে। দরজাগুলো ৭টি বেহেশতের প্রতীক হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। এর আয়তন প্রায় ১,০০,০০০ বর্গমিটার এবং নামাজ আদায় করতে পারে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ।
৫. শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ, আরব আমিরাত
সযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থিত ‘শেখ জায়েদ মসজিদ’ আছে তালিকার ৫ নম্বরে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে এটি অবস্থিত। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৭ সালে। মসজিদটির নির্মাণকাজ অবশ্য শুরু হয় ১৯৯৪ সালের দিকে।
তৎকালীন আরব আমিরাতের রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি এই মসজিদ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান, মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই ২০০৪ সালে ইন্তেকাল করেন। তাকে মসজিদের পাশেই দাফন করা হয়। তার নামানুসারেই মসজিদটির নামকরণ করা হয়।
বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ঐক্য তৈরির প্রতীক হিসেবে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মসজিদটি তার বিশালতার চেয়ে সৌন্দর্যের জন্য বেশি বিখ্যাত। আবুধাবি শহরের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে এই মসজিদটি। অনেকেই এর সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য আসেন।
মার্বেল পাথরের থরে থরে সাজানো নকশা যেকোনো মানুষের মন কেড়ে নিবে। নামাজের জন্যও এখানে আছে যথেষ্ট জায়গা। প্রায় ৪০ হাজার মানুষ একসাথে নামাজ পড়তে পারে এখানে। এটির আয়তন প্রায় ২২,৪১২ বর্গমিটার।
Feature Image: islamicfinder.com 01. Top 10 largest mosques in the world. 02. World's 10 largest mosques by size. 03. Largest mosques in the world.