যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধযান হলো ট্যাংক। একে যুদ্ধক্ষেত্রের রাজা বললেও ভুল হবে না। তবে অনেকের কাছে ট্যাংক শব্দটি শুনলেই একটি লৌহ দানবের মতো ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মূলত পুরু বর্ম দ্বারা ট্যাংকের পুরো শরীর ঢাকা থাকে বলেই হয়তো এমন অবয়ব কল্পনায় চলে আসে।
ট্যাংক আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে অনেকখানি ভূমিকা পালন করে আসছে এই যুদ্ধযানটি। হালকা, মাঝারি বা ভারী টাইপের ট্যাংক কাজের ক্ষমতাভেদে তৈরি করা হতো। ট্যাংক লোহার চেইন-এর উপর ভর করে চললেও যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের সামনে হয়ে উঠে ত্রাস।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে মূলত ট্যাংকের ব্যবহার শুরু হয়। প্রথম দিকে ট্যাংক শব্দটি সাংকেতিক নাম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য দেশগুলোতে ট্যাংকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ট্যাংকের ব্যবহার আরো বৃদ্ধি পায়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ট্যাংকের কাঠামোগত অনেক পরিবর্তন শুরু হয়।
আধুনিক যুদ্ধ ট্যাংকগুলো তৈরি করতে শুরু করে পশ্চিমা দেশগুলো, সেই সাথে রাশিয়া, চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া। তাছাড়া ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই তাদের নিজস্ব ট্যাংক তৈরি করছে। বর্তমানে অনেক দেশ আধুনিক যুদ্ধট্যাংক তৈরি করার নেশায় নেমেছে। কাকে, কিভাবে টেক্কা দেওয়া যায়। তাই, আজকের আলোচনায় থাকছে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ৫টি শক্তিশালী যুদ্ধট্যাংকের কথা।
এমওয়ান এটু (M1A2) আব্রামস
আব্রামস এমওয়ান এটু (M1A2) হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান যুদ্ধ ট্যাংক, যা মার্কিন সেনাবাহিনীদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। মূলত জেনারেল ডাইনামিকস ল্যান্ড সিস্টেম দ্বারা এই যুদ্ধ ট্যাংক তৈরি করা হয়েছে। ট্যাংকের প্রধান অস্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে লোড হয় যা ১২০ মিমি এক্সএম ২৫৬ স্মুথবোর কামান। সাধারণত যা সাঁজোয়া যান, পদাতিক এবং কম উড়ন্ত বিমানে বিভিন্ন ধরনের ন্যাটো অভিযানে গোলাবারুদ নিক্ষেপ করতে সক্ষম।
উন্নত ফায়ারপাওয়ার এবং গতিশীলতা প্রদানের জন্য এটাকে বিশ্বের অত্যতম সেরা ট্যাংক বলা হয়। তাছাড়া ট্যাংকটিতে দুটি ৭.৬২ মিমি এম২৪০ মেশিনগান এবং এ.৫০ ক্যাল এম২ মেশিনগান এবং ১২০ মিমি গোলাবারুদের ৪২ রাউন্ড, ৭.৬২ মিমি গোলাবারুদের ১১,৪০০ রাউন্ড, এ.৫০ ক্যালিবার গোলাবারুদের ৯০০ রাউন্ড, ৩২টি স্ক্রিনিং বোমা এবং ৩২ রাউন্ড স্ক্রিনিং বোমা দিয়ে সজ্জিত করা।
উচ্চস্তরের সুরক্ষা প্রদানের জন্য, বুরুজে পুরু বাহিক যৌগিক বর্ম এবং ইস্পাত দিয়ে ইউরোনিয়াম বর্ম দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ট্যাংকটির ক্রুজিং রেঞ্জ ৪২৬ কিলোমিটার এবং প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ গতি ৬৭.৫ কিলোমিটার।
টি-ফোরটিন (T-14) আরমাটা
টি-ফোরটিন (T-14) আরমাটা হলো রাশিয়ার তৈরি আধুনিক প্রজন্মের ট্যাংক। এটি মূলত রাশিয়ান সেনাবাহিনীদের জন্য উরালভাগনজাভোড (UVZ) দ্বারা নির্মাণ করে হয়েছে। ট্যাংকের প্রধান অস্ত্র ১২৫ মিমি (125mm) ২এ৮২-১এম (2A82-1M) স্মুথবোর কামান, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে লোড হয়। দ্বিতীয় অস্ত্র হিসেবে রয়েছে একটি কর্ড ১২.৭ মিমি (Kord 12.7mm) এবং একটি পিকেটিএম ৭.৬২ মিমি (PKTM 7.62 mm) মেশিনগান।
এই ট্যাংকটি লেজার-গাইডেড মিসাইল নিক্ষেপ করতে পারে। সাথে ৪৫ রাউন্ড গোলাবারুদ বহন করতে পারে। তাছাড়া টি-ফোরটিন ট্যাংকে রয়েছে আফগানিট অ্যাক্টিভ প্রোটেকশন সিস্টেম। যা ইনকামিং অ্যান্টি-ট্যাংকের অস্ত্র শনাক্ত এবং ট্রাক করতে পারবে। এটি এ-৮৫-৩এ (A-85-3A) টার্বোচার্জড ডিজেল ইঞ্জিন দ্বারা চালিত। যার গতি ঘন্টায় ৯০ কিলোমিটার।
কে-টু (K-2) ব্ল্যাক প্যান্থার
কে-টু (K-2) ব্ল্যাক প্যান্থার হলো কোরিয়ার প্রধান যুদ্ধযান ট্যাংক। মূলত হুন্ডাই রোটেম কর্তৃক কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই ট্যাংকের ওজন প্রায় ৫০ টন। ২০১৪ সালের দিকে কে-টু (K-2) ব্ল্যাক প্যান্থার প্রথম ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল। এই ট্যাংকের প্রধান অস্ত্র হলো একটি ১২০ মিমি স্মুথবোর কামান। যা উচ্চ গতিশক্তির গোলাবারুদ ছুঁড়তে সক্ষম এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে গোলাবারুদ লোডও করতে পারে।
দ্বিতীয় অস্ত্র হিসেবে রয়েছে ৭.৬২ মিমি (7.62mm) এবং ১২.৭ মিমি (12.7 mm) মেশিনগান। ট্যাংকটির ক্রুজিং রেঞ্জ ৪৫০ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ গতি ৭০ কিলোমিটার। সরাসরি আগুনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সুরক্ষার জন্য ট্যাংকটিতে যৌগিক বর্ম এবং বিস্ফোরক প্রতিক্রিয়াশীল বর্ম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া গোলাবারুদ বিস্ফোরণ থেকে রক্ষা করার জন্য ব্লো-অফ প্যানেলও ব্যবহার করা হয়েছে।
চ্যালেঞ্জার টু (Challenger 2)
চ্যালেঞ্জার টু হলো ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এবং ওমানের রয়্যাল সেনাবাহিনীর প্রধান যুদ্ধ ট্যাংক। মূলত এমবিটি চ্যালেঞ্জার ওয়ান ট্যাংকের ওপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ ভিকার্স ডিফেন্স সিস্টেমস (বর্তমানে BAE সিস্টেমস) দ্বারা ডিজাইন এবং তৈরি করা হয়েছিল। চ্যালেঞ্জার টু-এর ক্ষমতা বসনিয়া, কসোভো এবং ইরাকে যুদ্ধ মিশনের সময় প্রমাণিত হয়েছে। যার ফলে এই ট্যাংক বিশ্বের অন্যতম নির্ভরযোগ্য প্রধান ট্যাংক হিসেবে পরিচিত।
চ্যালেঞ্জার টু-এর প্রধান অস্ত্র হলো একটি ১২০ মিমি (120 mm) ল৩০ (L30) কবজ। তাছাড়া সম্পূরক অস্ত্র হিসেবে রয়েছে একটি সি-এক্সল ৭.62 মিমি (C-axial 7.62mm) চেইন কামান এবং একটি টারেট মাউন্টেন ৭.৬২ মিমি (7.62mm) মেশিনগান।
ট্যাংকটিতে ৫০টি আর্মার পিয়ার্সিং, ফিন স্টাবিলাইজড, ডিসকাডিং সাবোট, হাই-বিস্ফোরক স্কোয়াশ হেডস এবং সোক রাউন্ডের পাশাপাশি ৭.৬২ মিমি গোলাবারুদের ৪,০০০ রাউন্ড বহন করতে পারে। চ্যালেঞ্জার ২-এর দ্বিতীয় প্রজন্মের চোবহাম বর্ম সরাসরি আগুনের অস্ত্রের বিরুদ্ধে সরাসরি উচ্চস্তরের সুরক্ষা প্রদান করবে। ট্যাংকের পারকিন্স-কন্ডর সিভি ১২ (Perkins-Condor CV 12) ইঞ্জিনের সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ৫৯ কিলোমিটার।
মেরকাভা এমকে ফোর (MK 4)
মেরকাভা ফোর হলো ম্যানট্যাক-এর মেরকাভা লাইনের সাম্প্রতিক পুনরাবৃত্তি। ট্যাংকটি ২০০৪ সালের দিকে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য প্রথম ব্যবহার করা শুরু হয়। এমকে ফোর (Mk 4) ট্যাংকে রয়েছে ১২০ মিমি স্মুথবোর কামান যা হিট এবং স্যাবট রাউন্ডের পাশাপাশি লাহাট (LAHAT) অ্যান্টি-ট্যাংক গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে সক্ষম। ট্যাংকের ফায়ার পাওয়ার হলো ৭.৬২ মিমি কোএক্সাইল এবং ১২.৭ মিমি সুইভেল-মাউন্ট করা মেশিনগান। পাশাপাশি একটি ৬০ মিমি গ্রেনেড লঞ্চার নিক্ষেপ করতে সক্ষম।
তাছাড়া, ট্যাংকে থাকা ট্রফি সক্রিয় সুরক্ষা ব্যবস্থা অ্যান্টি ট্যাংক মিসাইলের বিরুদ্ধে ক্রুদের রক্ষা করবে। ট্যাংকের সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ৬৪ কিলোমিটার। এসব কারণে এমকে ফোরকে (MK 4) বিশ্বের সেরা সুরক্ষিত ট্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ট্যাংক প্রায় একশত বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিসেবা দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশ আধুনিক যুদ্ধ ট্যাংক নির্মাণ করছে। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংক হলো একটি আতংকের নাম।
Feature Image: militarywatchmagazine.com References: 01. The Main-Battle-Tanks-in-world. 02. Most-Powerful-Main-Battle-Tanks-of-the-world. 03. Most-Expensive-modern-battle-tanks.