যুদ্ধ বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে চারিদিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি, সৈনিকদের মধ্যে ধস্তাধস্তি এবং বিধ্বস্ত এক চিত্র। সেই যুদ্ধ যদি বিশ্বযুদ্ধ হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই! বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে জানে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আজ পর্যন্ত দুইটি বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর বুকে সংঘটিত হয়েছে।
তবে বিশ্বযুদ্ধে যে শুধু মারামারি এবং ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে তাই নয়, বরং যুদ্ধকালীন প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে আবিস্কার করা হয়েছিল হরেকরকম জিনিস। মূলত সেই সময় যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই তৈরি করা হয়েছিল নানান ধরনের কৌশল এবং পরিকল্পনা যা থেকে বিভিন্ন উদ্ভাবনী জিনিস আবিষ্কার হয়েছিল। যার কিছু জিনিস পরবর্তীতে দৈনন্দিন জীবনেও কাজে লেগে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অবাক করা এরকমই ১২টি আবিস্কার নিয়ে আজকের আয়োজন।
স্যানিটারি টাওয়েল
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে সাড়া জাগানো আবিস্কার হচ্ছে স্যানিটারি টাওয়েল। যুদ্ধের সময় যুদ্ধের সৈন্যদের জন্য যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করার মতো অবস্থা ছিল না। সেই সময় কিম্বারলি ক্লার্ক নামক আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ১৯১৪ সালে এই টাওয়েল তৈরি করে।
এই টাওয়েলের প্রধান এবং উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর অধিক শোষণ ক্ষমতা। যুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যরা ও তার মিত্র বাহিনী এই স্যানিটারি টাওয়েলের সরবরাহ পেতো। এছাড়াও, তৎকালীন রেড ক্রসের নার্সরাও তাদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির কথা ভেবে এই টাওয়েল ব্যবহার করতে শুরু করে।
মূলত এই টাওয়েল-এর ধারণা থেকেই আজকের ন্যাপকিনের জন্ম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, এই কোম্পানিটি সামরিক বাহিনী এবং রেড ক্রস থেকে তাদের তৈরি করা ব্যান্ডেজগুলোর অবশিষ্টাংশ কিনে নেয় এবং পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার বাণিজ্যিকভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করে যার নাম দেয়া হয় কোটেক্স।
কোটেক্স নামক নতুন পণ্যটি যুদ্ধবিগ্রহের দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯২০ সালের অক্টোবরে জনসাধারণের কাছে বিক্রি হয়েছিল।
ক্লিনেক্স বা হ্যানকিস কাগজ
১৯২০-এর দশকের গোড়ার দিকে, সিএ বার্ট ফোরনেস সেলুলোজ উপাদান ইস্ত্রি করার মাধ্যমে মসৃণ এবং নরম টিস্যু তৈরি করেন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে, ১৯২৪ সালে ‘ক্লিনেক্স’ নামে ফেসিয়াল টিস্যুর জন্ম হয়।
কিম্বার্লি ক্লার্ক কোম্পানির তৈরিকৃত এই টিস্যুর নাম দেয়া হয় ক্লিনেক্স। যুদ্ধের সময় এই টিস্যু অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার ছিল। যুদ্ধাহত সৈনিকদের ক্ষত পরিষ্কারেও এই টিস্যু অনেক কাজে এসেছে।
সূর্যের আলো
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষ দিকে, ১৯১৮ সালের শীতকালে, বার্লিনের অর্ধেক শিশু রিকেট রোগে ভুগছিল। শহরের একজন ডাক্তার, কার্ট হুল্ডসচিনস্কি চারজন রোগীর উপর একটি পরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যার মধ্যে একজনের বয়স ছিল তিন বছর। তিনি তাদের চারটি পারদ-কোয়ার্টজ ল্যাম্পের নীচে রেখেছিলেন যা অতিবেগুনী আলো নির্গত করে।
চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে তিনি দেখলেন যে, তার তরুণ রোগীদের হাড় শক্ত হয়ে উঠছে। ১৯১৯ সালের মে মাসে, যখন গ্রীষ্মের সূর্য এসেছিল, তিনি তাদের রোদে ছাদে বসিয়েছিলেন। আসলে ভিটামিন ডি ক্যালসিয়ামের সাথে হাড় গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় এবং এই প্রক্রিয়াটি সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি দ্বারা সম্পন্ন হয়। তার এই আবিষ্কার প্রকাশিত হবার পর, যুদ্ধের সৈন্যরাও রিকেটস রোগ থেকে মুক্তি পাবার জন্য রোদ পোহাতে শুরু করে।
দিবালোক সংরক্ষণ সময়
১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তার একটি প্রবন্ধে সর্বপ্রথম দিবালোক সংরক্ষণের সময় ব্যবস্থার ধারণা তুলে ধরেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সময় বেশ কিছুটা এগিয়ে দেয়া হয়।
কয়লার তীব্র ঘাটতির মুখোমুখি হয়ে, জার্মান কর্তৃপক্ষ আদেশ দেয় যে ৩০ এপ্রিল ১৯১৬, ঘড়ির কাঁটা রাত ১১টা থেকে থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এগিয়ে নিতে হবে। সন্ধ্যায় দিনের আলোর একটি অতিরিক্ত ঘন্টা দেওয়া উচিত।
কয়লা সংরক্ষণের উপায় হিসাবে জার্মানিতে যা শুরু হয়েছিল তা দ্রুত অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে এই নিয়ম চালু করেছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কোনো কোনো দেশ পরবর্তীতে প্রকৃত সময়ে ফিরে এসেছিল। তবে এখনো অনেক দেশ এই পদ্ধতির ব্যবহার করে থাকে।
টি-ব্যাগ
যদিও চা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগেই আবিস্কার হয়েছিল তবুও টি-ব্যাগের আবিস্কার হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েই! একজন আমেরিকান চা ব্যবসায়ী ১৯০৮ সালে তার গ্রাহকদের কাছে ছোট ব্যাগে চা পাঠাতে শুরু করেছিলেন।
কিন্তু জার্মান কোম্পানি তিকান্নে এই আইডিয়াটি কপি করেছিল এবং যুদ্ধে নিযুক্ত সৈন্যদের সরবরাহ করতে শুরু করে। তারা এটিকে চায়ের বোমা হিসেবে সম্বোধন করতো।
হাতঘড়ি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে হাতঘড়ি আবিষ্কৃত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে অনেকেই এই নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এর প্রচলন বেশি হয়। হাতঘড়ি ব্যবহারের ফলে সৈন্যরা সময় জানতে পারতো। ফলে সময়মতো কাজ শেষ করতে সক্ষম হতো।
কখন খেতে হবে, কখন ঘুমাতে হবে, কখন যুদ্ধে যেতে হবে সবকিছু একটা রুটিনের আওতায় চলে এসেছিল। তাই বলা যায় যে, এই হাতঘড়ি ব্যবহারের কারণে সৈনিকদের মধ্যে এক ধরনের শৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল। বর্তমানে এই হাতঘড়ি আমাদের নিত্যদিনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তুগুলোর মধ্যেই একটি।
সবজি সসেজ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, জার্মানির ব্রিটিশ অবরোধ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। শহরে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। তখন অ্যাডেনাউয়ার কোলনের মেয়র ছিলেন। তিনি খাদ্যের অভাব কীভাবে সহজ উপায়ে মেটানো যায় তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। মাংস তখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাওয়ায় তার মাথায় সবজি সসেজের ধারণা আসে।
তিনি গমের পরিবর্তে রুটি তৈরিতে চাল-ময়দা, বার্লি এবং রোমানিয়ান কর্ন-ফ্লাওয়ার মিশ্রণ ব্যবহার করা শুরু করেছিলেন। রোমানিয়া যুদ্ধে প্রবেশ না করা পর্যন্ত এবং ভুট্টার আটার সরবরাহে সংকট দেখা পর্যন্ত এটি করেন।
এই পরীক্ষামূলক রুটি থেকে, তিনি মাংসহীন সসেজের ধারণা পান। উপাদান হিসাবে সয়া নিয়ে আসেন। যা ফ্রাইডেনসওয়ার্স্ট হিসেবে পরিচিতি পায়। রাজা পঞ্চম জর্জ ২৬ জুন ১৯১৮ সালে সয়া সসেজকে একটি পেটেন্ট প্রদান করেন।
জিপার
তৎকালীন ইউনিভার্স ফাস্টেনার কোম্পানির হেড ডিজাইনার গাইডিওন সান্ডব্যাক সর্বপ্রথম জিপারের ধারণা নিয়ে আসেন। তিনি ‘হুকলেস ফাস্টেনার’ তৈরি করেন। চেইন স্লাইডের সাথে সাথেই তা দুই সেট জিপকে একত্রে লক করে দেয়।
মার্কিন সামরিক বাহিনী তাদের ইউনিফর্ম এবং বুট, বিশেষ করে নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে। যুদ্ধের পরে, বেসামরিক লোকেরাও অনুসরণ করেছিল। বর্তমানে জিপার চেইন ব্যাগ, জামা, জুতা, প্যান্টে ব্যবহৃত হয়।
স্টেইনলেস স্টিল
ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী বন্দুকের জন্য ভাল ধাতু খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিল। কারণ যে সমস্যাটি হচ্ছিল তা হলো বন্দুকের ব্যারেলগুলি ঘর্ষণ এবং বুলেটের তাপে বারবার গুলি চালানোর কারণে বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল।
১৯১৩ সালে, শেফিল্ডের হ্যারি ব্রিয়ারলি প্রথম ‘মরিচাবিহীন’ বা স্টেইনলেস স্টীল তৈরি করেছিলেন; যা ধাতুবিদ্যা শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এটি আধুনিক বিশ্বের প্রাত্যহিক অবিচ্ছেদ্য উপাদান হয়ে উঠেছে। স্টিলের প্লেট, কাঁটা চামচে মরিচা পড়লে তা দিয়ে খাওয়া অযোগ্য হয়ে যায়। কিন্তু স্টেইনলেস স্টিল হলে মরিচা পড়ার সম্ভাবনা থাকে না।
মেশিনগান
১৮৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিরাম ম্যাক্সিম দ্বারা প্রথম উদ্ভাবিত, ম্যাক্সিম বন্দুক (ভিকার বন্দুক নামে পরিচিত) ১৮৮৭ সালে জার্মান সেনাবাহিনী গ্রহণ করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ভিকারদের মতো মেশিনগানগুলিকে হাত দিয়ে ক্র্যাঙ্ক করা হয়েছিল, তবুও যুদ্ধের শেষের দিকে তারা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে বিকশিত হয়েছিল। যা প্রতি মিনিটে ৪৫০-৬০০ রাউন্ড গুলি করতে সক্ষম।
ট্যাংক
১৯১৬ সালে সোমে যুদ্ধের সময় স্থল ট্যাংক ব্যবহার করা হয়েছিল। যার নাম মার্ক ফোর, ওজন ২৭-২৮টন এবং ৮ জন ক্রু ছিল। যুদ্ধ কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে, জুলাই ১৯১৮ সালে ট্যাঙ্ক কর্পস প্রতিষ্ঠিত হয়।
পাইলট কমিউনিকেশন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে, পাইলটদের একে অপরের সাথে এবং স্থলে থাকা মানুষদের সাথে কথা বলার উপায় ছিল না। যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যম যেমন রানার, পতাকা, পায়রা, ল্যাম্প এবং ডিসপ্যাচ রাইডার ব্যবহার করা হয়েছিল কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। বিমানচালকরা অঙ্গভঙ্গি এবং চিৎকারের উপর নির্ভর করতো।
১৯১৬ সালের শেষের দিকে শব্দকে ব্লক করার জন্য ইনার মাইক্রোফোন এবং ইয়ারফোনসহ একটি হেলমেটের নকশা করা হয়। যা এই সমস্যা পরবর্তীতে দূর করেছিল।
Feature Image: army.mil Sources: 01. 10 inventions that owe their success to World War One. 02. The 8 Most Important Inventions and Innovations of World War One. 03. WWI Inventions, From Pilates to Zippers, That We Still Use Today. 04. The 5 Most Surprising Inventions to Come Out of World War I.