লন্ডন বা ইউরোপের নাম শুনলেই চোখে ভাসে আলোর শহর। উঁচু উঁচু প্রাসাদ, পরিচ্ছন্ন শহরে নানা রঙের মানুষ, নানা জাতির, নানা ভাষার মানুষ ছুটে চলেছে ঐতিহাসিক এইসব স্থাপনা একনজর দেখতে। সেই বহু শতক আগে থেকেই এই ব্রিটেন সমস্ত দুনিয়ার মানুষের কাছে এক বিস্ময়। অসাধারণ স্থাপত্যশিল্পের এক নিদর্শন ইউরোপ মহাদেশের এই প্রতিটি অট্টালিকা। আজ আমরা চোখে ওপার বিস্ময় জাগানো বেশ কিছু প্রাসাদ সম্পর্কে জানব।
বাকিংহাম প্যালেস
ইউরোপ নিয়ে কথা বললে, এই রাজপ্রাসাদ নিয়ে কথা না বললে মস্ত অপরাধ হয়ে যাবে। যদিও শুরুতে এটি রাজপ্রাসাদ ছিল না। কথিত আছে, এই প্যালেসটির জায়গায় আগে আব্যে সন্ন্যাসীরা বাস করতো। প্রথমে এটি বাগান করার জন্য কেনা হয়। ১৭০৩ সালে সংস্কার করা হয়েছিল এই প্রাসাদের। কারণ, এখানে যে বাড়ি ছিল, সেটার অবস্থা ছিল বেশ খারাপ। একজন ডিউক ১৭০৫ সালে এই ভবন সংস্কারের কাজ শেষ করেন। পরবর্তীতে ১৭৬১ সালের দিকে বেশ মোটা অংকের অর্থ ব্যয় করে এই ভবন কিনে নেন রাজা ৩য় জর্জ। এরপর এই প্রাসাদে এসেছে অনেক রাজা-রাণী। অনেক ইতিহাস দেখেছে এই প্রাসাদ। রাজবাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই প্রাসাদ। নিরাপত্তার চাদরে মোড়া থাকে এই প্রাসাদ। পুরো বাড়ি ঘুরে দেখার অনুমতি আপনি পাবেন না। বর্তমানে ৩৫৪*৩৯০ ফিটের এই প্রাসাদটি প্রায় ৭৭,০০০ বর্গমিটার জায়গা জুড়ে রয়েছে। মোট ৭৭৫টি কক্ষ, সিনেমা হল, অর্নামেন্ট শপ, জাদুঘর, পোস্ট অফিস, প্রদর্শনী কক্ষসহ অনেক কিছুর সমন্বয়ে এই প্যালেস। নিরাপত্তার সাথে ঘুরে দেখতে পারবেন কিছু অংশ। দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত আছে হাজার হাজার চিত্রশিল্পীর কাজ, রাণিদের ব্যবহৃত মণিমুক্তাসহ রাজ পরিবারের জানা-অজানা ইতিহাস। ইউরোপ ঘুরতে গেলে অবশ্যই চোখ ধাঁধানো এই প্যালেস ঘুরে আসতে ভুলবেন না।
প্যালেস অব ভার্সাই
আমাদের দেশে একটা বাসার রুমের সংখ্যা কত? তিন, চার বা পাঁচ? একটু বড় বাসা হলে কিংবা ডুপ্লেক্স বাসা হলে সেটা হয়তো বেড়ে দাঁড়াবে ১০-১২ তে। কিন্তু, একটা প্রাসাদে কত গুলো ঘর থাকে? বড়জোর শ’খানেক? কিন্তু ৮০০ হেক্টর জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা ফ্রান্সের ভার্সাই প্যালাসে ঘরের সংখ্যা এক হাজার আটশো। ইউরোপের অন্যতম বিখ্যাত এই সুউচ্চ প্রাসাদ এবং সংলগ্ন বাগান নির্মিত হয় প্রায় ৩৪৫ বছর আগে, ১৬৭৭ সালে। চর্তুদশ লুই ছিলেন একজন ফরাসি শাসক। নিজের বাসভবন হিসেবে তৈরি করেন এই প্রাসাদ। প্রাসাদের মূল ফটকের ভেতরে, বাগান, ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ লেক, ৫০টি ঝরনাসহ আরো নানা রকমের দেখার মত জায়গা আছে। ঘুরতে ঘুরতে খিদে পেলে খেয়ে নেবার সুযোগ রয়েছে। প্রায় ৪০ বছর ধরে এই ভবন নির্মিত হয়। বর্তমানে এই প্যালেসটি পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। ভার্সাই নগরী আমাদের মাইকেল মধুসুদন দত্তের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু তিনি কি এসেছিলেন এই প্রাসাদে?
ইটালিতে ‘দোজে’-র প্রাসাদ
সেন্ট মার্ক চত্ত্বরে অবস্থিত এই প্রাসাদটি বর্তমানে ব্যবহৃত হয় জাদুঘর হিসেবে। একসময় এই প্রাসাদে কোর্ট, জেলহাজত, ল ফার্ম সহ নানাবিধ কাজে ব্যবহৃত হত। ১৯২৩ সালের আগ পর্যন্ত বাসভবন, অফিসিয়াল কার্যক্রমের জন্য ব্যবহার করা হত। মূলত এটি নির্মাণ করা হয়েছিল ইতালির সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারীর বাসভবন হিসেবে। যদিও প্রসাশনিক কাজই এখানে বেশি হত বলে প্রচলিত আছে।
ব্রিটেনের উইন্ডসর ক্যাসেল
ব্রিটিশরা আমাদের শাসন করে গেছে ২০০ বছর। সেই প্রভাব আজো হয়তো আছে আমাদের উপর। আমাদের চলনে বলনে একটা ছাপ আছে। সেই ব্রিটিশ আমলে যেখান থেকে আমাদের শাসন করা হত, যেখান থেকে বোধহয় আজো পুরো ইউরোপ শাসন করা হয়, সেই প্রাসাদ হল উইন্ডসর ক্যাসেল বা রাণীর বাসভবন। ৯৪৫ বছরের পুরানো এই প্রাসাদে যদিও রাজ পরিবার বর্তমানে সেভাবে এখানে বাস করে না। কয়েক দফায় এই ক্যাসেলের সংস্কার কাজ করা হয় । মহারাণী এলিজাবেথ, তাঁর স্বামী প্রিন্স ফিলিপের সাথে ২০২০ সালে এই প্রাসাদে এসে ওঠেন করোনা মহামারির সময়ে। সাথে ছিল অল্প কিছু কর্মচারী। ফিলিপ এই প্রাসাদেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই বছরের এপ্রিলে।
ইউকে পার্লামেন্ট ভবন
জাতীয় সংসদের অপূর্ব নির্মানশৈলী আমাদের মুগ্ধ করে। কত তর্ক-বিতর্ক, কত প্রস্তাব পাস কিংবা নাকচ করা হয় এখানে। কি অদ্ভুত, আমাদের দেশ চালানো হত সেই ইউ কে থেকে কয়েক বছর আগে। ২০০ বছর ধরে আমাদের দেশের জন্য পার্লামেন্ট ছিল ইউকে পার্লামেন্ট ভবন। বিশাল বাগান, কিছু ভাস্কর্যসহ স্থাপত্যশিল্পের এক দারুণ উদাহরণ এই ভবনটি। জনসাধারনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত উন্মুক্ত। যদিও নিরাপত্তা প্রবল, তবুও কিছু অংশ অনায়াসে ঘুরে আসতে পারবেন।
তুরস্কের টপকাপি প্রাসাদ
এটি তুর্কি সম্রাটের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হত এক সময়। মূল প্রাসাদের বাইরেও কয়েক হাজার কর্মচারী, কর্মকর্তা, রাজ পরিবারসহ অন্যান্যদের ব্যবহারের জন্য ছিল ছোট ছোট কিছু ভবন। খেলাধূলা, বিনোদনের জন্য আলাদা ব্যবস্থা, বন্দীশালাসহ নানা ধরনের সুবিধা ছিল এই প্রাসাদে। অদ্ভুত সুন্দর টাইলসে সাজানো এই প্রাসাদ, যেন সেই কত যুগের গল্প বয়ে নিয়ে আসছে।
অস্ট্রিয়ার শ্যোনব্রুন প্রাসাদ
৩০০ বছরের পুরাতন এই প্রাসাদ অস্ট্রিয়ার টুরিস্টদের জন্য প্রধান আকর্ষণ। এটি মূলত গ্রীষ্মকালীন অবকাশযাপন প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হত একসময়। নানা ধরনের বাগান এই প্রাসাদের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ১৯৫০ সাল থেকে এটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই প্রাসাদে রয়েছে ১৪৪১টি সুসজ্জিত কক্ষ, বিশাল বাগান, অসংখ্য পাখিসহ মন ভালো করে দেবার মত উপকরণ।
পর্তুগালের পেনা জাতীয় প্রাসাদ
ইউনেস্কোর যে সব ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তালিকা করেছে, তার মধ্যে অন্যতম এই পেনার জাতীয় প্রাসাদ। সিন্ট্রা শহরের ঠিক পাশেই পাহাড়ের পাদদেশে অপূর্ব বর্ণ আর রঙের এই প্রাসাদ। প্রাসাদের প্রেমে পড়তে বাধ্য যে দেখবে সেই। এটি পর্তুগালের রাজপরিবারের অবকাশ যাপন প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
রয়াল প্যালেস মাদ্রিদ
মাদ্রিদের এই রয়াল প্যালেস ইউরোপের অন্যতম বিশাল প্রাসাদ। আয়তন আর কার্যক্রমের দিক থেকে বৃহত্তর এই প্রাসাদ। ৯ শতক থেকে এই প্রাসাদ ব্যবহৃত হয়। ১৭৩৮ থেকে ১৭৫৫ সালে বর্তমানের এই প্রাসাদটি নতুন করে সংস্কার করা হয়। বিশাল এই প্রাসাদের একটা অংশ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত।
আমস্টার্ডাম রয়াল প্যালেস
১৭ শতকে আমস্টার্ডামের এই প্যালেস সিটি হল হিসেবে নির্মাণ করা হয়। ১৯৩৬ সালে এটি নেদারল্যান্ডসের সম্পত্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। বিশাল এই প্যালেসের দ্বিতীয় তলা কেবলমাত্র খোলা থাকে। নির্দিষ্ট দিন আর নির্দিষ্ট সময়ে জনসাধারন ঘুরে দেখতে পারেন। নেদারল্যান্ডের এই বিস্ময়কর প্যালেস অন্যতম টুরিস্ট স্পট।
ইউরোপ যেন একছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে পুরো দুনিয়ায়। শত শত প্রাসাদ থেকে শুরু করে বাগান, থিয়েটার, রাস্তা, বাগান, ব্রিজ ঐতিহ্যের মধ্যে কি নেই এই মহাদেশে? বেছে বেছে কিছু স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন নিয়ে আজ আমরা কথা বললাম। এই প্রাসাদগুলো নিয়ে অল্প কথায় সব বলা বেশ কঠিন।
Feature Image: wikimedia.commons
References:
01. Spectacular European Palaces.
02. Top 10 most beautiful castles & palaces in Europe.
03. লন্ডনের যে ১০টি জায়গায় ভ্রমণ করবেন।
04. ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর দশটি প্রাসাদ।