পৃথিবীতে মানবরাই সর্বপ্রথম সভ্যতার সূচনা করেছিল। তাই, যত অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য আবিষ্কার সব মানবদের হাত ধরেই এসেছিল। যা যুগ যুগ ধরে এমনকি এখনো ও ভবিষ্যতেও মানুষের কাজে লাগবে। আজকের আলোচনায় এমন ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা হবে যেগুলো আজ অবধি মানুষ ভুলতে পারেনি। আর ভবিষ্যতেও হয়তো কখনো ভুলবে না।
আগুনের আবিষ্কার
হোমো স্যাপিয়েন্স ২ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীতে আছে। কিন্তু আগুনের আবিষ্কার তাদের হাতে আসেনি। এছাড়া, দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়ান্ডারওয়ার্ক গুহায় ক্যাম্প ফায়ারগুলি প্রায় ১ মিলিয়ন বছর আগেকার। তার মানে দাঁড়াচ্ছে মানবেরই (হোমো স্যাপিয়েন্স নয়) আরেকটি প্রজাতি প্রায় ৮ লক্ষ বছর আগেই আগুনের আবিষ্কার করেছিল। তাই ধারণা ও কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে বলা হয়ে থাকে যে, ১০ লক্ষ বছর আগে হোমো ইরেক্টাস কর্তৃক আগুন ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
পাথরে পাথর ঘষে আগুন আবিষ্কারের কথা কে না জানে? তবে এই পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছে নানান মতবাদ। কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে সত্যি যে আগুনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে মানুষের সময় লেগেছে। ৪ লক্ষ বছর আগেকার এক আগুনের ভস্ম থেকে বুঝা যায় যে, তারা আগুন নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি বের করতে পেরেছিল তবে সেটা স্থায়ী হয়নি। ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ বছর পূর্বে আগুন ব্যবহারের ব্যাপকতা লক্ষ্য করা গেছে। রান্না, শীত নিবারণ, আলোর উৎস থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে আগুন মানুষকে সভ্য হবার দিকেই এগিয়ে নিয়ে গেছে।
গৃহপালিত পশুর ব্যবহার
মানব ইতিহাসের শুরুর দিকে পশু আর মানুষে ছিল চরম শত্রুতা। নিজেকে বাঁচানোর স্বার্থে একে অন্যকে আক্রমণ করতো এবং হত্যা করতো। কিন্তু আগুন আবিষ্কার হবার পর মানুষ যখন কাঁচা মাংস পুড়িয়ে খেতে শিখলো তখন থেকেই মূলত খাদ্যের উৎস হিসেবে গবাদিপশুর বিচরণ বাড়তে থাকলো দিন দিন। এরপর পশুর সংখ্যাবৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষিকাজে গবাদিপশুর গুরুত্বও বাড়তে শুরু করলো।
এতকিছু সত্ত্বেও সারাদিন সাথে থাকবে আর রাতে পাহারা দিবে এমন কোনো পোষা প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল না, অন্তত এমন ভাবনার আগ পর্যন্ত। পরবর্তীতে পোষা প্রাণীর ধারণা আসে মানুষের মাথায়। আর কুকুর ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম গৃহপালিত প্রাণী। যে কিনা রাতে মনিবের পাহারাদার হিসেবে কাজ করতো। প্রত্নতাত্ত্বিক সন্ধানে ১২ হাজার বছর পুরনো এক সমাধিতে কুকুরের কঙ্কাল আবিষ্কার এমন তথ্যই দেয় আমাদের।
চাকার আবিষ্কার
বলা হয়ে থাকে, একমাত্র চাকার আবিষ্কারই মানুষকে আদিম থেকে আধুনিকে রূপান্তর করেছিল। কারণ, চাকাই ছিল পৃথিবীর প্রথম মানবসৃষ্ট কোনো আবিষ্কার। যেহেতু প্রাচীনকালে সবকিছুই ছিল প্রকৃতি নির্ভর; কিন্তু প্রকৃতিতে চাকার নকশা আঁকার জন্য অনুপ্রেরণা ছিল না কোন। তাই চাকাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হিসেবে গণ্য করা হয়। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগেকার সভ্যতা মেসোপটেমিয়ায় চাকার আবিষ্কার হয়েছিল। তখন পাথরের মাঝে ফুটো করে কাঠের দণ্ড বসিয়ে মানুষ বা প্রাণী দ্বারা চাকা চালিয়ে টেনে নিয়ে যেওয়া হতো।
আর নব্যপ্রস্তর যুগের (খ্রিষ্টপূর্ব ১০,০০০-৪,৫০০) শেষ দিকে উদ্ভাবিত হয় কাঠের চাকা। কাঠের চাকার মাঝে স্পোকের ব্যবহার যে চাকার ওজন অনেকটাই কমিয়ে দেয় এবং ঘুরতেও সহায়তা করে, এমন ভাবনা এসেছিল খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার সালের দিকে। চাকা হালকা হওয়ায় পরিবহনের গতিও বাড়ে আবার টেনে নেয়ার পরিশ্রমও কমে। এভাবেই চাকা ঘুরার সাথে সাথে সভ্যতাও ঘুরতে থাকে।
অর্থ/মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন
একটা সময় ছিল যখন নিজেরাই নিজেদের পরিধানের কাপড় বানাতে হতো এবং নিজেদের শস্য নিজেদেরই উ ৎপাদন করতে হতো। কিন্তু তারপর মানুষ বুঝতে শিখলো যে, একাই সব কাজ করা সম্ভব নয়। বেঁচে থাকতে হলে নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে। তাই মানুষ বিনিময় প্রথার প্রচলন করলো। কিন্তু ৩ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাদের দিকে এই প্রথা ভেঙ্গে যায়। পরিবর্তে সুমেরীয় সভ্যতার মুদ্রার প্রচলন ঘটে।
শুরুতে তারা বার্লিকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করতো। কেননা, বার্লি খাওয়া এবং বপন দুই কাজেই ব্যবহৃত হতো। কিন্তু এরপর তারা রূপার শেকল ব্যবহার করা শুরু করে। কিন্তু রূপার শেকলের মান ছিল কম; কেননা এটা বার্লির মতো কাজ করতো না। তখনই তারা ম্যূলের ধারণা পায়।
৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে লিডীয়ার রাজা অ্যালিয়েটস মুদ্রা মুদ্রণ শুরু করেছিলেন। সোনা ও রূপা দিয়ে নির্মিত ছিল এবং তাতে রাজার স্বাক্ষর ছিল। সেই হিসেবে আজ অবধি কিংবা ভবিষ্যতে যত মুদ্রা মুদ্রণ হবে সেসবই লিডিয়ার মুদ্রার উত্তরাধিকার।
লেখার আবিষ্কার
সক্রেটিস বলেছিলেন যে, বর্ণমালা আমাদের বোকা বানিয়েছে; আর বিজ্ঞান বলেছে যে, মুখস্থ করার জন্য মস্তিষ্কের শক্তি উৎসর্গ করা আমাদের নিকৃষ্ঠ করেছে। কিন্তু একইসাথে লিখিত ভাষা ছাড়া জ্ঞানের বিস্তার ঘটানো অসম্ভব ছিল। ৩ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সুমেরিয় এবং মিশরিয়রা কিউনিফর্ম এবং হায়রোগ্লিফিকস তৈরি করেছিল। তবে সেগুলো ছিল বোধগম্য এমনসব চিত্রগ্রাম; যা ধারণাকে উপস্থান করার জন্য যথেষ্ট ছিল। অনেকটা আজকের যুগের ইমোজির মতোই।
খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ সালের দিকে ফিনিশিয়রা প্রাচীনতম যাচাইযোগ্য বর্ণমালা আবিষ্কার করেছিল। যা ২২টা অক্ষর নিয়ে গঠিত ছিল। সবগুলাই ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল। ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গ্রীকরা সর্বপ্রথম পূর্নাঙ্গ বর্ণমালা তৈরি করেছিল-ব্যঞ্জনবর্ণ ও স্বরবর্ণ নিয়ে গড়া বর্ণমালা। এখান থেকেই আজকের বর্ণমালা এসেছে। লেখার আবিষ্কার না হলে এমনকি এই লেখাও আপনি পড়তে পারতেন না।
ধর্মের সৃষ্টি
প্রাচীন গ্রীক, অ্যাজটেক এবং মিশরীয়রা দেব-দেবীতে বিশ্বাস করতো; কিন্তু তারা কখনোই তাদের বিশ্বাস ব্যবস্থার কোনো নাম দিতে পারেনি। এরপর ধর্মের প্রচলন হয়। পৃথিবীর প্রধান চার ধর্মের হিসেবে পৃথিবী এবং ধর্মের সৃষ্টির আলাদা আলাদা কারণ রয়েছে। তবে হিন্দু ধর্ম ছিল এর মধ্যে সবচাইতে প্রভাবশালী ধর্ম। কারণ, মূর্তি পূজা কিংবা চাঁদ, সূর্যের পূজা অনেককাল আগে থেকেই মানুষ করে আসছে।
আবার, ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে অন্ধকারের যুগ বদলে এসেছিল সত্য ও আলোর যুগ। আর আজকের দিনের যে তারিখ গণনা তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে খ্রিস্টান ধর্মের যীশু খ্রিষ্টের নাম। আর বৌদ্ধ ধর্মের জনপ্রিয়তা বাড়লে অন্যান্য ধর্মে খানিকটা ভাটাও পড়েছিল। এভাবেই পৃথিবীতে মানুষের বিশ্বাস ধর্মে রূপান্তর হয়েছিল।
সময় সংরক্ষণের ধারণা
প্রাচীন গ্রীক, চৈনিক, সুমেরীয় এবং মিশরীয়রা সূর্যঘড়ি, জলঘড়ি, হাওয়ারগ্লাস, ওবেলিস্কের মতো জিনিস ব্যবহার করতো পৃথিবীর ঘুর্ণন পরিমাপ করার জন্য। তবে তারা দিনটাকে বিভিন্ন ঘন্টায় ভাগ করতে পারেননি। পরিবর্তে মধ্যযুগের খ্রিস্টান সন্ন্যাসীরা-যারা কঠোর নিয়ম মেনে প্রার্থণার সময়সূচীর হিসাব রাখতো-তারাই প্রথম দিনটিকে ঘণ্টায় ভাগ করতে সক্ষম হয়। তারা প্রার্থণার জন্য নির্দিষ্ট সময় বের করতে চেয়েছিল। এজন্য তারা ঘণ্টা বাজিয়ে সেই সময় হয়েছে বুঝাতো।
আজকের যুগে সময়ই সবকিছু। বর্তমানে সময়ের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ আর শক্তিশালী জিনিস দুনিয়াতে দ্বিতীয়টা আর নাই। একটা সময় ছিল যখন কেউ সময় নিয়ে এত চিন্তাও করতো না; এমনকি সময়কে পাত্তাও দিতো না। কিন্তু এখন সময় ছাড়া আমরা অচল, সময় আমাদের অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করে।
ছাপাখানার উদ্ভাবন
বর্ণমালা তৈরি ছিল ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেশ দারুণ একটা ব্যাপার; কিন্তু সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছিল ছাপাখানার উদ্ভাবন হবার মধ্য দিয়ে। ছাপাখানা উদ্ভাবন হবার আগে সবকিছুই হাতে লেখা হতো বা খোদাই করে রাখা হতো। তাই, লিখিত শব্দ সবার জন্য ছিল না। তবে পুরো পৃথিবীর ইতিহাসই বদলে যায় যখন একজন জার্মান স্বর্ণকার ও কামার, জোহানেস গুটেনবার্গ তার মাস্টার আবিষ্কার – ছাপাখানা উদ্ভাবন করেন।
ছাপাখানা উদ্ভাবনের আগে ধর্মীয় কিংবা মহৎ কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া কেউই পাথরে খোদাই করে লিখে সময় নষ্ট করতো না। কিন্তু ছাপাখানা উদ্ভাবনের পর বিজ্ঞানের অনেক সূত্র সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছাতে শুরু করেছিল। মানুষ দ্রুত ও নির্ভুলভাবে মুদ্রণ করার শুরু করলে জ্ঞানের বিস্তার ঘটতে থাকে পূর্ণভাবে।
রেনেসাঁ
রেনেসাঁর সময় এত বেশি পরিবর্তন ও সংস্কার এসেছিল যে যা ছোট করে লিপিবদ্ধ করা অসম্ভব; তবে সেসব ঘটনা পুরোপুরি পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিল। বলা চলে, রেনেসাঁ আধুনিক বিশ্ব নির্মাণের ভিত্তি ছিল। ব্ল্যাক প্লেগের ঠিক পরপরই ১৪ শতকে এটি শুরু হয়েছিল এবং ১৭ শতক জুড়ে অব্যাহত ছিল। বিজ্ঞান, শিল্প, দর্শন, সমাজ, ভাষা, সরকার, ধর্ম, এবং এর মধ্যকার সবকিছু চিরতরে পরিবর্তন ঘটে রেনেসাঁ যুগে।
প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের ভিত্তি ৯৫ থিসিস লিখেছিলেন মার্টিন লুথার। ভূ-গোলক তৈরি করেছিলেন মার্টিন বেহাইম। পৃথিবী প্রদক্ষিণে বের হয়েছিলেন ম্যাগেলান। কলম্বাস আমেরিকায় এসে অবতরণ করে। শেক্সপিয়র লেখা শুরু করেন। মাইকেলেঞ্জেলো আঁকা শুরু করে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নিজের অমর সৃষ্টির পাশাপাশি অনেককিছুর ধারণা দেন। বার্তালোমিউ ডিয়াজ অন্বেষণে বের হন। সামন্ত্রতন্তের পতন ঘটে। পুঁজিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। কোপার্নিকাস সৌরজগতের নতুন সংজ্ঞা দেন। আইজ্যাক নিউটন মহাকাশ আবিষ্কার করেন।
শিল্প বিল্পব
একসময়, কেউ একজন বুঝতে পেরেছিল যে সেদ্ধ জল থেকে উঠে আসা বাষ্পগুলো একত্রিত হয়ে জিনিসগুলিকে চারপাশে সরাতে পারে। এবং এখান থেকেই মূলত বাষ্পশক্তির উদ্ভাবন হয়েছিল। ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত বিশ্ব দেখেছে রাসয়নিক উৎপাদন, বাষ্প শক্তি, লোহার উৎপাদন, ইঞ্জিনযুক্ত নৌকা, বাষ্পচালিত ট্রেন, রেলপথ, বস্ত্র নির্মাণ, শিল্প কারখানা, পুঁজিবাদ ইত্যাদি।
এর মাধ্যমে নগরায়ন, শ্রমিকদের অধিকার, শ্রম আইন, মধ্যবিত্তদের উত্থান, সম্পদ, আয় এবং আরো অনেককিছুই নতুনরূপে দেখা দেয় পৃথিবীতে। গণভোগবাদের সূচনা হয় এবং আধুনিক সমাজের সূত্রপাত ঘটে। ক্ষমতাহীনরা এলিট শ্রেণির সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। প্রযুক্তি বিপ্লব ঘটে। আর বিশ্ব চিরকালের জন্য বদলে যায়।
Feature Image: pinterest.com References: 01. The 10 Most Important Events of Mankind. 02. The 100 Most Important Events in Human History. 03. The 10 Most Important Events In Human History.