সেই অচেনা

4321
0

আমার আকাশটা হলো জগতের চরম হতচ্ছাড়া টাইপের একটা আকাশ। কথায় কথায় গাদা গাদা মেঘ উড়ে আসে আর অনবরত বৃষ্টি ঝরায় শুধু। বুঝ পরিচয় হবার পর থেকেই আকাশটাকে আমি শুধু দেখেছি কেবল বৃষ্টিই ঝরাতে।
.
আমার ধারনা ছিল এই কাজটি ছাড়া সে বোধ হয় আর কিছু পারেও না। একদিন হল কী,,
.
এই ছিচকাদুনে আকাশটা আমাকে চরম অবাক করে দিয়ে সকাল বেলাতেই এত সুন্দর করে সাজু গুজু করল, ঠিক যেন
শরতের নির্মল আকাশটা! চুপ করে এসে একা বসে বসে রইলাম আমার আকাশটার নীচে। মনে মনে পুরাই টাস্কিত, ভাবতেছি ঘটনাটা কী!
.
কতক্ষন এভাবে বসে ছিলাম
জানি না।
হঠাৎ দেখলাম…
.
ঠিক বরাবর সামনে আকাশের দূর দিগন্তে একটা ছোট্ট পাখি! ধীরে ধীরে অচেনা পাখিটি উড়ে আসছে আমার আকাশের দিকেই! উত্তেজনায় আমার হৃৎপিন্ড লাফিয়ে উঠলো, কারণ আমার আকাশে আজ পর্যন্ত কোন পাখি-টাখি আসতে দেখিনি।
.
এইই প্রথম! একেবারে আমার মাথার উপরে চলে এল পাখীটি। শুভ্র সাদা গায়ের পালক, কী সুন্দর বাঁকানো ঠোঁট আর লাল টুকটুকে পা, আলতা মেখে এসেছে যেন।
.
আমি হাত নাড়লাম। মনে পড়ল ইংরেজী পাঠ্য বইতে পড়েছিলাম ‘এ্যালবাট্রস’ পাখির কথা। পাখিটিকে ডাকলাম, এই পাখি এসো! তোমার কী ক্ষিধে পেয়েছে?
কিছু খাবে? স্পস্ট দেখলাম দুর থেকে আমার কথা শুনে পাখিটা একটু হাসলো যেন।
.
কিছু বলল না, তবে গ্লাইড করে মাটির কাছাকাছি নেমে এল অনেকটাই। আমাকে ঘিরে চক্কর মারলো কয়েকবার। যেন বুঝতে চাইছে এইটা আবার কোন জীব?
.
আমাকে ডাকে কেন?
.
আমার পকেটে ক্যাডবেরী ছিল কয়েকটা। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে বের করে বাড়িয়ে ধরলাম ওটার দিকে। হাতে বাড়িয়ে দেয়া খাবার দেখেই কীনা কে জানে, আস্তে করে আমার সামনে এসে স্কিড করে ল্যান্ড করল ওটা।
.
এবার ভালো করে দেখলাম পাখিটাকে, এত স্নিগ্ধতা আর লাবন্য মাখা এরকম অপরুপ পাখি আমি আমার জীবনে দেখিনি! মাটিতে নেমে যদিও প্রথম একটু ভয় ভয় ভাব ছিলো ওর মধ্যে, এখন
আমার বন্ধুত্বপূর্ণ চাহুনি দেখে সেই ভাবটা উধাও হয়ে গেছে। এখন তাকে বেশ সপ্রভিত দেখাচ্ছে। বেশ কৈতুহল নিয়ে
গুটিগুটি পায়ে সরে আসলো আমার খুব কাছে।
.
আমি হাতের ক্যান্ডিটা খুলে দিতেই আলতো করে মুখে নিলো। বললাম, পানি চাইলে কিন্তু পাবে না, সাথে পানি আনা হয়নি। অপার্থিব একটি সুরে ডেকে উঠল পাখিটি! ডানা ঝাপটাল, তারপর সোজা আমার কাধে এসে বসল। বুঝলাম আমরা বন্ধু হয়ে গেছি এখন!
.
তারপর??
.
তারপর কত কথা, কত গল্প, হাসি, গান নাচ আর পাগলামী দুজনের! ছোঁয়াছুয়ি খেললাম, ও উড়ে সামনে চলে যায়, আমি দৌড়ে তাকে ছুঁয়ে দেই। আবার আমি
দৌড়াই ও আমাকে ছোঁয়। বেশীরভাগ ওই জিতল।
.
খানিক পর ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে রইলাম। ও আমার কাঁধের ওপর বসে বসে
গান শোনাল, একের পর এক। সময়টা যে কীভাবে কোন ফাঁকে চলে গিয়েছিল সেদিন বুঝতেই পারিনি।
.
সন্ধ্যা হয়ে গেল। ওর ছটফটানি দেখে বুঝলাম চলে যাবার সময় হয়েছে । বললাম কাল আসবে আবার? নিশ্চুপ, কিছু বলছে না।
.
ডাকলোও না একবার। বুঝলাম মন খারাপ করেছে। হেসে বললাম, মন খারাপের কী আছে বোকা? সন্ধ্যা হয়ে
আসছে, গেলে তাড়াতাড়ি যাও, রাত নেমে গেলে আর পথ দেখবে না। পাখিটা কী বুঝলো কে জানে, আমার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে রাখলো কিছুক্ষন। তারপর উড়াল দিল আকাশে।
.
আমার মাথার ওপর চক্কর কাটতে লাগলো। যেন যেতে চাইছে না। আমি হাত নাড়তে থাকলাম। একটু পর নিতান্ত অনিচ্ছায় শেষ একটা রাউন্ড দিয়ে ডানা দুটি মেলে দিলো দিগন্তের দিকে। আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল দিগন্তে। যতক্ষন দেখা যায় চেয়ে থাকলাম অপলক।
.
***
.
গায়ে বৃষ্টি পড়তেই হঠাৎ হুশ হলো!
আমার আকাশ এখন আবার কান্না করার নতুন উপলক্ষ পেয়ে গেছে। আকাশকে বললাম, ‘এই তুই কথায় কথায় এমন কাঁদিস কেন বলতো?’
.
আকাশ আরো জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘পাখিটার শেষ কথা তুমি বোঝনি। ও পথ ভুলে এদিকে চলে এসেছিল, আর কোনদিন আসবে না।’
.
আমি বিশ্বাস করলাম না। বললাম তুমি মিথ্যে বলছো। যেই পাখি স্বেচ্ছায় আমার আকাশে এসেছিল, সে আমার ভালবাসা ও যত্ন পাওয়ার পরও কেন চিরদিনের জন্য আমাকে ছেড়ে যাবে? হয়তো কোনো ঝামেলা হয়েছে বলে সাময়িক ভাবে আসতে পারছে না। আমি জানি সে আবার আমার আকাশে উড়তে আসবে। সে অবশ্যই আসবে।
.
কিন্তু অনেকদিন পর আবার সেদিন আকাশটা সারারাতই কেঁদে কেঁদে আমার বুকটা স্যাঁতস্যাতে করে দিল। তার পরদিন থেকে এই আজ পর্যন্ত আমার আকাশের নীচে বসে কতদিন, কত রাত, কত বছর যাবৎ আমি অপেক্ষা করছি বলতে পারবো না। অচেনা পাখিটি তার বর্ণীল মুগ্ধতা ছড়িয়ে সেই যে চলে গেছে, আর আসেনি।
.
কেবলি মনে হয়, এইতো একটু আগেইতো চলে গেল পাখিটি। রাত পার হলে কাল সকাল হবে তবেই না আসবে সে।
.
একের পর এক দিন যায়, আমার আকাশে সেই অপেক্ষা অবসানের সকাল আর হয় না। আচ্ছা, পাখিগুলো কি সত্যিই এমন নিষ্ঠুর হয়? ওদের মায়াময় মুখ আর চিত্রকল্পের মত চোখ দেখে তো তা মনে হয় না। যদি সত্যিই নিষ্ঠুর হয়, তাহলে কি তারা এভাবেই মুগ্ধতার ফোয়ারা সৃষ্টি করে আবার পরে সেখানটায় নোনা জলের অস্তিত্ব গেড়ে দেয়?
.
সারাদিন আর সারারাত আমার আকাশের নীচে বসে তার কান্নার জলে ভিজে ভিজে অপেক্ষা করি পাখিটির জন্য। আর প্রতিদিন সকাল হবার সময় হলে সেদিন যে দিগন্তে মিলিয়ে গিয়েছিল সে, ঠিক সেদিকের দিগন্ত থেকে স্নিগ্ধ আর লাবন্যময় অপার্থিব একটা আলো ফুটে ওঠে শুধু।
.
আমি ভোরের অন্ধকারে বসে, আকাশের অশ্রুতে ভিজতে ভিজতে সেই আলোকচ্ছটার দিকে হা করে তাকিয়ে
থাকি আর তাকে খুঁজি। কিন্তু সে তার ঐ মায়াময় মুখটি নিয়ে আর ফিরে আসে না।
.
***
.
প্রতিদিনকার মত সেদিনও আমার আকাশে সকাল হল। আর আমি পাখিটির আশায় দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, কিছুটা নোনা পানি আমার ঠোঁট বেয়ে মুখে এসে গেল।
.
হঠাৎ দেখলাম, দূর দিগন্তে ডানা ঝাপটিয়ে একটি পাখি আমার ছিচকাদুনে আকাশের একটি অংশ রঙিন করে ফেলেছে! আমার বুকের ভেতরটা লাফিয়ে ওঠলো। চোখে ভরা বিস্ময়! আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে তিরস্কারের হাসি হাসলাম। আকাশের কথা ভুল হয়ে, আমার বিশ্বাস সত্যি হয়েছে। অনেক অপেক্ষা আর কষ্টের পর সে আবার আমার আকাশে এসেছে।
.
নিয়ে এসেছে ভালবাসায় রাঙানো পাখভর্তি পালক। সত্যিকারের ভালবাসা কখনো হারিয়ে যায় না। সকল বাঁধা ও অসম্ভবকে পেরিয়ে, একসময় ঠিকই ফিরে আসে। আমি আকাশকে কটাক্ষ করে বললাম, ‘দেখলে তো, আমার পাখিটি নিষ্ঠুর নয়।’
.
আমি সেই অচেনা পাখিটিকে আপন করে পেতে যাচ্ছি। যেন আমার আকাশের অনবরত বৃষ্টি থামার, স্যাঁতস্যাতে বুকটি শুকনো হওয়ার, আর ছন্নছাড়া অপেক্ষাগুলো অবসানের স্পষ্ট ইঙ্গিত পেলাম।
.
(সমাপ্ত)

লিখেছেনঃ মাহমুদুল হাসান