রতন পাগলা চেঁচামিচি শুরু করলেই মতিন চাচা বাড়ির গেট খুলে বের হয়ে আসতেন।
– পাগলাটার অইসে কি হ্যাঁ! ভরদুপুরে মাইনষেরে ঘুমাইতেও দিব না নাকি? অই হারামজাদা রতইন্যা। ভাগ এইহান থিকা!!
রতন পাগলার চেঁচামিচির বাতিক ছিল। মিমি আপাদের দোতলা বাড়ির গেটে ঢোকার মুখে বারমাস একটা লাল স্যুয়েটার পড়ে শুয়ে থাকা রতন আজানের আগে পাড়ার কুকুরগুলোর সাথে হই তুলে চেঁচাত। লালু মেম্বার নির্বাচনের আগে মহল্লায় ভোট চাইতে এলেও রতন চিৎকার করত ” ভাইঙালাইব। ভাইঙালাইব। শুয়ারের বাচ্চাডা সব ভাইঙালাইব। ” মেম্বারের সাঙপাঙদের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে আবার গুটিশুটি মেরে পড়ে থাকতে চেঁচামিচি বন্ধ হত কয়েকদিনের জন্য। তারপর আবার আগের মত।
রতন পাগলা যখন পড়ে পড়ে মার খেত আমরা তখন নেহায়েত শিশু। শিশুদের এত কিছু বুঝতে নেই।
সবথেকে শক্তিশালী আয়না নাকি মানুষের চোখ। রতন পাগলার চোখের আয়নায় যা ধরা পড়ত, তা সহজেই আমাদের চোখে ধরা পড়ত না। কিংবা হয়ত ধরা পড়লেও সহসাই এড়িয়ে যেতে হত।বড়রা শিখিয়েছিলেন সবকিছু দেখেই চিৎকার করে উঠতে নেই। অসংখ্য নেই এর বেড়াজালে একদিন আমরা প্রতিবাদ করতেও ভুলে গেলাম।
লালু মেম্বার নির্বাচনে উঠে যাবার পর যেদিন পাড়ার মাঠে কমিউনিটি সেন্টারের ভিত গাড়ার প্রথম শাবল চালানো হল, সেদিন পিকলু হুহু করে কেঁদে উঠেছিল। মাঠ ছেড়ে মিমি আপাদের বাড়ির গলিতে ক্রিকেট খেলতে খেলতে রতন পাগলার গলায় আমরাও দাঁতমুখ খিঁচিয়ে গালি দিতাম ” শুয়ারের বাচ্চা “। হাজিবাড়ির সামনের রাস্তায় বর্ষার একহাঁটু পানি জমে থাকতে জমির চাচাও বলতেন ” গজব পড়ব “। খালি নামটা উচ্চারণ করার সাহস আমাদের ছিল না। রতন পাগলার ছিল। পাড়ার মোড়ে কদম গাছটার তলায় বসে সে সবাইকে গালি দিতে পারত। লালু মেম্বারকেও।
মফস্বল শহরের পাড়ায় নতুন কিছু হবার যো নেই। রতন পাগলার চিৎকারের মতই নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল বছর বছর লালু মেম্বারের ভোটে উঠে যাওয়া, জমির চাচার আরেকটা হজ্জ্ব, মিমি আপার বিয়ে করতে না চাওয়া, বড়দের ফিসফিসানি। এর মধ্যেই আমরা বড় হয়ে গেলাম।
ক্রিকেট বলে টেপ পেঁচানোর টাকা চাইতে মিমি আপার কাছে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। পাশের বাড়ির রোকনরা একদিন পাড়া ছেড়ে চলে গেলে গলা জড়িয়ে কাঁদলাম। জমির চাচা আরেকটা হজ্জ্ব করার আগেই মসজিদের পাশে বাবলা গাছতলায় একটা কবর বেড়ে গেল। কোন এক বিকেলে পিকলুর সাথে হিন্দু পাড়ার মানসীর প্রেমের খবর পাড়ার বাতাসে ভেসে বেড়াতেই মিমি আপা ডেকে একগাদা জ্ঞান দিয়ে দিলেন, ” ভালোবাসা জিনিসিটায় অনেক কষ্ট, বুঝলি বাবু। সহজেই কাউকে ভালোবেসে ফেলিস না। অযথাই কষ্ট পাবি। তোদের কি এখনো কষ্ট পাওয়ার বয়স হয়েছে, বল? ” ওবাড়ির নিলুকে দেখে একটু একটু মন ক্যামন করার কথা মিমি আপাকে আর বলা হল না।এত কিছুর মধ্যে কেবল মিমি আপার ” বাবু ” ডাকটা আগের মত ছিল।
ক্যাডেট কলেজে চলে যাবার পর ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যেতে লাগল শৈশবের স্মৃতি। কোন এক ভ্যাকেশনে বাড়ি ফিরে শুনি পাড়ার অবস্থা গরম। তার দুদিন পরের এক শ্রাবণের বিকেলে কে বা কারা রতন পাগলাকে মেরে কদম গাছের তলায় ফেলে রেখে গেল। খোলা চোখে তাবত অরাজকতার প্রতিচ্ছবি নিয়ে লাশ পড়ে থাকল দু’দিন। বাবা বলে দিলেন ওদিকে যাওয়া বারণ। বাতাসে খবর ভাসে, কিছু একটা দেখে ফেলেছিল রতন। মতিন চাচা চোখের পানি ফেলে বললেন, “পোলাটার জীবনটাই এবার নিয়া গেল শুয়ারগুলা।” মর্মার্থ জিজ্ঞেস করতে গামছায় মুখ ঢেকে কাঁদলেন। পিকলু বড্ড আক্ষেপ করে বলল, হুদাই পাগলারে ঢেলাইতাম রে। মিমি আপা শুধু একদিন ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ” রতনটার কবর হয়েছে বাবু? ” আমি জানতাম। জেনেও কেন যেন বলিনি।দুদিন পর সবাই ভুলে গেলাম।
মিজান মামার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে “একটা চা, কড়া লিকার, ফেরেশ পাত্তি”র অর্ডার শুনে আর কেউ হাসত না।রমজান মাসের কোন বিকেলে মিমি আপাও আর ডেকে বলতেন না, ” ইফতারির প্লেটটা রতনকে দিয়ে আয় তো।”
শাহপাড়া নিজের মত চলতে লাগল। শুধু মতিন চাচা আর গালাগালি করার কাউকে পেলেন নানা।আইবুড়ো অপবাদ নিয়ে বেঁচে থাকতে থাকতে বিরক্ত মিমি আপা স্কুলে চাকুরী নিয়ে চলে গেলেন অন্য কোথাও। বহুদিন পর আবার কেউ চলে গেল বলে বুকের বাম পাশে চিনচিন করে উঠল।
বহু বছর পর, শিবলু ভাইরা যেখানে আড্ডা দিত, সেখানে পিকলুরা চলে এল। ভ্যাকেশনে বাড়ি ফিরে আড্ডা দেয়া হত ওখানে। ছুটিছাটায় মিমি আপা এলে দোতলা বাড়ির ছাদে গানের আসর বসত। মাঝে মাঝে মিমি আপাকে দেখতাম কদম গাছের নিচে আনমনে পায়চারি করতে। তখন মাথার উপরে অনেক নক্ষত্রের রাত।
অনেক দোলাচলের দিনরাতের ভিড়ে বিশ্বকাপ চলে এল। পাড়ার দেয়ালে দেয়ালে পতাকা আঁকানোর ধুম। মিজান মামার চায়ের দোকানের পাশের দেয়ালে দিনরাত শিরিষকাগজ ঘসে শ্যাওলা তুলে ফেলে পাড়ার পিচ্চিরা। আমরা চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতে হিসেব কষি আর্জেন্টিনার পতাকা লাগাইসে ১০ ফুট। কমসে কম ১২ ফুট পতাকা না লাগালে হচ্ছে না। পতাকা- পাঁচশ টাকার কাপড়, বক্কর খলিফার মজুরি ১০০, রঙ, তুলি ….. এর ফাঁকে পুরনো দেয়ালে শ্যাওলার নিচে চাপা পড়া একটা লেখা চোখে পড়ে ” মিলি+রতন “। চোখ কপালে তুলে মিজান মামাকে ডাক দিয়ে বলি, “মামা, পোলাপানের কাম দেখছ? কিসের সাথে কি লিখে রাখছে?
– কিসের কথা কও ভাইগনা?
– ওই যে দেয়ালে লেখা দেখনা রতন পাগলার লগে মিলি আপার নাম। এইট কোন কথা হইল মামা কও?
মামা হাসেন।
– তুমি হাসতেছ মামা? মিমি আপা তো সবাইরেই মায়া করে। রতনরে মাঝে মধ্যে খাবার দিত বলে এইসব লিখবে?
চায়ের কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে বলেন,
– ওইটা কি আর পোলাপানে লিখছে নাকি? ওইটা রতনেই লিখছিল।
– ধুর মামা! কি যে কও? সে পাগল মানুষ। লেখাপড়া জানে নাকি? সে লিখবে ওইটা?
– তোরা দেখি কিছুই জানস না। রতনে পাগলা হইল ক্যামনে এইটা জানস?
– সে তো এমনেই পাগলা।
– মানুষ কি পাগল হইয়া জম্মায় ভাইগনা?
মিজান মামা বলতে থাকেন, শাহপাড়ায় একমাত্র পোড়োবাড়ির গল্প, ডিগ্রী কলেজ পড়ুয়া এক যুবকের গল্প, যে পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে মিমি নামে এক বালিকার জন্য অপেক্ষা করত, দাঁতের ফাঁকে সিগারেট গুঁজে উদ্দাম আড্ডা দিত এ পাড়ারই মোড়ে। যুবকটির নাম রতন।
রতন পাগলা যে রকম শ্রাবণের সন্ধ্যায় কদম গাছের নিচে মরে পড়ে ছিল, সেরকম এক সন্ধ্যা আগেও এসেছে। সে সন্ধ্যার আগেও পশ্চিমের পুকুরপাড়ে পোড়োবাড়ির বদলে ছিমছাম একচালা ঘর ছিল।রতন নামের যুবকটি রাত করে বাড়ি ফিরলে রাগ করার মত এক বৃদ্ধ বাবা ছিল, ভাত বেড়ে অপেক্ষা করা মা ছিল।
মিজান মামা বলেন, ” লালু মেম্বারের বাড়িটার উপর নজর ছিল ভাইগনা। রতনের বাপরে কতবার শাসাইছে, চাচা যায় নাই কা। হেডমাস্টর আছিল। সেইরকম ত্যাজ। আমারে কইত, মরুম তাও ওই লালুর কাছে মাথা বেচুম না। পেপারে লালুর নামে কিসব লিখত। একদিন সন্ধ্যায় বুঝলা ভাইগনা, সেইরকম আগুন পশ্চিমের পুকুরপাড়ে। যাইয়া দেখি সব শ্যাষ। চাচা-চাচী কয়লা হইয়া পইড়া রইছে। রতন উথাল পাথাল কানতাছে। থানা পুলিশ করবার চাইছিল। পুলিশে মামলা নেয় নাইক্যা।তারপর একদিন লালুর লোকেরা তারে ধইরা সে কি মাইর! বাপমা, ভিটা হারানি পোলাটা মাথায় বাড়ি খায়া পাগলই হয়ে গেল। ”
মিজান মামা ঘাড়ের গামছায় চোখ মোছেন।
” মতিন চাচারে চিন না? হে রতনের বাপের বন্ধু আছিল। রতনটারে এত ভালোবাসত! ডাক্তাররে কইছিল, যা লাগে সব দিমু, রতনটারে ভাল কইরা দেন। হইল না।আর মিমিরে দেখ না! মাইয়াডা তো রতন রতন কইরা বিয়াই করল না। পরীর লাহান মাইয়া। আহা! রতনটারে সেইরম ভালোবাসত। ”
বহুদিন পর বুকের ভেতর একদলা বাতাস ঘূর্ণিপাক খেল। মিমি আপার ইফতার পাঠানো, লাল চোখে রতন পাগলার কবরের কথা জানতে চাওয়া, মাঝরাতে কদম গাছের নিচে হাঁটাহাঁটি। মতিন চাচার ডুকরে কেঁদে ওঠা, “পোলাটার জীবনটাই নিয়া গেল শুয়ারগুলা। “সব কেমন ক্যানভাসের মত! বহুদিন পর আবার মিমি আপার বাসার নিচ দিয়ে হেঁটে গেলাম। কেমন কান্নার শব্দ মিশে থাকা বাতাস!
সেই দেয়ালে পতাকা আঁকানো হলনা। ক্লান্তিহীন ভালোবাসার বেদনা বুকে নিয়ে যে স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে তাতে আঁচড় দেয়া চলে না।
শ্রাবণের সাত তারিখের আগের রাতে মিমি আপা ঠিক ফিরে এলেন। আমি জানতাম আসবেন। মেঘে ঢাকা আকাশে চাঁদ থাকা না থাকা একই কথা। গভীর রাতে মিলি আপার বাড়িতে কলিংবেল টিপলাম। সেই পরিচিত শব্দ। লাল লাল চোখ নিয়ে দরজা খুলে দিলেন মিমি আপা।
– বাবু, তুই?
– তোমার চোখ লাল কেন মিমি আপা?
– পোকা পড়েছিল রে।
আমি হাসি। পোকা। পোকাই তো। ছোটবেলায় মিমি আপা একটা কার্টুন দেখিয়েছিলেন। “গ্রেইভ অফ ফায়ারফ্লাইজ”। প্রবল বেদনায় সেদিন কেঁদেছিলাম। মিমি আপা রোজই কাঁদেন। আড়ালে। তার ভেতরে পঁচিশ বছরের বর্ষণ জমে আছে।
– আপা, এক জায়গায় যাবে আমার সাথে? ভীষণ ভয় করছে।
– কোথায়?
– আরে আসই না!
আপার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম। পশ্চিম পুকুরপাড়ের পোড়াবাড়ির ধারে রতন পাগলার লাশ পুঁতে ফেলেছিল। আমি আর পিপলু কি ভেবে দেখে ফেলেছি।
মিমি আপার হাত ধরে কদম গাছটার নিচে গেলাম। আপার হাত মুঠির ভেতর থরথর করে কাঁপছে।
– এখানে কি?
– এমনিও তো আসতে আজকে।আসতে না?
মিমি আপা নিরুত্তর।
– কোনো দিন কিছু বলনি কেন আপা?
– কি বলিনি?
– মিজান মামা সব বলেছে। কীভাবে পারো? এত বছরে অন্তত একবার হলেও তো বলতে পারতে।
পুকুরপাড় পৌঁছুতেই আপা হু হু করে কেঁদে দিলেন। শত বছরের নোনা জল দীর্ঘশ্বাস হয়ে রাত্রির বাতাসে মিশছে। আপা বলেছিলেন, ভালবাসায় অনেক দু:খ রে বাবু। এখন বুঝি কথাটা সত্যি। আমার হাতের মুঠোয় মিমি আপার অনেক বছরের জমানো দু:খ গলে গলে যাচ্ছে। আমার থামাবার ক্ষমতা থাকলে থামিয়ে দিতাম। ঈশ্বর সবাইকে সব ক্ষমতা দিয়ে পাঠান না। শ্রাবণের মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে মনে হচ্ছে কিছু ক্ষমতা না থাকাই ভাল। তাতে আমাদের অসহায়ত্বের সৌন্দর্য ঢাকা পড়ে যায়।
পুকুরপাড়ের বাতাস ভীষণরকম ভারি। সে ভারি বাতাসে মিমি আপা হাত বাড়িয়ে কাকে যেন ছুঁয়ে দিচ্ছেন। বহুদূরের কেউ। তাকে দেখার চোখ আমাদের নেই।
লিখাঃ Fahmid Mahib