১
দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন জন্মগ্রহণ করেন ১৫০৮ সালের ৬ মার্চ, কাবুল দুর্গে। সম্রাট বাবরের মৃত্যুর পর ১৫৩০ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি মুঘল সালতানাতের মসনদে বসেন। ১৫৩১ সাল থেকে ১৫৫৬ সালের মাঝে মোট ১০ বছর তিনি হিন্দুস্তানের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। মাঝখানে দীর্ঘ ১৫ বছরের বিরতি। নিজের দুর্ভাগ্য, ভাইদের শত্রুতা আর শের শাহের মতো দূরদর্শী দুর্ধর্ষ শাসকের উত্থানের জন্যই তার এই দুর্ভাগ্য।
‘হুমায়ুন’ শব্দটির অর্থ সৌভাগ্যবান। তবে, হুমায়ুন নামের এই মুঘল বাদশাহ একইসাথে সৌভাগ্যবান ছিলেন, আবার দুর্ভাগ্যবানও ছিলেন। সৌভাগ্যবান ছিলেন, কারণ তরুণ বয়সেই পিতার অধিকৃত বিশাল এক সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা হয়ে বসার সৌভাগ্য হয়েছিলো তার, যে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিলো আমু দরিয়া থেকে গঙ্গা নদী পর্যন্ত। মধ্য এশিয়ার বলখ থেকে শুরু করে বাদাখশান, কুন্দুজ, হিন্দুস্তানের পাঞ্জাব, মুলতান, বিহার, গোয়ালিয়র, ধোলপুর, চান্দেরি, বায়ানা আর বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশ তার শাসনাধীনে ছিলো।
আর, দুর্ভাগ্য এ কারণে যে, নিজের অদক্ষতা আর দুর্ভাগ্যের কারণে সেই বিশাল ভূখন্ড তার হাতছাড়া হয়ে যায়। তবে তার নামের সার্থকতা প্রমাণ করতেই যেন মৃত্যুর কয়েকমাস পূর্বে পুনরায় সেই বিশাল ভূখন্ড অধিকার করে যান। পিতার দেয়া আমানত স্ব-স্থানে রেখেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। ইতিহাসের পাতা ঘটলে এরকম ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টান্ত খুব অল্পই দেখা যায়।
২
সমসাময়িক অন্যান্য রাজতন্ত্রের মতোই নিজের শাসনামলে শাসন ব্যবস্থার মূলে ছিলেন সম্রাট স্বয়ং নিজেই। সাম্রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তার কথাই ছিলো শেষ কথা। তবে, নির্বাসিত হওয়ার পর পারস্য থেকে ফিরে ভাইদের পরাজিত করেও বারবার ক্ষমা করে দেয়ায় সম্রাটের আমিররা সম্রাটের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছিলো। তারা সম্রাটের কাছ থেকে ভাইদের ক্ষমা না করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন। এই একটিমাত্র বিষয়ে সম্রাটকে তার আমিরদের সাথে আপোষ করতে হয়েছিলো।
শাসক হওয়ার ব্যাপারটিকে সম্রাট হুমায়ুন স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে তার মূল দায়িত্ব হলো সালতানাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আর জনগণের জান-মাল রক্ষার ব্যবস্থা করা, তাদের মাঝে ন্যায় বিচার করা আর তাদের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হওয়া।
সাম্রাজ্য ও নিজের মসনদ টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে প্রাচীন ও মধ্যযুগে ব্যক্তিগতভাবে সম্রাটদের সামরিক দক্ষতা থাকা আবশ্যক ছিলো। খুঁজলে যে দু’য়েকটা ব্যতিক্রম পাওয়া যাবে না তা না, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্রাটরা দক্ষ যোদ্ধা হতেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধপরিচালনা করতেন। সেই ধারাবাহিকতায় সম্রাট হুমায়ুনও ব্যতিক্রম ছিলেন না।
তিনি নিজে একজন উচ্চস্তরের যোদ্ধা ছিলেন। পিতা বাবুরের সাথে সশরীরে বেশ কিছু যুদ্ধে তিনি উপস্থিত ছিলেন। তাছাড়া, পানিপথ আর খানুয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ও ভাগ্য নির্ধারণী দুটি যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং সামরিক অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এই দুটি যুদ্ধে তার সাহসিকতা ও বীরত্ব চোখে পড়ার মতো ছিলো।
কিন্তু, সমস্যা হলো, যেমনটা দুর্ধর্ষ তিনি হবেন ভাবা হয়েছিলো, পরবর্তী জীবনে তিনি তার ছাপ রাখতে পারেননি। সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন খুবই নম্র, ভদ্র আর শান্তিপ্রিয় মানুষ। সম্ভবত যুদ্ধের চরম ভয়াবহতা সহ্য করার মতো মানসিক দৃঢ়টা তার ছিলো না। ফলে সম্রাট বাবুরের মৃত্যুর পর যখন তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের হাল ধরলেন, তখন থেকেই তিনি এমন কোনো অর্জন নিজের নামের পাশে যোগ করতে পারেননি, যা মুঘলদের স্বভাবজাত তেজকে প্রকাশ করতে পারে।
গুজরাটে বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে তিনি সাময়িক জয় পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু বাহাদুর শাহের সাথে তার কোনো পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়নি। আবার, গুজরাট জয় করতে পারলেও নিজের দোষেই তা খুইয়ে বসেছিলেন তিনি, যা মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য এক লজ্জাজনক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
আবার, বাংলা অভিযানে শুরুতে সফলতা পেলেও শেষ পর্যন্ত শের শাহ তাকে নাকানিচুবানি খাইয়ে দিল্লি ছাড়া করেছিলেন। বার বার শের শাহ সম্পর্কে সতর্ক করার পরও তিনি তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন। ফলশ্রুতিতে পিতৃপ্রদত্ত সাম্রাজ্যটিই হারিয়ে ১৫ বছর পথে পথে ঘুরতে বাধ্য হন তিনি।
৩
সম্রাট হুমায়ুনের মূল সমস্যা ছিলো, তিনি শত্রু-মিত্রের পার্থক্য সহজে বুঝতে পারতেন না। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর মনের ভেতরটা পড়তে জানতেন না, তাদের সামরিক শক্তি ও কৌশল ধরতে পারতেন না। আবার ধরতে পারলেও উপযুক্ত মূল্যায়ন করতে পারতেন না। যুদ্ধক্ষেত্রে মুহূর্তের মাঝেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা যেকোনো সংকটময় মুহূর্তেও ফল ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম। সম্রাট হুমায়ুন এদিক দিয়ে শুধু ব্যর্থই ছিলেন না, বরং সংকটময় মুহূর্তে তিনি যে সিদ্ধান্তই নিতেন, প্রায় সময়ই তা তার প্রতিকূলে চলে যেত।
কঠিন বাস্তবতা থেকে দূরে থাকতে তিনি আমোদ-প্রমোদ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তার এই আমোদ-প্রমোদ তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেও বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়াতে জারি রেখেছিলেন। বাংলা বিজয়ের পর উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেই আমোদ-প্রমোদে ডুবে থাকার বিষয়টি একপর্যায়ে তাকেই ডুবিয়ে দেয়।
সম্রাট হুমায়ুন একাকী থাকতে পছন্দ করতেন। জরুরি মুহূর্তে জেনারেলরা তার সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হতেন। হুমায়ুনের এই বদঅভ্যাসের কথা তার পিতা বাবুর জানতেন। তিনি একাধিকবার তাকে এই বলে সতর্কও করেছেন যে, ‘একান্তবাস বা অলস জীবন বাদশাহদের জন্য নয়।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা!
তবে আশার বিষয় হলো, নির্বাসনের পর বাস্তবতার কঠিন আঘাতে তার ভেতরে কিছুটা পরিবর্তন এসেছিলো। তার ভেতরে বিচক্ষণতা আর উদ্দ্যমের আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো।
সম্রাট হুমায়ুনের সবচেয়ে বড় অস্ত্রটি ছিলো অসীম সাহসিকতা। চরম বিপদের দিনে যখন আত্মীয়-স্বজন, আমির, জেনারেল আর সৈনিকেরাও তাকে ত্যাগ করা শুরু করলো, তখনও তিনি সাহস হারাননি। আল্লাহর উপর ভরসা করে তিনি তার আপন লক্ষ্য খুঁজে নিয়েছিলেন।
৪
হিন্দুস্তানীয় ঐতিহ্যে মুসলিম সালতানাতগুলোতে প্রধানমন্ত্রী বা উজিরের বিশেষ একটি মর্যাদা সবসময়ই থাকতো। মূলত সালতানাতে সম্রাটের পর পরই উজিরের মর্যাদা থাকতো। উজির পদধারী ব্যক্তির দায়িত্ব ছিলো ব্যাপক। সাম্রাজ্যের প্রতিটি বিভাগ তাকে তদারকি করতে হতো, বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্বও তারই উপর বর্তাতো। এমনকি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ, সেনা ভর্তি, পদোন্নতি ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও অনেকাংশেই উজিরের নিয়ন্ত্রণে থাকতো। তাছাড়া, যুদ্ধক্ষেত্রেও উজিরকে যথেষ্ট পারদর্শী হতে হতো। সম্রাট হুমায়ুনের শাসনামলের প্রথমদিকে উজিরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন আমির ওয়াইস মুহাম্মদ ও তার পরে হিন্দু বেগ।
পারস্য থেকে কাবুলে ফেরার পথে এই দায়িত্ব পান করাচা খান। আর, পারস্য থেকে ফিরে হিন্দুস্তান বিজয়ের সময় উজিরের মর্যাদা নিয়ে বৈরাম খান আর শাহ আবুল মালীর মধ্যে অঘোষিত যে বিদ্বেষ দানা বাঁধছিল, সম্রাটের হঠাৎ মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে তা আর হালে পানি পায়নি।
৫
নানা প্রতিকূলতা স্বত্ত্বেও প্রশাসনিক সংস্কার ও আধুনিকায়নের জন্য শাসক হিসেবে সম্রাট হুমায়ুন বেশ দীর্ঘ সময় পেয়েছিলেন। তার প্রথম শাসনকাল প্রায় ৯ বছরেরও বেশি দীর্ঘ ছিলো। কিন্তু এত লম্বা সময় পেয়েও সম্রাট হুমায়ুন প্রশাসন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কিংবা সামরিক কোনো ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য কোনো সংস্কার বা পরিবর্তন আনেননি। ভূমি ব্যবস্থাপনা, কর নীতিসহ পুরো শাসন ব্যবস্থা মূলত সুলতানী আমলের অনুকরণেই চলতো। কাজেই এসব বিষয়ে সম্রাট হুমায়ুনের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু নেই। তবে কিছু ক্ষেত্রে তিনি নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত ও বলতে গেলে একপ্রকার খামখেয়ালীপনা থেকে কিছু সংস্কার করেছিলেন। কিছু ক্ষেত্রে এসব সংস্কার প্রয়োজনীয় ছিলো, আবার কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়।
সম্রাট হুমায়ুন তার আমির আর কর্মচারীদের মোট তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিলেন। প্রতি বিভাগের লোকজন সপ্তাহে দুদিন করে সম্রাটের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারতেন।
প্রথমভাগে ছিলেন ‘আহলে দৌলত’ শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিরা। সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা, দক্ষতার সাথে প্রশাসন পরিচালনা মূলত এই শ্রেণীরই দায়িত্ব ছিলো। এই শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত ছিলেন সম্রাটের উজির, আমির, আত্মীয়রা, সেই সাথে অবশ্যই সেনাবাহিনী। এই শ্রেণী তাদের মেধা, দক্ষতা আর বীরত্ব দিয়ে সম্রাট আর সাম্রাজ্যের সেবা করে যেতেন।
দ্বিতীয় ভাগে ছিলেন ‘আহলে সআদত’ শ্রেণীভুক্তরা। ইসলামী ব্যক্তিত্বরা, জ্ঞানী-গুণি পন্ডিতরা আর কবি-দার্শনিকরা এই শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। আর, তৃতীয় ‘আহলে মুরাদ’ শ্রেণীর অন্তর্ভূক্তরা মূলত বিনোদন প্রদানকারী শ্রেণীর ছিলো।
এই তিন শ্রেণীর প্রত্যেকটির জন্য আবার একজন করে তত্বাবধায়ক নিযুক্ত থাকতেন। ‘আহলে দৌলত’ শ্রেনীর তত্বাবধায়ক ছিলেন আমির হিন্দু বেগ। আমিরদের নিয়ন্ত্রণ, সৈন্য ভর্তি, তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ ও পরিশোধ করা তার দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। আহলে সআদত বিভাগের দায়িত্ব ছিলো মাওলানা মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ ফরগরীর নিকট। জনসাধারণের সাথে যোগাযোগ রাখা, তাদের ছোটখাট দাবী-দাওয়া পূরণ করা, আলেমদের নিয়োগ ও তাদের সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব ছিলো এই বিভাগের। আর আমির মুহাম্মদ ওয়াইসের দায়িত্ব ছিলো আহলে মুরাদ শ্রেণীর দেখাশোনা করা, তাদের সমস্যা সমাধান ও বেতন-ভাতা পরিশোধ করা। প্রত্যেক শ্রেণীর এই তত্ত্বাবধায়কদের স্বর্ণের তৈরি বিশেষ ‘বাণ’ বা ‘পরিচয়পত্র’ দেয়া হতো।
সম্রাটের এই শ্রেণী বিভাজন নীতির আসলে কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিলো না। প্রায়ই দেখা যেতো এই শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী একই ব্যক্তি একাধিক শ্রেণীতে আসন পাওয়ার যোগ্য হয়ে যান। যেমন, আহলে দৌলত শ্রেণীভূক্তরা মূলত সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হতেন। কিন্তু, প্রায়ই দেখা যেত তারা বেশ উঁচু মাপের সাহিত্যিক, কবি বা দার্শনিকও। সেক্ষেত্রে একইসাথে এক ব্যক্তিকে দুটি শ্রেণীতে জায়গা দিতে হচ্ছে। তাছাড়া, মূল কথা হলো, এ ধরনের অপ্রয়োজনী শ্রেণীবিভাগ সাম্রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো কাজেই আসেনি। তাই এই শ্রেণী বিভাজনকে সম্রাট হুমায়ুনের রাজত্বকালেও কখনোই গুরুত্ব দিয়ে মানা হয়নি।
৬
সম্রাট হুমায়ুন শাসনকার্য পরিচালনার জন্য চারটি বিভাগ প্রচলন করেছিলেন। বিভাগগুলো যথাক্রমে আতশী (অগ্নি), হাওয়াই (বাতাস), আবী (পানি) এবং খাকী (মাটি)। প্রতিটি বিভাগের জন্যই একজন করে মন্ত্রী নিযুক্ত থাকতেন। সংশিষ্ট বিভাগের সমস্ত কার্যাবলী সুষ্ঠভাবে সম্পাদন করাই তাদের দায়িত্ব ছিলো।
অস্ত্রশস্ত্র তৈরি, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিশেষত কামান তৈরি ও এর রক্ষণাবেক্ষণ- মোটকথা যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছুই এই বিভাগের অধীনে ছিলো। সম্রাটের এই বিভাগের মন্ত্রী ছিলেন ইমাদুল মুলক।
সম্রাটের পোষাক-পরিচ্ছদ, রসুইঘর আর পশুশালা দেখাশোনার দায়িত্ব ছিলো হাওয়াই বিভাগের। এই বিভাগের দেখাশোনা করতেন লুতফুল্লাহ। আবী বা পানী সরবরাহ বিভাগের দায়িত্ব ছিলো সম্রাটের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহসহ সমগ্র সাম্রাজ্যে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। খ্বাজা হুসেন এই বিভাগের দায়িত্ব পালন করতেন। আর খাকী বিভাগের দায়িত্ব ছিলো ব্যাপক। সমগ্র সাম্রাজ্যের ভূমি জরিপ, কৃষি ভূমির পরিমাণ নির্ণয়, খাস জমি আর রাজকোষের দেখাশোনা এই বিভাগের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। জামাল উদ্দিন মির্জা বেগ এই বিভাগের দেখাশোনা করতেন।
এই চার বিভাগের কাজের তদারকির জন্য একজন সমন্বয়কও নির্ধারিত থাকতো। সম্রাট হুমায়ুনের সময় এই সমন্বয়কের দায়িত্ব পেয়েছিলেন আমির ওয়াইস মুহাম্মদ।
সম্রাট হুমায়ুনের এই ধরনের শ্রেণীবিভাগ ছিলো নিতান্তই অপ্রয়োজনী, কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিকর, সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও বাস্তবতা বিরোধী। এই শ্রেণীবিভাগে কখনো কখনো একই বিভাগের লোকজন একাধিক শ্রেণীতে কাজ করতেন। আবার ‘আহলে মুরাদ’ শ্রেণীর তত্ত্বাবধায়ক আমির ওয়াইস মুহাম্মদ এই চার বিভাগের সমন্বয়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রায়ই সময় ‘আহলে মুরাদ’ বা ‘এন্টারটেইনার’ শ্রেণী কৃষি, অস্ত্রাগার থেকে শুরু করে এমনকি প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে শুরু করলো।
রাজকর্মচারীদের আবার ভিন্ন ভিন্ন ১২টি শ্রেণীতে ভাগ করা হতো এবং প্রত্যেক শ্রেণীর অন্তর্ভূক্তদের আলাদা আলাদা ‘বাণ’ বা পরিচয়পত্র দেয়া থাকতো। শ্রেণীগুলো ১ থেকে ১২ পর্যন্ত এভাবেই ভাগ করা হতো। প্রথম শ্রেণী ছিলো সর্বনিম্ন মর্যাদাধারীর ও দ্বাদশ শ্রেণী ছিলো সর্বোচ্চ মর্যাদাধারীর।
দ্বাররক্ষী ও পশু দেখাশোনাকারীরা প্রথম শ্রেণীভূক্ত, নিম্নশ্রেণীর সেবকেরা দ্বিতীয় শ্রেণীভূক্ত, সাধারণ সৈনিকেরা তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত, কোষাধ্যক্ষ চতুর্থ শ্রেণীভূক্ত, যুবক যোদ্ধারা পঞ্চম শ্রেণীভূক্ত, আফগান ও উজবেক সেনাপতিরা ষষ্ঠ শ্রেণীভূক্ত, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সপ্তম শ্রেণীভূক্ত, দরবারের বিশেষ কর্মচারীরা অষ্টম শ্রেণীভূক্ত, আমিররা নবম শ্রেণীভূক্ত, ইসলামী ব্যক্তিত্ত্ব, জ্ঞানী-গুণি মানুষজন ও অন্যান্য ধর্মীয় ব্যক্তিত্ত্বরা দশম শ্রেণীর ও সম্রাটের আত্মীয়-স্বজনেরা পেতেন একাদশ শ্রেণীর বাণ বা পরিচয়পত্র। আর স্বয়ং সম্রাট ধারণ করতেন দ্বাদশ শ্রেণীর বাণ।
কোনো বিশেষ তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত না হলেও এই শ্রেণী বিভাজনের লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ত্বরা সম্রাট ও তার আত্মীয়-স্বজনের পরেই সর্বোচ্চ মর্যাদাধারী ছিলেন। আবার এই শ্রেণী বিভাজনে এমন লোকেরও অবস্থান ছিলো, যাদের কোনো শ্রেণীতেই ফেলা যেত না।
৭
সম্রাট হুমায়ুন সপ্তাহের সাত দিন সাত শ্রেণীর লোকদের জন্য বরাদ্দ রাখতেন। নির্ধারিত দিনে নির্ধারিত শ্রেণীর লোক ছাড়া অন্য কারও সাথে দেখা করতেন না। যেমন, সামরিক লোকদের সাথে দেখা করার জন্য নির্ধারিত দিনে তিনি অন্য কোনো শ্রেণীর সাথে দেখা করতেন না, আবার বেসামরিক লোকদের জন্য নির্ধারিত দিনে সামরিক শ্রেণীর সাথে দেখা করতেন না। এভাবেই একেক দিন একেক শ্রেণীর মানুষের সাথে দেখা করার জন্য নির্ধারিত করা থাকতো, যা রীতিমত হাস্যকর ও বাস্তবতা বিরোধী।
সপ্তাহের এই সাতদিনের একেক দিনে সম্রাট আবার একেক বর্ণের পোষাক পরিধান করতেন। যেমন: শনিবারে পরিধান করতেন কালো রঙের পোষাক, রবিবারে পীত বর্ণ, সোমবার সাদা, মঙ্গলবার রক্ত লাল, বুধবার ধূসর, বৃহস্পতিবার নীল ও শুক্রবার সাদা রঙের পোষাক।
সম্রাট হুমায়ুনের দরবারে ন্যায়বিচার প্রত্যাশীরা যেকোনো সময় প্রবেশ করতে পারতো। সম্রাট ন্যায় বিচার প্রত্যাশীদের জন্য দরবারের পাশেই একটি বড় তবলা রাখার আদেশ জারি করেন। এই তবলাকে ‘তবল-ই-আদিল’ বা ‘ন্যায়ের তবলা’ বলা হতো। নিজের উপর অবিচার হচ্ছে মনে হলে যে কেউই এসে এই তবলা বাজাতে পারতো।
এই তবলা বাজানোর আবার নির্দিষ্ট নিয়ম ছিলো। সাধারণ অভিযোগ হলে তবলা একবার বাজাতে হতো, বেতন না পেলে দুবার, সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ হলে তিনবার আর খুনোখুনির অভিযোগে চারবার তবলা বাজানোর নিয়ম ছিলো। সম্রাট হিসেবে তিনি আর যা-ই করুন না কেন, সবসময় চেষ্টা করতেন ন্যায় বিচার করতে।
৮
সম্রাট হুমায়ুনের শাসনামলে সাম্রাজ্যের পুরো ভূখন্ড মোট চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা ছিলো। খালসা ভূমি বা সরকারি জমি, জায়গীর ভূমি যা আমিরদের দেয়া হয়েছে, সয়ূরগাল ভূমি যা জ্ঞানী ও ধার্মিক ব্যক্তিদের দান করা হয়েছে ও জমিদারশ্রেণীর অধিকারে থাকা ভূমি। অবশ্য ভূমির এ শ্রেণী সম্রাট হুমায়ুন নিজে করেননি, সম্রাট বাবরের সময় থেকেই এ ধরনের শ্রেণী বিভাজন চলে আসছিলো।
আগেই বলা হয়েছে, প্রথম শাসনামলে সম্রাট হুমায়ুন শাসন ব্যবস্থায় এমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেননি, যা শাসক হিসেবে তাকে অনন্য করে তুলবে। তবে, দীর্ঘ নির্বাসন জীবন আর বাস্তবতার ধাক্কায় তার ভেতরে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছিলো। আবুল ফজলের ভাষ্যমতে, দ্বিতীয় শাসনামলে সম্রাট পুরো সাম্রাজ্য নতুন করে গুছিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। লাহোর, দিল্লি, আগ্রা, জৌনপুর, মান্ডু আর কনৌজসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে কেন্দ্র করে তিনি পুরো সাম্রাজ্যের প্রশাসন ব্যবস্থাকে সাজাতে চাচ্ছিলেন। এ স্থানগুলোতে তিনি শক্তিশালী সেনাঘাঁটিও করতে চাচ্ছিলেন।
নিজের সাথে সবসময়ের জন্য ১২,০০০ সৈন্যের দুর্ধর্ষ একটি সেনাবাহিনী রাখার ইচ্ছাও তার ছিলো। কিন্তু, আল্লাহর ইচ্ছা ভিন্ন ছিলো। হঠাৎ করেই সম্রাট হুমায়ুন এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন। যার ফলে নিজের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। তিনি যদি তার পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করে যেতে পারতেন, তাহলে একজন প্রশাসক হিসেবে তার যতটুকু দুর্নাম আছে, তা হয়তো ঘুচিয়ে যেতে পারতেন।
৯
মানুষ হিসেবে সম্রাট হুমায়ুন অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, শিক্ষিত, বিনয়ী, আমোদপ্রিয় আর শান্তিপ্রিয় ছিলেন। মুঘল সম্রাটদের মধ্যে সম্রাট হুমায়ুনের চেয়ে বিনয়ী সম্রাট আর কেউ ছিলেন না। সমস্যা হলো, শাসনকার্য পরিচালনা করতে গেলে বিনয় দিয়ে চলে না। প্রয়োজনে কঠোর হতে হয়, তড়িৎকর্মা হতে হয়, উদ্দ্যমী হতে হয়। দুঃখের বিষয় হলো সম্রাট হুমায়ুনের মাঝে এর সবগুলোর ঘাটতিই ছিলো।
মানুষ হিসেবে তিনি অত্যন্ত উঁচু মাপের হলেও শাসক হিসেবে নিজের প্রতিভা কখনোই খুলে ধরতে পারেননি তিনি। শাসক হিসেবে জীবনে তিনি প্রচুর ভুল করেছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই ভুল থেকে শিক্ষাও নেননি। সম্রাট হুমায়ুন সম্পর্কে বলা হয়, কোথাও পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সম্রাট হুমায়ুন অবশ্যই সেখানে পিছলে যেতেন, এমনকি তিনি মৃত্যুবরণও করলেন সেই পিছলে গিয়েই। সম্ভবত এই একটি লাইনই সম্রাট হুমায়ুনের সমগ্র জীবনকে সংক্ষেপে প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট!
লেখাঃ Masud Ferdous Eshan | সূত্রঃ রোয়ার বাংলা
খুব ভালো লাগল। এধরনের তথ্য দিতে থাকুন। ধন্যবাদ
ধন্যবাদ, সাথেই থাকুন।