দরজায় কে যেন নক করছে। কাঁচের দরজা হওয়ার এইটা একটা সুবিধা যে কে নক করে বোঝা যায়। আমি দরজার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম, অবয়বটা মনে হচ্ছে একটা অল্পবয়সী মেয়ের! ব্যচেলর মানুষ, গার্লফ্রেন্ডের টিকিও নাই- এরম অভাগার ঘরে কোন মেয়ে আসবে! টেনশন নিয়ে দরজা খুললাম।
:আব্বু কাঁঠাল পাঠিয়েছে!
:আমার জন্য?! কে?
:আব্বু! সব ভাড়াটেকে কাঁঠাল খাওয়াচ্ছে।
:ও! আপনি বাড়িওয়ালার মেয়ে? আসেন আসেন, রুমে আসেন!
আমাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটা রুমে ঢুকল। বলার জন্য বলেছিলাম, সত্যি সত্যি ঢুকে পড়বে আশা করিনি! রুমের যে অবস্থা, এরমধ্যে এত সুন্দর একটা মেয়েকে কিভাবে আনব!
ও রুমে ঢুকে চারিদিক দেখতে লাগল, একবার মনে হল হাসিও চাপল। আমি মনে মনে বলছিলাম, “হে ধরণী দ্বিধা হও, আমি তোমার ভেতরে প্রবেশ করি!”
রুমের একাংশ দখল করে আছে গাদা গাদা পানির খালি বোতল, আরেকদিকে আধখাওয়া পেয়ারা, আপেল, পিঁপড়ার মিছিল। আলনা ছাড়া সর্বত্র কাপড়ের সয়লাব, পড়ার টেবিল গল্পের বইয়ের ভারে ভাঙ্গে ভাঙ্গে অবস্থা! বিছানার চাদর আপাতত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চেয়ারে বসতে দিব কি চেয়ার জিনিসপত্রের ঠেলায় কুঁজো হয়ে আছে। ওসব নামিয়ে বসতে দিলাম।
মেয়েটা হাসতে হাসতে বলল, :অনেক কষ্ট দিলাম!
আমি কথা ঘুরানোর জন্য বললাম: আচ্ছা, আপনারা তো পাশের ফ্লাটে থাকেন, আপনাকে তো কখনো দেখিনি!
:আমি কিন্তু আপনাকে দেখছি! ওই যে সেদিন আব্বুর সাথে ধাক্কা খেলেন! আমি বারান্দায় ছিলাম।হাহা
:ইয়ে, ওইটা অনিচ্ছাকৃত! আচ্ছা, আপনি কিসে পড়েন?
: আপনার জুনিয়র! ফার্স্ট ইয়ার।
: আমি কিসে পড়ি আপনি জানেন?
:জানি। না মানে ওই উদ্ভাসের গাইডগুলো দেখে বললাম আরকি!
:ও।
:আচ্ছা, একটা মজার বিষয় জানেন? আপনাকে নিয়ে কিন্তু আমাদের বাসায় প্রায়ই আলোচনা হয়!
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম, কি বলছেন এসব?
:আব্বুর ধারণা, আপনি অসম্ভব প্রতিভাবানদের একজন। যেদিন ধাক্কা খাচ্ছিলেন সেদিন নাকি কি এক জটিল থিওরী নিয়ে বিড়বিড় করছিলেন? কাজের বুয়া বলে, আপনার নাকি তার ছেঁড়া!
:আরে নাহ! আঙ্কেল ভুল শুনেছেন।
: আপনার ঘর দেখলেও কিন্তু আব্বুর কথার সত্যতা পাওয়া যায়!
:আর লজ্জা দেবেন না। আসলে ঘর সাজানোর কেউ নাই তো তাই! আচ্ছা, আপনার নাম কি?
: নিলা। আপনার?
:রুফতি। তাহসিন রিফাত নূর রুফতি।
:আচ্ছা, আমি যাই।
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছে হচ্ছিল সারাদিন ওর সাথে কথা বলি। কি আর করা!
:যান। আবার আসবেন।
ও চলে যাবার পর ওকে নিয়ে ভাবতে বসলাম। প্রথম সাক্ষাতেই একটা মেয়ে এত বকবক করে কিভাবে! ওর কথা শোনার পর সারাদিন শুনতেই ইচ্ছা করছে। কি আফিং ছিল ওর কথায়?
আচ্ছা, ওরা নাকি আমাকে নিয়ে আলোচনা করে! এরকম আলোচনা সব বাড়িতেই হয়। কোনো বাড়িতে কারো প্রশংসা করা হয় কোনোটায় কারো নিন্দা। কিন্তু, এগুলা তো একান্তই ব্যক্তিগত কথা। ও আমাকে বলল কেন? দরজায় নকের শব্দ আবারো। এবার পাশের রুমের এক বড়ভাই আসছে। আমি আগেই জানতাম ওরা নীলাকে আমার ঘরে ঢুকতে দেখেই ওৎ পেতে আছে কখন আমাকে ধরবে!
:কি রুফতি! দিনকাল নাকি ভালোই কাটছে! বাড়িওয়ালার মেয়ে এসে কথা বলে যাচ্ছে, কাঠাল দিয়ে যাচ্ছে!
ভাইয়ের খোঁচানিতে মনে পড়ল, ওহো ভাই! ও তো আমাকে কাঠাল না দিয়েই চলে গেছে! আজব!
:বাব্বা! এতই মশগুল ছিলা যে কাঠাল নেবার কথা আর মনে ছিল না!
আবার দরজায় নক। নিলা!
ভাইয়ের সামনে ভাব নিয়ে বললাম, :এসো নিলা, ভেতরে আসো।
ও ভেতরে এসে সজল ভাইকে খেয়াল করল। সজল ভাই ওকে দেখে তোতলাতে লাগলেন।
:আপু স্লামালেকুম! রুফতি আমি যাই গো, কাজ আছে।
বলে হনহন করে চলে গেলেন। মেয়েদের দেখলে জমের মতন ভয় পান আবার পরে বড়বড় কথা!
আমি বললাম, : কাঠাল না দিয়েই চলে গেলা!
:আপনিও তো না নিয়েই যেতে দিলেন!
ক’দিন পর। বাইরে যাব, দেখি ও রাস্তার দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। লাল শাড়ি পরা। আমার দিকে তাকালই না। আমি সারাপথ খালি ভাবছিলাম, মেয়েটা যদি আমার হতো! মন্দ হতো না। দেব নাকি প্রোপজ করে! প্রোপজ না করলেও ক্ষতি নেই। কল্পনা করে নিলাম ও আমার পাশে হাঁটছে আর বকবক করে কানের পোকা নড়িয়ে দিচ্ছে। রাস্তার লোক অবাক হয়ে দেখছে। এরকম অগাবগা মার্কা ছেলের পাশে কোন পরীকে তারা আশা করে না! বড় সুখের সে কল্পনা! সুখ আসলেই সহজলভ্য যদি কেউ নিতে জানে।
আরেক সন্ধ্যায় ও আবার এলো। সঙ্গে সঙ্গে সেদিন বিকেলে আমাকে অবহেলা করার অপরাধ ক্ষমা করে দিলাম।
:কেমন আছো? ভেতরে আসো।
: না। যাব না। পাতিলটা দিন। যেটায় করে কাঠাল দিলাম।
পাতিলটা দেবার সময় মনে মনে দোয়া করলাম যেন হাতে হাত লাগে! হল না, শয়তান পাতিলটা বেশ বড়!
সে রাতে ঘুম হলো না। তীব্র ছটফটানি বুকের মধ্যে। ওর অবহেলা নিতে পারছি না, অথচ ওর উপর কোনো অধিকারই তো নাই আমার। বড় ভাইয়েরা বলেছে, আমার নাকি অনেক ভালো ভাগ্য তাই ও আমার রুমে এসেছে। অন্যদের সাথে নাকি কথাও বলে না।
আমার কষ্টটা তো সেখানেই। আমার প্রতি যদি ওর কোনোই কিছু নাই তাহলে কেন আর দশজনের মত আমার সাথেও কথা বলল না? কেন আর সবার মত বুয়ার হাতে করে কাঁঠাল না পাঠিয়ে নিজে এল? কেন পিরীতি বানাইলারে বন্ধু, ছেড়ে যাইবা যদি?
আক্রোশে, অভিমানে সে রাতে চোখে জল নিয়ে ঘুমালাম। ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে ভাবলাম নিলার অধ্যায় শেষ। আমি ওকে নিয়ে ভাবব কেন? হু দ্যা হেল শী ইজ?
কিছুক্ষণ পর মনটা খচখচ করতে লাগল। হয়তো আমি কোনো ভুল করে ফেলেছি যার জন্য ও রাগ করেছে। সরি বললে ঠিক হয়ে যাবে। কোথায় পাবো ওকে? ওর বাসায় তো যাওয়া যাবে না, বরং ছাদে যাই। ভাগ্য ভালো হলে পেয়েও যেতে পারি।
ছাদে গিয়ে দেখি কেউ নাই। আমি এককোণায় বসে পড়লাম। কি ভুল করেছি ভাবার চেষ্টা করছি তখন পায়ের শব্দ। বুকটা ধক করে উঠল! নেহা নয়তো? হ্যাঁ, সেই স্বর্গলোকের দেবী নিলা নেমে এসেছে ধুলোমাটির পৃথিবীতে।
এরম সময়ে অনেকে নানানরকম আড়ম্বর করে প্রোপজ করে, যেমন তুমি আমার প্রথম হ্যান, সকালের ত্যান, গোধুলির ছাতা ব্লা ব্লা…. আমার মাথায় কিচ্ছু আসছিল না। আর এসব বলার ধৈর্য্যও ছিল না আমার।
ও আমাকে দেখে হাসল। এই মেয়েটার কখন যে কি হয় কে জানে!
:আজকাল তো আমার সাথে কথাই বলো না!
:দেখা হয় না তো।
:রুমে তো আসতে পারো!
:কারণ ছাড়া কারো রুমে যাওয়া যায় নাকি!
:কারণ লাগবে কেন?
:ও বুঝবেন না। আপনিও তো আসতে পারেন আমাদের বাসায়?
:অযুহাত?
:আমার বেলায় কারণ লাগবে না আর আপনার বেলায় অযুহাত লাগবে! চমৎকার!
:আমি তো চাই তুমি আসো, তাই তোমার কারণ লাগবে না। কিন্তু আমার তো লাগবে!
ও চুপ করে রইল। আমি দীর্ঘশ্বাস ঠেলে বললাম : আচ্ছা, আমার না কাঠালগুলা শেষ। তুমি আজ আরো দিতে পারবে? অনেক মিষ্টি ছিল ব্যপারটা!
সন্ধ্যায় আমি রেডিই ছিলাম।টোকা পড়তেই দরজা খুলে দিলাম। দাঁত বের করে হাসছে নিলা, হাতে আস্ত কাঁঠাল।
:আব্বু বলেছে, আহারে বেচারা! বাপ মা ছেড়ে আছে, ফলমূল খেতে পায় না। এটা দিয়ে আয়। তাই আসলাম। ধরেন।
আমি বললাম, :করেছো কি! আমি একা মানুষ, কিভাবে খাব সব?
:আসেন, আমিও হেল্প করছি।
:আঙ্কেল আন্টি??
:বাসায় নাই। আজ অনেকক্ষণ থাকব কিন্তু।
এক কথাতেই আমি ক্লিন বোল্ড! পা কাঁপছিল। এত সুখও মানুষের হয়! আজ কাঠাল খেতে গিয়ে কয়েকবার আঙ্গুল আঙ্গুল ছুঁয়ে গেছে। ও কতটুকু চমকেছে জানি না, আমি ভয়ঙ্কর চমকেছি। অনুভুতিটা বোঝানো যায় না, যাওয়া উচিৎ না!
আমি হঠাৎ বলে ফেললাম, “এই তুমি এতো সুন্দর ক্যান?”
ও চোখ মেলে তাকাল, বলল: আপনার কি কোনো আইডিয়া আছে যে ঠিক এই কথাটা আমি আর কতজনের কাছ থেকে শুনেছি?
আমি বিমর্ষ হয়ে গেলাম।
ও চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, অথচ এই তুচ্ছ কথাটাই আমাকে কি ভয়ঙ্কর আনন্দ দিল দ্যাট আই হ্যাভেন্ট ফিল বিফোর! আরেকবার বলবেন প্লিজ? কথাটা?
লিখেছেনঃ তাহসিন রিফাত নূর