কোনো সমাজ ব্যবস্থা যখন জরাজীর্ণ এবং গতিহীন হয়ে পড়ে, তখন সমাজের মধ্য থেকে এমন শক্তি জেগে ওঠে যে তার আঘাতে পুরাতনতন্ত্র তাসের ঘরের ন্যায় ভেঙে পড়ে। ক্ষয়ধরা সমাজকে ভেঙে পুরাতন ব্যবস্থার স্থলে নতুন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সমাজের এই তৎক্ষণাৎ মৌলিক পরিবর্তনই হল বিপ্লব। মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকেরা বিপ্লবের একটি বিশেষ অংশ দেখেন। তাদের মতে, সমাজে দুটি শ্রেণি থাকে। এক শ্রেণি সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে এবং অপর শ্রেণি শোষিত হয়। শোষিত শ্রেণি শেষ পর্যন্ত অধিকারভোগী শ্রেণীর প্রথাগত রাজনৈতিক এবং আর্থিক সকল অধিকার বিপ্লবের মাধ্যমে ধ্বংস করে। শ্রেণিসংগ্রামই বিপ্লবের বাহন। যেমনটি দেখা যায় ফরাসি বিপ্লবে, যেখানে অধিকারভোগী অভিজাত শ্রেণিকে উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণি ক্ষমতাচ্যুত করে।
১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে যে বিপ্লব দেখা যায়, তা কোনো আকস্মিক কারণে ঘটেনি। দীর্ঘদিন ধরে ফ্রান্সের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতিতে যে ব্যবস্থা চলে আসছিল, তার সঙ্গে ফ্রান্সের বৃহত্তর জনসমষ্টির স্বার্থ যুক্ত ছিল না। শেষপর্যন্ত বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে পুরাতন ব্যবস্থা ভেঙে নতুন ব্যবস্থা গঠনে তৎপর হয় সাধারণ জনগণ।
ফ্রান্সের রাজনৈতিক অবস্থা
ফরাসি রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতা: সপ্তদশ শতকের ফরাসী রাজনীতিজ্ঞ রিশেল্যু ও ম্যজারিন এবং ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই ফরাসি রাজতন্ত্রকে একটি স্বৈরতন্ত্রী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। এই যুগের রাজারা মনে করতেন যে ঈশ্বর রাজাকে নিযুক্ত করেছেন। তারা ঈশ্বর ছাড়া আর কারও কাছে দায়ী নন। ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা নীতির উপর ভিত্তি করে চতুর্দশ লুই ফরাসী রাজতন্ত্রকে সরবময় ক্ষমতার আধারে পরিণত করেন। রাজার এই ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি একসময়ে মন্তব্য করেন- “The state, it is myself” –রাজাই হলেন রাষ্ট্র। রাজার ক্ষমতাকে সর্বময় করার জন্য ফ্রান্সের পার্লামেন্ট সভা স্টেট জেনারেলের অধিবেশন ১৬১৪ সালে বন্ধ করে দেয়া হয়। যেহেতু রাজা আহ্বান না করলে জাতীয় সভা বা স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন বসতে পারত না, সেহেতু ফ্রান্সের বুরবো রাজারা স্বৈরতন্ত্রকে নিরংকুশ করার জন্যে জাতীয় সভার অধিবেশন আহ্বান করেননি। প্রতিনিধি সভা না থাকায়, ফ্রান্সে রাজার নিজ ইচ্ছা অনুসারে শাসনকার্য চলতে থাকে। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন রাজারা জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার নীতি গ্রহণ করেন। কিন্তু ফ্রান্সের বুরবো বংশীয় রাজা পঞ্চদশ এবং ষোড়শ লুই কেবলমাত্র স্বৈরতন্ত্রকেই গ্রহণ করেন। তাঁরা সমকালীন আলোকিত স্বৈরাচারকে স্বীকার করতেন না। ফরাসী রাজশক্তি শুধু অধিকারের কথাই ভাবত, কর্তব্যের কথা ভাবত না। এজন্য ফ্রান্সে প্রজাদের সঙ্গে রাজশক্তির কোন যোগাযোগ ছিল না। বুরবো রাজারা সকল ক্ষমতা নিজ হাতে নিয়ে প্রজাদের সকল চাহিদা ও অধিকার অগ্রাহ্য করতেন। ঐতিহাসিক শেভিল এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছিলেন-
“স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন বন্ধ থাকার কারণে সাধারণ লোকেরা তাঁদের অসুবিধা ও অভিযোগের কথা রাজার নিকট পৌঁছাতে পারত না। এর ফলে বুরবো রাজতন্ত্র বৃহত্তর জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়’।
: শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা ও অভিজাত শ্রেণীর প্রভাব: বুরবো রাজতন্ত্র আইনত সর্বশক্তিমান বাস্তবে রাজার ক্ষমতাই ছিল সর্বাধিক । ফ্রান্সের সামন্ত অভিজাত ও যাজক শ্রেণী রাজার তরফে সরকারি ক্ষমতা হস্তগত করে সুযোগসুবিধা ভোগ করত। ফরাসী অভিজাতরা দাবি করত, তারা রাজার সমশ্রেণিভুক্ত লোক। সুতরাং, দেশ শাসনের ক্ষেত্রে একমাত্র তারাই রাজাকে সাহায্য করার অধিকারী। রাজবংশের মতো তাদেরও বংশকৌলীন্য ছিল। এই বংশ মর্যাদার জোরে তারা দেশ শাসনের অধিকার ভোগ করত। লেফেভারের মতে, “ফরাসী রাজতন্ত্র ছিল ইংল্যান্ডের নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র এবং ইউরোপ মহাদেশের স্বৈরতন্ত্রের মাঝামাঝি ব্যবস্থা।” চতুর্দশ লুইয়ের পর বুরবো বংশে সুযোগ্য শাসকের অভাব দেখা যায়। পঞ্চদশ লুই ছিলেন “বিলাসী, রমণীরঞ্জন, প্রজাপতি রাজা” (Butterfly Monarch)। তিনি ছিলেন পরিশ্রমবিমুখ এবং তার উপপত্নী মাদাম দ্যু পম্পাদ্যুরের দ্বারা প্রভাবিত। ষোড়শ লুই সৎ এবং সদিচ্ছাপরায়ণ হলেও তার সুন্দরী গর্বিতা পত্নী অস্ট্রিয়ার রাজকুমারী মেরী অ্যানটোনেটের বশীভূত ছিলেন। বুরবো রাজাদের এই ব্যক্তিগত অযোগ্যতার ফলে রাজার তরফে সকল ক্ষমতা অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা হস্তগত করে।
: যাজক শ্রেণীর স্বায়ত্ত্বশাসন: ফ্রান্সের গির্জা (গ্যালিকান চার্চ) স্বয়ং শাসিত সংস্থা। রাজা গির্জার অভ্যন্তরীণ শাসনে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন না। ১৫৬১ সালে পোইসির চুক্তি অনুসারে যাজকেরা গির্জার ভূ-সম্পত্তির ওপর স্বেচ্ছা কর দিত। রাজা কোনো কর ধার্য করতে পারতেন না।
: প্রাদেশিক সভার ক্ষমতাঃ ফ্রান্সের প্রদেশগুলিতে যে সভা ছিল সেগুলির সম্মতি ছাড়া রাজার কোনো নির্দেশ প্রদেশগুলিতে কার্যকরী করা যেত না। প্রাদেশিক সভাগুলিতে স্থানীয় অভিজাতরা প্রাধান্য ভোগ করত। রাজা কোনো নতুন আইন জারি করলে প্রথমে পার্লামেন্ট নামক বিচার সভায় নথিবদ্ধ করতে হত। নতুবা এ আইন বৈধ হত না। পার্লামেন্ট ইচ্ছা করলে রাজার প্রস্তাবিত আইন নাকচ করে দিতে পারত। পার্লামেন্টের বিচারকেরা ছিলেন অভিজাত শ্রেণীর।
: ফ্রান্সে পার্লামেন্টের সংখ্যা ছিল ১২টি । এদের মধ্যে প্যারিসের বিচারসভা ছিল এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিপত্তিশালী। প্যারিসের পার্লামেন্টের অভিজাত শ্রেণীর বিচারক সদস্যরা এতই ক্ষমতাবান ছিলেন যে, তারা মন্ত্রী টুরগোর প্রস্তাবিত মৌলিক সংস্কারের ব্যবস্থাকে কার্যকরী হতে দেয়নি। রাজা অবশ্য Lit de Justice প্রথা দ্বারা পার্লামেন্টের বিরোধিতা দমন করতে পারতেন। Lit de justice হলো রাজা নিজে পার্লামেন্টের সভায় সভাপতিত্ব করে আইন পাশ করিয়ে নেয়ার প্রথা। কিন্তু পার্লামেন্টের বিরোধিতা রাজা কার্যতঃ অগ্রাহ্য করতে সাহস করতেন না। সুতরাং ফ্রান্সের রাজারা ঐশ্বরিক ক্ষমতা দাবি করলেও বাস্তবে তাদের ক্ষমতা ছিল সীমিত। ঐতিহাসিক ডেভিড থমসনের মতে, “ফরাসী রাজতন্ত্র আসলে ছিল সামন্ত রাজতন্ত্র” – ‘The French monarchy was a feudal monarchy’ .
: বিচার ব্যবস্থার দুর্নীতি: ফ্রান্সের বিচারব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। সরকারি কর্মচারীরা ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত ও অত্যাচারী। Letters de Grass and Letters de Cachet দ্বারা নাগরিকদের বিচারের ক্ষেত্রে রাজা হস্তক্ষেপ করতে পারতেন। প্রথম ক্ষমতা প্রয়োগ করে তিনি আদালতের দ্বারা প্রদত্ত শাস্তি মাফ করতে পারতেন। দ্বিতীয় ক্ষমতা দ্বারা তিনি যেকোনো নাগরিককে বিনা বিচারে কারাগারে আটক রাখতে পারতেন।প্রদেশগুলিতে রাজস্ব আদায়কারী ইনটেনডেনটরা ছিল ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত অর্থলোলুপ।তারা বহু প্রকার বাড়তি কর আদায় করত এবং এর বৃহৎ অংশ তারা আত্মসাৎ করত। তাদের দুর্নীতি ও প্রতাপে তৃতীয় শ্রেণীর লোকেদের দুর্গতির সীমা ছিল না।
: বৈদেশিক নীতি: এক্ষেত্রে পঞ্চদশ ও ষোড়শ লুই প্রকাণ্ড ব্যর্থতার নজির সৃষ্টি করেন। পঞ্চদশ লুই অষ্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে (১৭৪০-১৭৪৮খ্রিঃ) এবং সপ্তবর্ষের যুদ্ধে পরাজিত হন। ষোড়শ লুই এ পরাজয় থেকে শিক্ষা না নিয়ে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যোগ দেন। এই দীর্ঘ যুদ্ধগুলোতে ফ্রান্সের পরাজয়ে ফ্রান্সের মর্যাদা নষ্ট হয়। এছাড়া জনস্বার্থের ব্যাপক ক্ষতি হয় ও রাজকোষ শূন্য করে দেয়।
: রাজস্ব নীতি: প্রথমত, যাদের কর প্রদানের ক্ষমতা ছিল যথা- অভিজাত ও উচ্চ যাজক, তারা কর প্রদান থেকে অব্যাহতি ভোগ করত। অন্যদিকে যাদের কর প্রদানের ক্ষমতা ছিল না, যথা- কৃষক, পাতি বুর্জোয়া ও উচ্চ বুর্জোয়া, তারাই করের ভারে নিষ্পেষিত হতো। রাজা অভিজাত ও যাজকদের ওপর কর বসিয়ে রাজস্ব ঘাটতি দূর করতে সাহস করেননি। এজন্য সরকার সর্বদাই অর্থসংকটে ভুগত।
বুরবো রাজারা ছিলেন ঘোর অমিতব্যয়ী। যুদ্ধ ও অমিতব্যয়ের ফলে রাজস্ব ক্রমশ কমতে থাকে। আদায়ী রাজস্ব থেকে সরকারি ব্যয় সঙ্কুলান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। উপায় না দেখে রাজা ষোড়শ লুই অবশেষে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকেন। এর ফলে বুরবো স্বৈরতন্ত্রের দুর্বলতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। সাধারণ জনগণ শেষ পর্যন্ত এই শাসনের নামে শোষণব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য তৎপর হয়। শুরু হয় বিপ্লবের।
লেখাঃ Bayzid ahmed, সূত্রঃ রোয়ার মিডিয়া