ঘুরতে আমরা কে না ভালোবাসি? ভ্রমণপ্রিয় মানুষেরা সুযোগ পেলেই ছুটে যায় বিশ্বের নানা প্রান্তে। এই পৃথিবীতে এমনও দুর্গম ও ভয়ংকর কিছু পর্যটন স্থান রয়েছে, যা ভ্রমণপিপাসু মানুষকে রোমাঞ্চিত করে তার ভয়ংকর সুন্দর বৈশিষ্ট্যের কারণে। এসব স্থানের পরতে পরতে মিশে আছে মৃত্যুর আশংকা। কিন্তু মৃত্যুকে উপেক্ষা করেও অনেক পর্যটক নিছক রোমাঞ্চের নেশায় ছুটে যায় সেখানে। অনেকে আবার শেষ জীবনের জন্য বেছে রেখেছেন সেসব স্থান। মৃত্যুর আগে একবার ঘুরে আসতে চান সেখানে।
চলুন, জেনে নেয়া যাক এমন ভয়ংকর কিছু পর্যটন স্থান সম্পর্কে।
দ্য দানাকালি ডেজার্ট
ইথিওপিয়ার সীমান্ত ঘেষে অবস্থিত এ ডেজার্ট বিপদজনক পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। দ্য দানাকালি ডেজার্ট ইথিওপিয়ার ইরিত্রিয়ায় অবস্থিত। পৃথিবীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রার স্থানগুলোর একটি এটি। এখানকার তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। মরুভূমির মাঝে রয়েছে লাভার হ্রদ। বিশাল মরুভূমির মাঝে অনেক জায়গা থেকে ক্রমাগত লাভা নির্গত হয়। সেই সাথে বেরিয়ে আসে বিষাক্ত গ্যাস। এই বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পুরো এলাকার বাতাস ভারী করে তুলেছে। ভূতাত্ত্বিক এমন প্রতিকূল পরিবেশের জন্য অনেকে এ মরুভূমিকে ‘এলিয়েনদের স্থান’ বলে থাকেন।
কিন্তু তারপরও এখানে পর্যটকের অভাব নেই। দানাকালি মরুভূমির সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। আর ফটোগ্রাফির নেশা থাকলে তো এটা আপনাকে আরো বেশি মুগ্ধ করবে। তবে চাইলেই কিন্তু আপনি একা যেতে পারবেন না এখানে। সাথে অভিজ্ঞ গাইড নিয়ে যেতে হবে, যদি উপভোগ করতে চান এই ভয়ংকর সুন্দর মরুভূমি। অভিজ্ঞ গাইড ছাড়া সেখানে পা রাখতে দেবে না ইথিওপিয়ার সরকার।
বিকিনি আটোল
পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তায় পূর্ণ এই দ্বীপ ‘মার্শাল আইল্যান্ড’ নামে বেশি পরিচিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই বিকিনি আটোল বেশি আলোচিত তার পারমাণবিক ইতিহাসের কারণে। এই দ্বীপেই আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে চল্লিশের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলো। জাপানে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর এটিই প্রথম স্থান, যেখানে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
ধীরে ধীরে এটি হয়ে ওঠে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ পরীক্ষা কেন্দ্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ দ্বীপে ২৩টি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়, যার মধ্যে ১৯৫৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন এক পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়, যা হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার চেয়েও ১,১০০ গুণ বেশি শক্তিশালী ছিলো। এমন ক্রমাগত পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এ দ্বীপ হয়ে ওঠে মৃত্যুপুরী। পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর ৭০ বছর কেটে গেলেও এখনও সেখানকার তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা অনেক বেশি। কিন্তু এতকিছুর পরও পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তাকে ছাপিয়ে বিকিনি আটোল তার নিজ রূপ ধরে রেখেছে।
ভ্যালি অফ ডেথ, কামচাটকা, রাশিয়া
রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপের পূর্বাংশে রয়েছে কেহিন্নাইক আগ্নেয়গিরি। এর পাদদেশে তৈরি হয়েছে এ মৃত্যুর উপত্যকা। যারা একা থাকতে পছন্দ করেন, নির্জন পরিবেশ যাদের বেশ ভাল লাগে, রাশিয়ার কামচাটকায় অবস্থিত এই ভ্যালি অব ডেথ তাদের জন্য উত্তম স্থান। কিন্তু এখানে কিছুক্ষণ থাকলেই আপনার মাথা ঘোরানো শুরু হবে, অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এখানকার বিষাক্ত বাতাস আপনাকে দ্রুতই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে। আগ্নেয়গিরির বিষাক্ত গ্যাসই এখানকার বাতাসকে এতটা বিষাক্ত করে তুলেছে।
এই বিষাক্ত গ্যাসের কারণেই এখানে জীবন ধারণ অসম্ভব। এক গবেষণায় দেখা যায়, বিষাক্ত গ্যাসের উচ্চ ঘনত্বের কারণেই মূলত এখানকার প্রাণী ও পাখিরা মারা যায়। প্রধানত হাইড্রোজেন সালফাইড, কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো গ্যাসই এখানকার বাতাসকে বিষাক্ত করে তুলেছে।
এত কিছু শোনার পরও এখানকার কিছু ফটোগ্রাফি দেখলে আপনার হয়তো এখনই সেখানে ছুটে যেতে ইচ্ছে করবে।
ডেথ ভ্যালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
রহস্যপ্রেমী মানুষদের কাছে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত ডেথ ভ্যালি খুবই পরিচিত এক নাম। পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় এই স্থানটির সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। কিন্তু এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তপ্ত স্থান। ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে ১৩৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৫৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা নথিভুক্ত করা হয়েছিলো। তারপর ১৯৭২ সালে এখানকার ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় প্রায় ২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। ডেথ ভ্যালির এ তাপমাত্রা মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিকেও হার মানিয়ে দেয়। কিন্তু তারপরও রহস্যেঘেরা এ ডেথ ভ্যালি দেখতে প্রতিবছর প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ ভিড় করে।
ডেথ ভ্যালির নামকরণের পেছনে রয়েছে এক ইতিহাস। কথিত আছে, ১৮৪৯ সালে একদল স্বর্ণ সন্ধানী ডেথ ভ্যালির মরুভূমি পার হয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় স্বর্ণের সন্ধানে যেতে চেয়েছিল। পথিমধ্যে প্রচন্ড গরমে অসুস্থ হয়ে এক সহযাত্রীর মৃত্যু ঘটে এবং বাকিরা অনেক কষ্টে মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে আসে। তাদের একজন মৃত্যুর দোরগোড়া হতে ফিরে আসার সময় পিছে তাকিয়ে বলে,
“বিদায়, মৃত্যু উপত্যকা। (ডেথ ভ্যালি)”
সেখান থেকেই এর নামকরণ করা হয় মৃত্যু উপত্যকা (ডেথ ভ্যালি)।
ব্রাজিলের স্নেইক আইল্যান্ড
পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক স্থানের মধ্যে এটি একটি। ব্রাজিলের এই দ্বীপকে বলা যেতে পারে সাপেদের স্বর্গরাজ্য। এখানে পৃথিবীর সব বিষধর সাপের বাস। এক গবেষণায় দেখা যায়, এখানে প্রতি বর্গ মিটার জায়গায় গড়ে ৫টি করে সাপ বাস করে। রহস্যজনক এ স্থান নিয়ে অনেক গল্প আছে। এখানে নাকি ভয়ংকর এমন সব সাপের দেখা মেলে, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও কেউ কখনো দেখেনি। যারা এর মধ্যেই ভেবে বসেছেন, ব্রাজিলের স্নেইক আইল্যান্ডে পা রাখবেন, তাদের জন্য দুঃসংবাদ। কেননা ব্রাজিল সরকার এই বিপজ্জনক দ্বীপে দর্শনার্থীদের আগমন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
স্থানীয় লোকজনের কাছে এ স্থান কেবলই এক মৃত্যুপুরী। স্থানীয় অনেকেই এখানে পা রাখবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার শেষ পরিণতি হয়েছিল মৃত্যু।
বলিভিয়ার মাদিদি জাতীয় উদ্যান
বলিভিয়ায় অবস্থিত এ উদ্যান যেকোনো ভ্রমণপিপাসু মানুষকে পাগল করে দিতে সক্ষম। প্রথম দেখে মনে হবে, এখানেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়া গেলে মন্দ হত না। কিন্তু বাস্তবে এটি ভয়ংকর এক স্থান। পৃথিবীর বিষাক্ত ও ভয়ংকর সব উদ্ভিদের দেখা মিলবে এখানে। এসব উদ্ভিদ এতটাই বিষাক্ত যে, সামান্য স্পর্শেও মানবদেহে চুলকানি থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। শরীরের সামান্য কোনো ক্ষতও এখানকার পরজীবী দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। এমনকি কিছু উদ্ভিদের সংস্পর্শে এলে মৃত্যুও অনিবার্য।
লেখাঃ Nur A Shafee Ahnaf | সূত্রঃ রোয়ার বাংলা