মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি বড় ধাপ ছিল কৃষিকাজের সূচনা, যা মানুষের বসবাসে স্থায়িত্ব নিয়ে আসে, আর প্রায় সব মৌসুমে খাদ্য লাভের নিশ্চয়তাও দেয়। তাই সভ্যতার ইতিহাসে কৃষিকাজের অবদান কোনোদিন ভোলার নয়। তবে কৃষিকাজের সূচনার ফলে সাময়িকভাবে অন্য একটি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল মানুষকে। কী সেটি?
কৃষিকাজের মাধ্যমেই খাদ্যের নিশ্চয়তা থাকায়, তারা পশু শিকার অনেকাংশেই বন্ধ করে দিয়েছিল। কৃষিকাজ করেই যদি সারা বছর খাদ্যের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়, তাহলে আর কষ্ট করে বন্য পশু শিকার করতে যাওয়ার কী দরকার, এমনটিই ছিল সেসময়ের অনেক মানুষের চিন্তা। এর ফলে তাদের প্রাত্যহিক খাদ্য চাহিদা হয়তো মিটছিল, কিন্তু সেই খাদ্যে একটি বিশেষ পুষ্টি উপাদানের অভাব রয়েই যাচ্ছিল। সেটি হলো আমিষ।
তবে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ জন্মগতভাবেই দারুণ বিচক্ষণ, সেকারণেই তারা এই সমস্যারও একটি কার্যকর সমাধান করে ফেলতে খুব বেশি সময় নেয়নি। তারা ভেবে দেখল, কষ্ট করে বন্যপ্রাণী শিকার আর না-ই বা করলাম, কিছু পশুকে পোষ তো মানানো যায়, যারা সময়ে-অসময়ে দুধ ও মাংসের মাধ্যমে আমাদের আমিষের অভাব পূরণ করবে! এবং এভাবে নিজেদের প্রয়োজনেই মানুষ কেবল কৃষিকাজেই সীমাবদ্ধ না থেকে, পশুপালনেও ব্রতী হলো।
গবাদি পশুপালন মানবসভ্যতায় নতুন মাত্রা যোগ করে। এবং অনেকেই জেনে অবাক হবেন, গবাদি পশুপালনের ইতিহাস কিন্তু খুব সাম্প্রতিক কিছু নয়। মানুষের সাথে বন্য গবাদি পশুর সম্পৃক্ততা হাজার বছর ধরে চলে এসেছে। আনুমানিক গত ১০,৫০০ বছর ধরে মানুষ গবাদি পশুকে ঘরোয়াভাবে পালন করে চলেছে।
আর এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রভূত উন্নতি সাধন হয়েছে মানুষের সভ্যতার। একদিকে যেমন তাদের দুধ ও মাংসের মাধ্যমে আমিষের অভাব দূর হয়েছে, অন্যদিকে এসব গবাদি পশুকে দিয়ে লাঙল, গাড়ি ও বোঝা টানানোও সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি পশুর চুল, চামড়া, খুর, হাড় দিয়ে পোশাক ও কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি, এবং গোবর দিয়ে কৃষিজমিতে সার প্রয়োগ করা গেছে।
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ঠিক কবে থেকে পালন শুরু হলো গবাদি পশু, এবং এরাই কি মানুষের পোষ মানা প্রথম বন্যপ্রাণী? পরের প্রশ্নটির উত্তর আগে দেওয়া যাক। না, গবাদি পশুই মানুষ প্রথম পালন করেনি। মানুষের প্রথম পোষ মানা প্রাণী ছিল কুকুর। প্রস্তরযুগ শেষ হওয়ার আগেই, এমনকি কৃষিকাজ ও অন্যান্য পশুপালনেরও আগে, পোষ মেনেছিল কুকুর। তবে মেসোপটেমিয়ায় কৃষিকাজের সূচনা ঘটার পর, ওই একই সময়ের দিকে সেখানকার মানুষ কিছু পশুদেরও পোষ মানাতে শুরু করে। প্রথম পোষ মেনেছিল ছাগল, আর এর অব্যবহিত পরেই ভেড়াও। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুরগিও পালন শুরু হয়েছিল।
কিন্তু পশুপালন প্রথম সত্যিকারের সফলতার মুখ দেখে যখন থেকে গবাদি পশুরা পোষ মানতে শুরু করে। সেটা খ্রিষ্টপূর্ব ৮৫০০ অব্দের দিকের কথা। মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের বনভূমিতে বাস করা বৃষসদৃশ গরু ও অরোচদের মানুষ পালনের জন্য নিয়ে আসে। এই প্রথম প্রজাতির গবাদি পশুদের মাথার উপর লম্বা শিং ছিল, অনেকটা ফেনোটাইপ, যা আজও অনেক ব্রিটিশ, ফরাসি, ভূমধ্যসাগরীয় ও আফ্রিকান প্রজাতির মাঝে দেখা যায়। প্রথম ছোট শিংওয়ালা প্রজাতির দেখা মেলে অনেক পরে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের দিকে, মেসোপটেমিয়ায়। তবে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১০০০ অব্দের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে ব্রিটেনে যখন গবাদি পশু পৌঁছায়, তাদের মাথার শিং আদি গবাদি পশুদের মতো লম্বাই ছিল। কেবল খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দের পর ইউরোপে ছোট শিংয়ের গবাদি পশু ইউরোপে পাড়ি জমায়, এবং এখন সেখানেও এ ধরনের গবাদি পশুই বেশি দেখা যায়।
ইউরোপে এখনও যেসব নব্যপ্রস্তরযুগীয় খামারের নিদর্শন অবশিষ্ট রয়েছে, সেগুলো থেকে জানা যায়, গবাদি পশুরা মূলত দুইটি পথে ইউরোপে পৌঁছেছিল: একটি ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল, অপরটি দানুবে নদী। এই দুই পথ দিয়ে তারা খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের দিকে প্রথম উত্তরসাগরীয় উপকূলে পদার্পণ করে। এছাড়া ধারণা করা হয়, গবাদি পশুরা উত্তর এশিয়ায় বসতি স্থাপন করতে ব্যবহার করেছিল ককেশাস রুট। আফ্রিকায় এই পশুরা প্রথম পা রেখেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০-৪০০০ অব্দের দিকে। এছাড়া গবাদি পশুর অপর সর্ববৃহৎ অভিবাসন ঘটেছিল পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য পতনের সময়ে, জার্মানিকদের হাত ধরে।
গৃহপালিত হওয়ার পর থেকে গবাদি পশুদের মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তন আসতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ অব্দ থেকে পুরো এশিয়াব্যাপী আধুনিক জেবু জাতের গরু পালনের প্রচলন ছড়িয়ে পড়ে, যাদের পূর্বপুরুষ ছিল ইন্দু ভ্যালির অরোচ। মজার ব্যাপার হলো, একদম শুরুর দিকে কিন্তু এদের পিঠে কুঁজ ছিল না। গৃহপালিত পশুতে পরিণত হওয়ার পরই কেবল এদের পিঠে কুঁজ জন্মায়। এই কুঁজ সহই তারা চীন, ইন্দোচিন ও ইন্দোনেশিয়ায় হাজির হয়, এবং খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দের দিকে আরও পশ্চিমে ধাবিত হতে থাকে।
এর বাদেও গত ৭০০০ বছরে আরও বেশ কয়েক প্রজাতির বন্য গবাদি পশু পালন হয়েছে। এদের মধ্যে একটি হলো ব্যান্টিং। ধারণা করা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আদিমানুষেরা সেই খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ থেকে এই প্রজাতিটি পালন করে আসছে। এছাড়া রয়েছে গয়াল বা মিথুন, যেটি গৌর জাতের গৃহপালিত সংস্করণ। আসাম এবং মায়ানমার অঞ্চলে এই জাতের বিচরণ, এবং এরা মূলত বিভিন্ন লৌকিক আচার পালনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের দিকে এক জাতের বন্য ইয়াক (চরমী গাই) কিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং এখন সেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে এই পশুটির দেখা পাওয়া যায়।
এখন আমরা যেসব আধুনিক জলা মহিষ দেখি, সেগুলোর উৎপত্তি বন্য জলা মহিষ থেকে। সাম্প্রতিক কিছু ডিএনএ গবেষণার ফল এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বলছে, দক্ষিণ চীন এবং/কিংবা ইন্দোচীনে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দের দিকে মহিষ পালন শুরু হয়। কাকতালীয়ভাবে, জলা মহিষ পালন ও ধান উৎপাদনের সূচনা একই সময়ে হয়, যখন ধানী জমিতে লাঙল দেওয়ার জন্য অপেক্ষাকৃত শক্তপোক্ত পশুর প্রয়োজন ছিল। এছাড়া মহিষের আরেকটি ফেনোটাইপ জাত হলো নদী মহিষ, যার উদ্ভবও বন্য জলা মহিষ থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের দিকে ইন্দুস ভ্যালিতে এই জাত পালন শুরু হয়। অনুমান করা হয় যে, রোমান সাম্রাজ্যে এই পশুগুলোর পরিচিতি ছিল না। কেবল গৃহপালিত পশুতে পরিণত হওয়ার পরই মহিষ পশ্চিমা বিশ্বে পাড়ি জমায়।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আমেরিকা অঞ্চলে আদিকালে কোনো ধরনের গবাদি পশুই পাওয়া যেত না। ষোড়শ শতকে প্রথম স্প্যানিশরা ক্যারিবীয় অঞ্চলে গবাদি পশু নিয়ে যায়, আর দুগ্ধজাত খাদ্য উৎপাদনের জন্য অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ইংলিশ ঔপনিবেশিকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গরু নিয়ে যায়।
গবাদি পশু পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার পর, স্থানভেদে সেগুলোর অভিযোজন ঘটতে শুরু হয়, এবং একই জাতের পশু স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি এখানে মানুষেরও একটি বড় অবদান ছিল। গবাদি পশুকে মোটাতাজা করতে ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা বেশি বেশি খাবার দিতে থাকে, ভিন্ন ভিন্ন পালন পদ্ধতি অবলম্বন করতে থাকে, দুইটি ভিন্ন জাতের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে নতুন জাতের উদ্ভব ঘটাতে থাকে। এই উদ্ভাবনের ধারাবাহিকতায় গত ২০০ বছরে গবাদি পশুর বৈশিষ্ট্যে ব্যাপক বৈচিত্র্য কিছু কিছু পরিবর্তন খুবই চোখে পড়ার মতো, এবং সেগুলো প্রায় সব অঞ্চলেই দেখা যায়। যেমন: গবাদি পশুরা যখন বনে থাকত, তখন তারা শারীরিকভাবে অনেক শক্তপোক্ত থাকত, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি ছিল, আকার-আকৃতিতেও অনেক বড়সড় ছিল। কিন্তু গৃহপালিত হওয়ার পর তারা ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও তুলনামূলকভাবে হ্রাস পায়, এবং আকৃতিগত হ্রাসও ঘটে। মধ্যযুগ পর্যন্ত গবাদি পশুর আকৃতি হ্রাস পাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি ছিল, তবে লম্বা শিং বিশিষ্ট ইটালিয়ান গবাদি পশুতে এগুলো কম হয়েছে। এছাড়া যখন থেকে দুগ্ধজাত খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে গবাদি পশু থেকে বেশি দুধ গ্রহণ করা শুরু হলো, তখন থেকে তাদের স্তন বা বাঁটের আকৃতিও আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।
অষ্টাদশ শতকে প্রথম নির্বাচিত ও পদ্ধতিগত উপায়ে কৃত্রিম গবাদি পশু উৎপাদন শুরু হয়, যার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত শত শত নতুন জাতের গবাদি পশুর উদ্ভব ঘটেছে। এর মাধ্যমে গবাদি পশু থেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি দুধ, মাংস পাওয়া যাচ্ছে, এবং অন্যান্য উপাদান যেমন চুল, চামড়া, খুরের মানও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে নতুন জাতের উৎপাদন সফল হওয়ায়, এখন সেটি অনেক স্থানীয় ঐতিহ্যেরই অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
গবাদি পশু পালনের ইতিহাসের এই পর্বে আমরা প্রাথমিকভাবে জানলাম কীভাবে সভ্যতার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন জাতের গবাদি পশু পালনের সূচনা ঘটেছে, এবং ক্রমশ তা বিস্তার লাভ করেছে। আগামী পর্বগুলোতে আমরা বিশদ আলোচনা করব বাংলাদেশে গবাদি পশু পালনের ইতিহাস, প্রক্রিয়া এবং এর মাধ্যমে কীভাবে আমাদের নিত্যদিনের আমিষের অভাব পূরণ হচ্ছে, সে-সব বিষয় নিয়েই।
লেখাঃ Jannatul Naym Pieal | সূত্রঃ রোয়ার বাংলা