কিছুক্ষণ আগে নিজের বাবার বাড়ি ছেড়ে নতুন এক বাড়িতে এসেছি, যেই বাড়িতে শুধু দুজন মানুষকে ছাড়া আর কাউকে চিনি না। তারা হলেন আমার শাশুড়ি এবং ননদ যারা কয়েকদিন আগেও আমার কাছে শুধু প্রতিবেশী হিসেবে পরিচিত ছিল। আজ আমি তাদের বাড়ির বউ।আমার ননদ আমাকে একটা ঘরে বসিয়ে দিয়ে বলল আমি যাতে একটু রেস্ট নিয়ে নিই।তারপর কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেল। আমি বিছানায় বসে বসে ঘরটার চারদিকে চোখ দিয়ে দেখছি আর ভাবছি যে বাড়িতে কিছুদিন আগেও আম্মুর সাথে আসতাম আন্টিদের সাথে দেখা করার জন্য সেই বাড়িই আজ আমার শ্বশুরবাড়ি। সত্যি কার ভাগ্য কখন কোথায় থাকে আল্লাহ পাক ছাড়া কেউ জানেনা। কিন্তু এখন আম্মু_আব্বু,ভাই_ বোনের কথা খুব মনে পড়ছে। আবার যার সাথে বিয়ে হয়েছে তাকে শুধু একবার দেখেছি যেদিন আমাকে দেখতে এসেছিল। কথা হয়েছিল সেদিনই একবার। এখন অন্যরকম লাগছে কখনো আম্মু- আব্বু ছাড়া কোথাও থাকিনি, আবার এখন একজন ছেলে আমার সাথে থাকবে ভাবতেই লজ্জা লাগছে। এখানে এসে এশার নামায আন্টির(শাশুড়ি) সাথে পড়ে নিয়েছিলাম তাই এখন নামাজের চিন্তা হচ্ছে না। তা না হলে কোথাও বেড়াতে গেলে নামাজ নিয়ে চিন্তা করতে হতো।
দূর!কতসব চিন্তা মাথায় আসছে।বাসায় থাকলে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়তাম।
(হঠাৎ দরজায় নকের শব্দ হলো, তাড়াহুড়ো করে মাথার ঘোমটা ভালো করে দিয়ে বসলাম) কেউ একজন সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকলো। সাথে সাথে হার্টবিট দ্রুত চলতে লাগল ভয়ে এবং লজ্জায়। যিনি ঘরে ঢুকলেন তিনি আর কেউ না আমার স্বামী। মুখে সালামের উত্তর দিব সেই সাহস হচ্ছে না তাই মনে মনে নিলাম। ইমন (আমার স্বামী) বিছানার পাশে দাড়িয়ে আমাকে বললো,
— “সরি এতক্ষণ তোমাকে বসিয়ে রাখার জন্য। আসলে কিছু কাজ ছিলো তাই লেট হলো। এগেইন আ’ম রিয়েলি সরি”।
উনার কথা শুনে কি বলব বা কি বলা উচিত কিছু বুঝতে পারছিনা, শুধু এতটুকু বললাম “ইটস অকে” এবং তাকে সালাম দিলাম উনিও সালামের উত্তর নিলেন।
তারপর বললেন “গল্প শুনবে?”
আমি এখন হাসবো না রাগ করবে বুঝতে পারছিনা। ইমন রাত একটার দিকে আমাকে গল্প শুনাতে চাচ্ছে যদিও আমি গল্প পছন্দ করি কিন্তু এইসময়? যাইহোক উনি আমার স্বামী, উনি এতটা আশা করে গল্প শুনাতে চেয়েছেন। তাই মাথাটা হালকা করে দুলিয়ে হ্যাসূচক উত্তর দিলাম। উনিও বলা শুরু করলেন মনে হয় আমার হ্যা বলার অপেক্ষায় ছিলেন। যাইহোক উনি বলছেন,
— গল্পটা আমার নিজের, আমার প্রথম ভালবাসার গল্প (কথাটা শুনে হঠাৎ করেই ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠল, চোখের কোণে অজান্তেই পানি চলে আসল) আমরা আগে যেই বাসায় থাকতাম সেখানে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে একটা পরিবার থাকতো। তখন আমি অনার্স শেষ বর্ষে পড়ি,তো ওই ফ্যামিলির সাথে আম্মুর ভালো সখ্যতা হয়। কারণ উনারা ইসলামিক মাইন্ডের মানুষ ছিলো।আম্মু আর আমার বোন প্রায় তাদের কথা বলতো।একদিন ওরা দুজন ঐ ফ্যামিলির বড় মেয়ের কথা বলছিলো আম্মুর রুমে বসে। আমি তখন আমার রুৃমে শুয়ে নিউজপেপার পড়ছিলাম। আর উনাদের কথা এমনি শুনছিলাম।
উনারা বলছিলো, মেয়েটা নাকি খুব কান্নাকাটি করে ওর মায়ের কাছে ক্ষমা চাচ্ছিল। তার কারণ ও নাকি ফেসবুকের কোন ছেলের সাথে অডিও কলে কথা বলেছে, কথাটা শুনে আমার তখন খুব হাসি পাচ্ছিল যাইহোক শুনতে লাগলাম তাদের কথা। ওর ফ্যামিলি নাকি এসব পছন্দ করে না কিন্তু তারপরও করেছে, যদিও এ ব্যাপারে তার ফ্যামিলি কিছুই জানতো না কিন্তু ওর ওপর ওর ফ্যামিলির অনেক বিশ্বাস তাই নাকি নিজে থেকেই বলে মাফ চেয়েছে ওর আম্মুর কাছে। আর ওর আম্মু সেটা আমার আম্মুকে বলেছে নিজের মেয়ের ওপর গর্ব করে।আম্মু ইসরাতকে (বোন) বলছে ঐ মেয়ের মতো হওয়ার ট্রাই করতে যাতে ভুল কিছু করলেও পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়। আমার জায়গায় অন্য কোনো ছেলে হলে ঐ মেয়েকে কি ভাবত জানি না বাট আমার কাছে ওর এই অনুতপ্ত হওয়াটা এবং তা স্বীকার করে মাফ চাওয়াটাকে খুব ভালো লেগেছে।যাইহোক আমি আমার নিউজপেপার পড়ার কাজে মনোযোগ দিলাম। আর ঐ মেয়ের কথা মনে করে মুচকি মুচকি হাসছি। এর কিছুদিন পর আমি কোচিং থেকে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় এসে পড়ি। এসে দেখি ফ্ল্যাট এর দরজা খোলা। তাই নক না করে সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকি। কিন্তু আমি ঢুকার সাথে সাথে মনে হলো কোনো মেয়ে আমার সামনে দিয়ে খুব দ্রুত বোনের রুমে চলে গেল। আমি প্রথমে ইসরাত মনে করে ওকে ডাক দিয়ে ওর রুমের সামনে যেতেই দেখি যে ও ইসরাত না অন্য কোনো মেয়ে নিজেকে লুকানোর জন্য একেবারে দেয়াল ঘেসে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু ফেস দেখিনি সেদিন। অন্য কেউ মনে করে আমি আমার রুমে চলে যাই। পরে জানতে পারি ও আমাদের পাশের ফ্ল্যাট এর আন্টির বড় মেয়ে। আম্মুকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এসেছিল। আম্মু আর বোন প্রায়ই ওদের ফ্যামিলি এবং ওর কথা বলত, কেন জানি মেয়েটার প্রতি একটা আলাদা ভালোলাগা জন্মাতে শুরু করল। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানো আমি তখনো তার নাম জানতাম না। শুধু এতটুকু জানতাম ও ইসরাতের কয়েক বছরের সিনিয়ার।
ইমনের কথাগুলো আমার কানে আসছিলো ঠিকই কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না হয়তো স্বামীর মুখে অন্য মেয়ের কথা শুনলে এমনি লাগে(উনি বলে চলেছে)
—মেয়েটাকে আস্তে আস্তে ভালবাসতে শুরু করি যদিও মেয়েটাকে কখনো দেখিনি। শুধু ওর আখলাক দেখে ভালবেসেছি। যদিও জানি না ওকে কখনো পাবো কিনা!
আমি: (কেন জানি অনেক কান্না পাচ্ছে,কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করছি)
ইমন: প্রথমবার কোনো মেয়েকে পছন্দ করেছি কিন্তু আমি এটা জানতাম না যে ও আমার জন্য উত্তম স্ত্রী হবে কিনা! তাই আমার ফিলিংস গুলো আমার মধ্যেই রেখে দিই এবং আল্লাহ পাকের কাছে এই বলে দোয়া করতাম যে সে যদি আমার জন্য উত্তম হয় তাহলে তাকে যেন আমার লাইফে পাঠান। কয়েকমাস পর সেই বাসা চ্যান্জ করে নতুন বাসায় আসি। নতুন বাসায় আসার পরও তার কথা মনে পড়তো কিন্তু এই বলে নিজেকে বুজাতাম যে সে যদি আমার জন্য উত্তম হয় তাহলে তাকে পাবো ইনশাআল্লাহ। এভাবে ৩বছর চলে যায়।পরে একদিন জানতে পারি ওর জন্য নাকি আম্মু ছেলে খুঁজার দায়িত্ব নিয়েছে।আমিও ততদিনে একটা জব করছি। আমি তো মনে করেছিলাম ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছে কিন্ত যখন এটা জানতে পারলাম তখন বুঝতে পারলাম যে হয়তো সে আমার জন্য উত্তম। তাই আম্মুকে সেদিন সবকিছু বলে দিই। আমার ৩ বছরের ভালবাসার কথা সবকিছু। আম্মু দেখি আমার কথায় ওর ফ্যামিলির সাথে কথা বলতে রাজি হয়ে যায়।
আমি: (ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে) তাহলে উনাকেই বিয়ে করতেন। আমাকে কেন করলেন?
ইমন:(মুখে হাসি নিয়ে) করেছি তো! এই যে আমার পাশে বসে কান্না করছে।
আমি:(অবাক হয়ে)মানে!
ইমন:সিরিয়াসলি! তুমি এখনো বুঝো নি? আমি তোমার কথা বলছিলাম, কেন তোমার কি কিছুই মনে নেই?
আমি:আমি তো জানতামই না ইসরাতের কোনো বড় ভাই আছে। সেটা তো আমাকে যেদিন দেখতে আসলেন সেদিন জানলাম। আর আপনি যে এতক্ষণ বললেন সেগুলো এত ছোট বিষয় যে আমি মনে করেছি অন্য কোনো মেয়ে সে। (অভিমান করে) আমাকে নিয়ে বলছেন সেটা বললেই হতো! শুধু শুধু আমার চোখের পানি নষ্ট হলো।
ইমন:আমি তো মনে করছি তুমি বুঝে গেছো!আচ্ছা কান ধরে মাফ চাচ্ছি। এবার আসুন তিন বছরের ভালবাসা সার্থক হয়েছে সে খুশিতে শুকরানার নামাজ পড়ে মহান আল্লাহ পাকের কাছে শুকরিয়া জানাই।
আমি: (নিজেকে খুবই ভাগ্যবতী স্ত্রী লাগছে,একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললাম) জ্বী!
অতঃপর দুজনের নতুন জীবনের সূচনা শুরু হলো।
(এই গল্পটা লেখার একটা কারন ছিল, সেটা হলো একটা মেসেজ দেওয়া। আমরা অনেকেই বলি বিয়ের আগে ভালবাসা পবিত্র। জ্বী! আমিও একমত তবে সেটা যদি হয় মহান আল্লাহ পাকের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে।কাউকে ভালবেসেছি কিন্তু তার রূপ দেখে নয় বরং ইমানি আখলাক দেখে তবে তাকে পেতেই হবে সেটা নয়।আল্লাহর কাছে দোয়া করা যদি ঐ ব্যক্তি আমার জন্য উত্তম হয় তবে তাকে আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে দান করবেন। যদি তাকে না পান তাহলে বুঝে নিবেন সে আপনার জন্য উত্তম নয়।বিশ্বাস ভালবাসার উপর নয়, আল্লাহ পাকের উপর বিশ্বাস রাখবেন।তাহলে হয়তো সেটাই হবে আপনার পবিত্র_ভালবাসা)
লেখা: জান্নাত তানিয়া