আমি তোমাকে চোখধাঁধানো, ঝলমলে,
উজ্জ্বল এক পৃথিবীর সন্ধান দিতে পারি!
কথাগুলো কি পরিচিত মনে হচ্ছে? সেই দরিদ্র বালক, এক রাজকুমারী আর প্রদীপের জ্বিন? ডিজনি নির্মিত অ্যানিমেশন সিনেমা ‘আলাদিন’-এর বিখ্যাত সংলাপ এটি। আরব্য রজনীর সেই গল্পের দৃশ্যায়নে মুগ্ধ হয়েছে দর্শক। ১১ শতকের সেই গল্পে একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষ উদ্বেলিত হয়। গল্পের কি অকল্পনীয় শক্তি!
আরও চমকপ্রদ খবর হলো, আলাদিনের শহরের দেখা মিলবে এখন খোদ দুবাই শহরে! এতদিন যা ছিল বইয়ের পাতা আর কল্পনায় তা এখন দেখেও চোখ জুড়াবে। চীনে বসবাসকারী এক সাধারণ যুবক আলাদিনের ভাগ্য বদলে গিয়েছিল একটি জাদুর প্রদীপ পেয়ে। প্রদীপের জ্বিন তাকে প্রাসাদ তৈরি করে দিয়েছিল। গল্পের প্রাসাদ চীন দেশে হলেও বাস্তবে আলাদিনের প্রাসাদের দেখা মিলবে দুবাইয়ে।
সুবিশাল আবাসন এবং বাণিজ্যিক প্রকল্পের প্রতিশব্দ বলা যায় দুবাইকে। আভিজাত্য, বিলাসিতা নামক শব্দগুলোকে ছাপিয়ে গেছে তাদের স্থাপনাগুলো। দৈত্যাকৃতি বুর্জ খলিফা অথবা পাম আকৃতির জুমেইরা দ্বীপ কোনটির বিস্মিত করার ক্ষমতা বেশি সেটা নিয়ে একটা ছোটখাটো বিতর্কও হয়ে যেতে পারে।
แทงบอลวันนี้
বুর্জ খলিফা নিয়ে আজও মানুষের উন্মাদনা দেখার মতো। ব্যাপারটা এমন, একবার এই বস্তু চোখে দেখলেই যেন জীবন স্বার্থক। বিলাসবহুল এই টাওয়ার যতটা ব্যয়বহুল তার চেয়ে বহুগুণ বেশি নান্দনিক। অন্যদিকে গাছের আকৃতি দিয়ে বানানো ‘জুমেইরা দ্বীপ’-কে মানবসৃষ্ট এক অপূর্ব বিস্ময় বললেও অত্যুক্তি হয় না।
দুবাই পশ্চিম এশিয়ার সমৃদ্ধ একটি রাষ্ট্র। খনিজ সম্পদে বেশ সমৃদ্ধ। এর উপর নির্ভর করে আছে দেশের অর্থনীতি। এই খাতে নির্ভরশীলতা কমাতে রাষ্ট্রটি এখন পর্যটন শিল্পে মন দিয়েছে। আকৃষ্ট করছে নিত্যনতুন চমক দিয়ে। ‘আলাদিন সিটি’ সেই পরিকল্পনারই একটি অংশ।
এটি একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। আদপে রূপকথার বর্ণনায় উঠে আসা কোনো বিষয়কে বাস্তবে রূপদান করার দুঃসাহস দেখানোটাই বিরাট পদক্ষেপ। নকশা প্রণয়ন, মডেল তৈরি, অনুমতি আদায় সব মিলিয়ে একটি দীর্ঘ পথ পরিক্রমা।
তবে স্বপ্নবাজ মানুষেরা এই কঠিন কাজটি করে দেখিয়েছেন। দুবাই কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে আলাদিন সিটি তৈরির অনুমতি মেলে ২০১৪ সালে। কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। ঐতিহাসিক দুবাই খাঁড়ির নিকট এই নির্মাণাধীন স্থাপত্যটি অবস্থিত।
২০২০ সাল অবধি করা দুবাইয়ের সবচেয়ে হাই প্রোফাইল প্রজেক্ট এই ‘আলাদিন সিটি’। আরব্য রজনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দুবাইয়ের ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে তৈরি এই জাদুর শহর।
পশ্চিমা বিশ্বের যত বড় বড় স্থাপনা আছে তার কোনোটার তুলনায় এটি ফেলনা নয়। বরং বাকিসব স্থাপনা থেকে এটি অনন্য। হোক সেটি পরিকল্পনা অথবা নির্মাণশৈলি।
দুবাই মিউনিসিপালিটি এই ‘আলাদিন সিটি’ তৈরির নেতৃত্বে আছেন। ডিরেক্টর জেনারেল হুসাইন নাসের লুতাহ তত্ত্বাবধানে এই কার্যক্রম আলোর মুখ দেখে। তিনি বলেন,
এটি সৌন্দর্য এবং পর্যটনের ছোঁয়ায় নির্মিত অতীত কিংবদন্তির প্রতীক।
মেইনহার্ডট গ্রপের তত্ত্বাবধায়নে নির্মাণাধীন ‘আলাদিন সিটি’-র সুবিধাসমূহ-
-৩টি সুবিশাল টাওয়ার
-হোটেল
-অফিস
-সেতু ও ফুটপাত
-পার্কিং এরিয়া
মূল স্থাপনার ভেতর রয়েছে তিনটি ‘গোল্ডেন টাওয়ার’। ১,১০,০০০ বর্গমিটার জায়গা জুড়ে থাকবে এদের বিস্তৃতি। আলাদিনের দৈত্যের প্রদীপের মতো আকৃতি এদের। সব থেকে বড় টাওয়ারটি ৩৪ তলা বিশিষ্ট। আর বাকি দুটো ২৬ ও ২৫ তলা বিশিষ্ট। টাওয়ার তিনটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেতু দ্বারা পরস্পরের সাথে সংযুক্ত। সেতুর মেঝে চলমান এবং পৌরাণিক সাপ ও ড্রাগনের মতো আকৃতি।
হোটেল এবং অফিসগুলো এই তিনটি টাওয়ারে থাকবে। ২৭ তলা বিল্ডিংয়ে থাকবে অফিস এবং হোটেল। একটি ৮ তলা ভবন হোটেলের প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। একটি ১৮ তলা বিল্ডিং ১০ তলা হাই পার্কিং বিল্ডিংয়ের সাথে যুক্ত হবে। থাকবে ৯০০ গাড়ি পার্ক করার সুব্যবস্থা।
দুবাই ক্রিক থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৫০ মিটার। এর সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছে ১.৮৩৫ বিলিয়ন ডলার। পুরো প্রজেক্টটি একটি বন্দর হিসেবে নির্মিত হবে।
রূপকথার আদলে তৈরি হলেও এটি পরিচালিত হবে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় এবং আধুনিক পদ্ধতিতে। বিশেষ করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ এবং এলিভেটরের ব্যবহার এই স্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। যদিও ২০১৮ সালেই এটির আলোর মুখ দেখার কথা ছিল তথাপি এই কার্যক্রম ২০২০ সাল পর্যন্ত চলে এবং হঠাৎ সমগ্র বিশ্ব কোভিড-১৯ মহামারি আক্রান্ত হওয়ার কারণে এর নির্মাণকাজ স্থবির হয়ে পড়ে। তবে তাতে রূপকথা প্রেমিদের আগ্রহে ভাটা পড়েনি। মানুষের যে পরিমাণ উন্মাদনা এই ‘আলাদিন সিটি’-কে ঘিরে রয়েছে তা আসলেই কল্পনাতীত।
আবার এটি ঐতিহ্যবাহী দুবাই খাঁড়ির নিকটে অবস্থিত হওয়ায় বন্দর এলাকার স্থাপনা হিসেবেও এটি আলাদা গুরুত্ব পাবে। কেননা বন্দর এমন এক জায়গা যেখানে নানা দেশের বহুলোকের আগমন ঘটে। জায়গা বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষ বেশ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। এক হিসেবে একে বিনে পায়সায় বিজ্ঞাপন হিসেবেও বিবেচনা করা যায়।
দুবাই সবসময়ই তাদের সুবিশাল স্থাপনাগুলোর জন্য বিখ্যাত। তাদের টাওয়ারগুলো একই সাথে আলোচিত এবং সমালোচিত। সুতরাং ‘আলাদিন সিটি’ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে এটি কি পরিমাণ সাড়া ফেলবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। বাচ্চাবুড়ো সকলেই আরব্য রজনীর মহাভক্ত। তার উপর দুবাই নিয়েও তাবৎ দুনিয়ার আগ্রহের সীমা নেই। সব মিলিয়ে এটি সবদিক থেকে সকলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।
শুধুমাত্র ‘আলাদিন’-ই নয়। সিন্দাবাদসহ আরব্য উপন্যাসের অন্যান্য গল্পের অনুপ্রেরণাও স্থাপনা তৈরি হবে। ব্যাপারটা তখন এমন হবে যে, আরব্য উপন্যাস চোখের সামনে দেখতে পাবে সারা বিশ্ব। চোখের সামনে রূপকথা! ভাবতেই কেমন শিহরণ জাগে! এই আধুনিক সময়ে এসে শত শত বছরের পুরোনো এক গল্পের জীবন্ত উপস্থাপনা!
আপাতদৃষ্টিতে যা দূরবর্তী স্বপ্ন মনে হয়, সেগুলোকেই বাস্তবে রূপ দেয় দুবাই। এতে তাদের বেশ সুনাম বা বদনাম রয়েছে। আলাদিন সিটিকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক শহরে পরিণত করতে সকল রকমের উদ্যোগ ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। বহির্বিশ্বও মুখিয়ে আছে অন্তিম চমক দেখার অপেক্ষায়। মূলত পর্যটনশিল্পে অন্যমাত্রায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকেই এই ‘আলাদিন সিটি’ তৈরির উদ্যোগ।
বৈশ্বিক মন্দার এই সময়ে শুধুমাত্র সম্পদের উপর নির্ভরশীল না হয়ে সৃষ্টিশীল ও উৎপাদনশীল প্রকল্প হাতে নেওয়ার এক অনন্য নজির তৈরি করেছে দুবাই। যদিও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের বদনাম রয়েছে তাদের। লাগামহীন বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য তারা সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত। তবে এটিও ঠিক যে, তারা অর্থ যে পরিমাণ ব্যয় করে সেই তুলনায় আয় আরও অনেক বেশি।
দিন দিন তারা অর্থ, সম্পদ এবং রুচিশীলতায় আরো বেশি সমৃদ্ধ হচ্ছে। বহির্বিশ্বেরও দুবাইয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। পৃথিবীর বহু নামী তারকাদের অবসর উদযাপনের প্রিয় জায়গা দুবাই। তাদের এই সাফল্যে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে তাদের সুবিশাল অনন্য স্থাপনাগুলো।
এই সাফল্যে নতুন পালক যোগ করবে ‘আলাদিন সিটি’ এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত লোকজনের চিন্তাধারাতেও পরিবর্তন আসবে বৈ কি! আলাদিনের জাদুর প্রদীপ তার মোহ মায়া ছড়িয়ে দিতে অপেক্ষা করে আছে দুবাই খাঁড়ির কিনারে!
Feature Image: pinterest.com Reference: 01. Aladdin City. 02. Aladdin City Dubai UAE. 03. Aladdin City.